গতকালের ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় নিহত মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে। উভয় দেশে হাজারো মানুষ আহত হয়েছে।
ভূমিকম্পে উভয় দেশে ধসে পড়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে জোর তৎপরতা চলছে। উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে পারে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিকম্পের কারণে বিভিন্ন জনপদ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোথাও ভূমিকম্পের তীব্রতা বেশি, কোথাও কম। যেমনই হোক, ভূমিকম্প মানুষের জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা বিশেষ। তাই বলা হয়েছে, যখন কোথাও ভূমিকম্প, সূর্যগ্রহণ, ঝড়ো বাতাস কিংবা বন্যা হয় তখন মানুষের উচিত আল্লাহতায়ালার কাছে অতি দ্রুত তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তার কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা।
ভূকম্পনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তার প্রিয় সৃষ্টি মানুষকে সতর্ক করেন, যাতে তারা অনুতপ্ত হয় এবং আল্লাহর পথে ফিরে আসে। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত, কেন এত ভূমিকম্প হচ্ছে?
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তার বান্দাদের সতর্ক করার জন্য বিভিন্ন ধরনের নিদর্শন সৃষ্টি করেন। বান্দাদের উচিত তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, যাতে করে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, তাদের বোধোদয় হয়।’
মহান আল্লাহ বলছেন, ‘আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনগুলো পাঠাই।’ সুরা বনি ইসরাইল : ৫৯
কোরআনে কারিমের অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বলে দাও! আল্লাহ তোমাদের ওপর থেকে অথবা তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম।’ সুরা আনআম : ৬৫
সহিহ্ বোখারি শরিফে হজরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যখন তোমাদের পায়ের নিচ থেকে আজাব পাঠাতে সক্ষম’ আয়াতটি নাজিল হলো, তখন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
শায়খ ইস্পাহানি (রহ.) এই আয়াতের তাফসির করেছেন এভাবে, ‘এর ব্যাখ্যা হলো ভূমিকম্প ও ভূমিধসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া (পৃথিবীতে ভূমিকম্প হওয়া)।’
বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, তা মহান আল্লাহর প্রেরিত সতর্ককারী নিদর্শনগুলোর একটি। এগুলোর মাধ্যমে পরাক্রমশালী আল্লাহ তার বান্দাদের ভয় দেখিয়ে থাকেন। বুজুর্গদের মতে, এসব মানুষের কৃতকর্মের ফল, পাপের প্রভাব। কোরআনে কারিমে এ বিষয়ে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের কামাই। আর আল্লাহ তোমাদের অনেক (অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।’ সুরা শুরা : ৩০
আল্লামা ইবনুল কাইউম (রহ.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ কখনো কখনো পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন, যার ফলে তখন বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়। এটা মানুষকে ভীত করে। ফলে তারা মহান আল্লাহর কাছে তওবা করে। পাপকাজ ছেড়ে দেয়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তাদের কৃত পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়।’
অতীতে বিভিন্ন সম্প্রদায় ভূমিকম্পের আজাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তা ছাড়া ভূমিকম্প কিয়ামতের একটি অন্যতম আলামত। কিয়ামত যত নিকটবর্তী হবে ভূমিকম্পের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম (জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফিতনা প্রকাশ পাবে, খুন-খারাবি বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে তা উপচে পড়বে।’ সহিহ বোখারি : ১০৩৬
বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা এবং তাদের দান করা উচিত। কেননা হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দয়া প্রদর্শন করো, তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা হবে।’ মুসনাদে আহমদ
বর্ণিত আছে, যখন কোনো ভূমিকম্প হতো, খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার গভর্নরদের দান করার কথা লিখে চিঠি দিতেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা মানুষকে বিপর্যয় (আজাব) থেকে নিরাপদে রাখে। তা হলো যথাসাধ্য সমাজে প্রচলিত জিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচার রোধ করা।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খেয়ানত করা হবে, জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে উচ্চ স্বরে শোরগোল হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হবে নেতা, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে, তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হবে, মদ পান করা হবে, লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময় তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে এবং এমন একটি ভূমিকম্প হবে যা সেই ভূমিকে তলিয়ে দেবে।’ তিরমিজি : ১৪৪৭
বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকালে এ হাদিসের বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়। ভূমিকম্প এমনই একটি দুর্যোগ, যা নিবারণ, প্রতিকার, প্রতিরোধ কিংবা পূর্বাভাষ পাওয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি মানুষ অদ্যাবধি আবিষ্কার করতে পারেনি। সুতরাং এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও আশ্রয় প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।