তোফায়েল আহমেদ শিহাব:
রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যে যিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, অনুসৃত তিনি জীবনানন্দ দাশ। শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবির তকমা পাওয়া জীবনানন্দের কবিতা পড়া মানেই মুগ্ধতার জালে বন্দি হওয়া।
বুদ্ধদেব বসুর অনুভবে তিনি ❝একটি জ্বলন্ত তারা❞। বাংলা সাহিত্যের অন্য কবিদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলা যায় জীবনানন্দের তুলনা জীবনানন্দ স্বয়ং। তিনি কবিতা বুনটের প্রচলিত পথে হাঁটেননি। গড়ে তুলেছিলেন নগ্ন নির্জন এক সরণি। সে পথে তিনি একা এবং একক। প্রেম, ইতিহাস, বিস্ময়, স্মৃতি, শরীর, ক্লান্তি, বিষাদ, মৃত্যু—এমন বহু কিছু নিয়ে তিনি প্রশ্ন করেন, উত্তর অন্বেষণ করেন।
সমকাল তাকে মূল্যায়ন করেনি। সজনীকান্তরা কোন কিছুই ভালো চোখে দেখত না তাঁর। সামান্য অজুহাতে চাকরি চলে যাওয়া, প্রকাশকদের লেখা প্রকাশে অপারগতা, সাংসারিক জীবনেও অশান্তি ছিল। সব প্রতিকূলতা ছাপিয়ে তিনি লিখে গেছেন ভবিষ্যতের জন্য। নীরবে নিভৃতে তৈরি করেছেন এক ধূসর ও পরাবাস্তব পৃথিবী। তাই মহাকালের পাঠক তাঁর কাছে চিরঋণী।
কারণ-অকারণের ঊর্ধ্বে আমার জীবনানন্দ আগ্রহ। সাহিত্যিক ও ব্যক্তি জীবনানন্দ আনন্দের সহিত জানা-পড়া। সব ছাপিয়ে জিজ্ঞাসু মনে বারবার উঁকি দেয় জীবনানন্দের মৃত্যু ব্যাপারটি। কবির মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য! জীবনানন্দের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা? পাঠক গবেষক সমালোচক মহলে আজও জীবনানন্দের নাম আসলে প্রশ্নটিও এসে যায়। কিটস শেলির মতো এক রহস্যে ঘেরা মৃত্যু হয়েছিল কবির। যে কারণে উৎসুক পাঠকের মনে আজও নানাবিধ প্রশ্নের উদয় হয়!
ডায়েরিতে এক জায়গায় জীবনানন্দ দাশ প্রশ্ন তুলেছেন:
❝জীবনানন্দ দাশের মতো মানুষ কীভাবে তৈরি হয়?❞
তিনিই লিখেছেন:
❝অনেকের কাছেই জীবনানন্দ দাশ ধাঁধা।❞
অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাছে আজ জীবনানন্দ ধাঁধার হাজারো উত্তর থাকলেও, জীবনানন্দের মৃত্যু আজও অনেকটাই ধাঁধা!
জানা যায় ট্রামের নিচে যখন পড়েন তখন কবির হাতে দুই থোকা ডাব ছিল! এটাও প্রশ্ন একজন লোক হাতে ডাব নিয়ে আত্মহত্যা করতে যাবেন কেন! কিন্তু কলকাতার একশো বছরের ইতিহাসে একমাত্র জীবনানন্দ দাশই ট্রামের নিচে পড়ে মারা যান। কবিই কেন একমাত্র এই দুর্ঘটনার শিকার হবেন!
আত্মহত্যার প্রশ্নটি উঁকি দেয় কারণ যিনি মারা যান তিনি আর কেউ নন, তিনি ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। বেঁচে থাকাকালীন পরিবার সমাজ সমালোচক কেউই সহায় ছিলনা যার। এসকল যৌক্তিক কারণেই আত্মহত্যার প্রশ্নটি এসে যায়। সঞ্জয় ভট্টাচার্য এ সন্দেহ উড়িয়ে দিতে নারাজ। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিতেও প্রমাণ করেনা নিছক দুর্ঘটনার ব্যাপারটা।
কবির বন্ধু সুবোধ রায় প্রত্যক্ষদর্শী জনৈক চুনিলাল দে’র জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, ❝জলখাবার ছাড়িয়ে জুয়েল হাউসের সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন জীবনানন্দ দাশ। চুনিবাবুর মতে শুধু অন্যমনস্ক নয়, কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। স্টপেজ স্টেশন থেকে তখনো ট্রাম প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। ক্রমাগত ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারবার সাবধান করে দিয়েছিল ট্রাম ড্রাইভার। তবুও যা অনিবার্য তাই ঘটল। গাড়ি থামল যখন, প্রচণ্ড ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গেই কবির দেহ তখন ক্যাচারের ভেতরে ঢুকে গেছে।❞ (আমার বন্ধু জীবনানন্দ, সুবোধ রায়)।
কবি এমনই গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন যে ট্রামের হুইসেল লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতেও তিনি সরে এলেন না। কবির জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়ও প্রত্যক্ষদর্শী চুনিলাল দে’র ভাষ্য উদ্ধৃত করেছেন- ❝সমবেত জনতার মধ্যে দু-একজনের কথা কানে এল। তারা বলছেন ট্রাম লাইনের এই ঘাসের উপর এক ভদ্রলোক আপন মনেই আসছিলেন। ট্রামের ড্রাইভার ঘণ্টা বাজিয়েছে, দু-একজন রাস্তার লোক ট্রাম আসছে বলে চীৎকারও করেছে। কিন্তু ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় এত বিভোর ছিলেন যে কোনো কিছুই তার কানে যায়নি।❞ (জীবনানন্দ, গোপালচন্দ্র রায়)।
আরেকটি ব্যাপার, ভূমেন্দ্র গুহ ‘আলেখ্য জীবনানন্দে’ জানিয়েছেন। কবি ট্রামের নিচে পড়ার কিছুদিন আগে দু-তিনদিন বোন সুচরিতা দাশের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছেন, বোনের বাসার কেউ ট্রামের নিচে পড়ার সংবাদ শুনে। গিয়ে যখন দেখেছেন সব ঠিক আছে তখন নির্বিকার ফিরে এসেছেন কবি। একই ঘটনা দু-তিনদিন ঘটার পর সুচরিতা জীবনানন্দের ল্যান্স ডাউনের বাসায় এসে থাকা শুরু করেন। এর কিছুদিনের মাথায় কবিই ট্রামের নিচে পড়লেন।
কবি নির্জন ছিলেন, কিন্তু উদাসীন নয়। নির্জনতার দোহাই দিয়ে দুর্ঘটনা বলে স্বতঃসিদ্ধ করা যায় না৷ এ করলে অন্যায়ই হবে কবির প্রতি। এ সম্পর্কে কবি পত্নী লাবণ্য দাশের বক্তব্য যথার্থ, ❝অনেকে বলেন, তিনি নিপাট ভালো মানুষ, আত্মভোলা, কোনোদিকে তার দৃষ্টি ছিল না ইত্যাদি। এসব যখন শুনি বা পড়ি, তখন খানিকটা অদ্ভুত লাগে। কারণ ঐ ছবিতে আমি যেন আমার অচেনা ব্যক্তিত্বহীন একজন সাজানো গোছানো শৌখিন কবির তৈরি করা ছবি দেখতে পাই। আমি ঐ ব্যক্তিত্বহীন জীবনানন্দকে সত্যিই চিনি না। আমার স্বামীর ছবি, আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য।❞ (আমার স্বামী জীবনানন্দ দাশ)।
একজন লেখকের ব্যক্তি জীবন চিন্তা দর্শন অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় প্রভাব বিস্তার করে। জীবনানন্দ দাশের জীবনে দাম্পত্য সংকট ছিল এটা অনেকটা সন্দেহের ঊর্ধ্বে সত্য বলে পরিগণিত। জীবনানন্দের মাল্যবান উপন্যাসটি দাম্পত্য কলহের এক দলিল: দাম্পত্য সংকটের প্রকোপ কতটা প্রকট আকার ধারণ করেছিল কবির জীবনে, তা আঁচ করা যায় উপন্যাসটি পড়লে। এ উপন্যাসে স্ত্রী উৎপলার চরিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে কবি ব্যক্ত করেছেন তার নিঃশব্দ প্রতিবাদ।
জীবনানন্দ বিষয়ে অসীম উৎসাহী, জীবনানন্দেরই সমকালীন কবি, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের একটি পত্রাংশ—❝আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এ কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে, এবং আমরা দেখেছি, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।❞
সঞ্জয় ভট্টাচার্য এ সম্পর্কে স্পষ্ট লিখেছেন, ❝আমি জীবনানন্দের পারিবারিক অনেক ঘটনাই জানি; যা খুব একটা সুখের ছিলনা। ওর বউর সাথে প্রতিদিন একটা দ্বন্দ্ব- আমাকে বলতো৷ জীবনানন্দ তার থেকে মুক্তি খুঁজছিল।❞
একজন জীবনানন্দ, তিলে তিলে জীবনানন্দ হয়ে উঠেছিলেন। তার লেখালেখির প্রকৃতি কবির দেখা চিরচেনা নিসর্গই। বাংলা কবিতার ধারায় ধূসর এক পৃথিবীর স্রষ্টা জীবনানন্দের নির্জন জগৎ গড়ে উঠার পেছনে সামগ্রিক পরিবেশের পাশাপাশি কবির দাম্পত্য সম্পর্ক একমাত্র নয় তবে দায়ী। কবির সাথে লাবণ্য দাশের বিয়ে হয় ১৯৩০ সালে। ততদিনে কবির ধূসর পাণ্ডুলিপি প্রকাশ হয়ে গেলেও লাবণ্য দাশ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
আরও খটকা লাগে জীবনানন্দের মৃত্যুর পর। নিঃশব্দ কবিকে বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সজনীকান্ত দাস দেখতে এলে লাবণ্য দাশ ভূমেন্দ্র গুহকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ❝এক সময়ে জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ আমাকে ঝুল বারান্দার কাছে ডেকে নিয়ে গেলেন। বললেন, অচিন্ত্যবাবু এসেছেন, বুদ্ধদেব এসেছেন, সজনীকান্ত এসেছেন, তা হলে তোমাদের দাদা নিশ্চয়ই বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন; বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো, আমার জন্য কী রেখে গেলেন, বলো তো!❞ (আলেখ্য: জীবনানন্দ-ভূমেন্দ্র গুহ)।
কিছু রেখে যাননি এ প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও কাছাকাছি থেকে তাদের কতটা দূরত্ব ছিল, এতে তা সহজেই অনুমেয়।
জীবনানন্দের অনেকটা জীবনী বলে আলোচিত মাল্যবান উপন্যাসেও এর ছায়াপাত পরিলক্ষিত। মাল্যবান উপন্যাস প্রকাশ হোক কবিপত্নী এতে ইচ্ছুক ছিলেন না। এর জেরেই জীবনানন্দ সমগ্র সম্পাদনা থেকে শঙ্খ ঘোষ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কবির মৃত্যুর বহু বছর পর কবিভ্রাতা অশোকানন্দ উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন।
জীবনানন্দের কবিতায়ও প্রেম প্রকৃতি আর দেশাত্মবোধের সাথে মৃত্যু চেতনার কথা বারবার এসেছে। এসেছে আবার ফিরে আসার কথা, পুনর্জন্মের কথা। ‘ঝরা ফসলের গান’ কবিতায় কবি বলেন— ❝পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই গেয়ে যাই আমি, মরণে রে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।❞
জীবিত অবস্থায় অবমূল্যায়নের শিকার কবি-সাহিত্যিকের তালিকায় অন্যতম জীবনানন্দ দাশ। নেহায়েত অভিযোগে চাকরি চলে যাওয়া, সম্পাদকের আনুকূল্য না-পাওয়া, কবিতা পাঠিয়েও প্রত্যাখ্যাত হওয়া এগুলোই ছিল হতভাগ্য জীবনানন্দের কবি ভাগ্য।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘জীবনানন্দ দাশ এর স্মরণে’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, ❝আজ নতুন করে স্মরণ করা প্রয়োজন যে জীবনানন্দ তাঁর কবি জীবনের আরম্ভ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত অসুয়াপন্ন নিন্দার দ্বারা এমনভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন যে, তারই জন্য কোনো এক সময়ে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রেও বিঘ্ন ঘটেছিল। এ কথাটা এখন আর অপ্রকাশ্য নেই যে, ‘পরিচয়ে’ প্রকাশের পরে ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি সম্বন্ধে অশ্লীলতার নির্বোধ ও দুর্বোধ্য অভিযোগ এমনভাবে রাষ্ট্র হয়েছিল যে, কলকাতার কোনো এক কলেজের শুচিবায়ু-গ্রস্ত অধ্যক্ষ তাঁকে অধ্যাপনা থেকে অপসারিত করে দেন। অবশ্য প্রতিভার গতি কোনো বৈরিতার দ্বারাই রুদ্ধ হ’তে পারে না এবং পৃথিবীর কোনো জন কিটস অথবা জীবনানন্দ কখনো নিন্দার ঘায়ে মূর্ছা যান না—শুধু নিন্দুকেরাই চিহ্নিত হয়ে থাকেন মূঢ়তার, ক্ষুদ্রতার উদাহরণস্বরূপ।❞
চাকরি হারিয়ে একে-ওকে ধরেছেন, চিঠি দিয়েছেন কবি। তৎকালীন স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ুন কবিরকে লেখা (১৬.৪.৫৪) জীবনানন্দের চিঠির অংশবিশেষ।
❝আমার প্রিয় অধ্যাপক কবির,
বিশিষ্ট বাঙালিদের ভিতর আমি পড়ি না; আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কোনও কিছু, যা শেষ বিচারে একটা কোনও জিনিসের-মতন-জিনিস; কিন্তু, ভাগ্য এমনই যে, আজ তার পেটের-ভাত জুটছে না। কিন্তু, আশা করি, একটা দিন আসবে, যখন খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে; আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।…..❞
কবি কতটা অর্থকষ্টে ছিলেন তারই নিদারুণ পরিচয় পাওয়া যায় শয্যাশায়ী অবস্থার একটা ঘটনায়। ভূমেন্দ্র গুহ ‘আলেখ্য জীবনানন্দ’-এ জানিয়েছেন, মৃত্যু শয্যায় শোয়া জীবনানন্দকে দেখতে এসেছেন ভূমেন্দ্র গুহ সহ ময়ূখ গোষ্ঠীর কয়েকজন। তাদের দেখে অসুস্থ কবি জিজ্ঞেস করেন, তাদের জানাশোনার মধ্যে কম মূল্যের কোনো বাসা আছে কি না!
নিঃসঙ্গ কবির অবমূল্যায়িত জীবনের কথা তাঁর ডায়েরিতেও এসেছে বারবার। উনপঞ্চাশতম জন্মদিনে লিখছেন: ❝Birthday unnoticed.❞ তিনি খুব সচেতন যে সবাই তাঁকে হতাশাপীড়িত বলে জানে। ডায়েরিতে তাই লেখেন: ❝এইসব এইসব এইসব এইসব অনন্তকাল ধরে যেন আমাকে ঘিরে রয়েছে।❞
এভাবে সকল দিক থেকেই বঞ্চিত ছিলেন কবি। সাহিত্যিক, সমালোচক, পাঠক, প্রকাশক এমনকি নিজের ঘরও কবির জন্য হয়ে উঠেছিল অচেনা এক পৃথিবী। যেই পৃথিবীতে জীবনানন্দ কবি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রী।
প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁরই সম্পাদিত জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র গ্রন্থে তিনি বলেছেন, ❝আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে এবং আমরা দেখেছি। তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।❞
সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুবোধ রায়, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য ও কবির যাপিত জীবনের বাস্তবতায় প্রতীয়মান হয় কবির মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা নয়। খুব সঙ্গত কারণেই কবির মৃত্যু আমার কাছে স্বেচ্ছামৃত্যু বলে মনে হয়। একটা সমাজ, সামাজিক পারিবারিক অগ্রাহ্যতা, সামগ্রিক অবমূল্যায়ন কবিকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে।
কবির মৃত্যু নেই। জীবনানন্দের শারীরিক বিদায় হয়েছে কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তার মহৎ কর্মের মাঝে। কবির আক্ষেপই সত্য হয়েছে, তাঁর কর্মের যথার্থতা নিরূপিত হয়েছে ঠিকই, তবে তা কবি দেখে যেতে পারেননি। এ দায়, এ অপরাধ সমকালের, যারা একজন মহৎ কবিকে চিনতে পারেনি। মৃত্যুর এত বছর পরও কবিকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা প্রমাণ করে তাঁর জনপ্রিয়তা।
মলয় রায় চৌধুরীর কবিতা দিয়েই শেষ করছি—
❝মিশর বয়ে চলে গেছে নীল নদের জলে
লোহার দেয়াল ভেঙেছেন ভ্যান গঘ যা তিনি একটি চিঠিতে বলেছিলেন।
কলকাতাও মিশে যাবে ধূলায়
কিন্তু জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকবেন চিরকাল
আমার আর তোমার ভেতর।❞
তোফায়েল আহমেদ শিহাব: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, স্কলার্সহোম মেজরটিলা কলেজ, সিলেট।