শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে স্বাধীন হওয়া এ দেশের সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেশিরভাগ সময়েই দায়িত্ব পালন করেছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। সেনাপ্রধান, বিচারপতি ও শিক্ষকএমন পেশাজীবীরা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত যারা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাদের মধ্যে মাত্র সাতজন রাজনীতিক। অরাজনৈতিক ব্যক্তি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে থাকায় অনেক ঝুটঝামেলা, সংবিধান কাটাছেঁড়াসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশ ও দেশের মানুষকে।
এমন প্রেক্ষাপটে ২০০২ সালের ৯ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাজনীতিবিদকে রাষ্ট্রপতি বানাব। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমানকে মনোনীত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতিবিদকেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তৎকালীন সংসদের উপনেতা জিল্লুুর রহমানকে। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২০ মার্চ মারা যান আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া এ নেতা। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন সংসদের স্পিকার মো. আবদুল হামিদকে। একই বছর ২২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টানা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হন তিনি। এ পর্যন্ত ১৭ জন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারপ্রাপ্ত, অস্থায়ী ও পূর্ণ মেয়াদসহ ১৭ জনের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া মাত্র সাতজন রাজনীতিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়েই গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। তার প্রথম মেয়াদ ধরা হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত।
মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় অস্থায়ী সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন একজন চৌকস রাজনৈতিক নেতা। তাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
পঞ্চম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোহাম্মদউল্লাহ একসময় আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। ১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হন তিনি। ছিলেন ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন এবং ১৯৯১ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ছিলেন খন্দকার মোশতাক। আওয়ামী লীগ করলেও বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গে জড়িত এ নেতার কুখ্যাতি রয়েছে। তার দায়িত্বকাল ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত।
পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস মুসলিম লীগ তথা বরিশাল বিভাগের শান্তি কমিটির নেতা ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির শাসন আমলে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ষোড়শ রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পেশাজীবী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ২০০২ সালের ২১ জুন পর্যন্ত এ পদে ছিলেন তিনি। তার পদত্যাগের পর সপ্তদশ (ভারপ্রাপ্ত) রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া জমিরউদ্দিন সরকার ন্যাপ-ভাসানীর রাজনীতি থেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন।
সপ্তম রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, নবম ও দশম রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার, একাদশ রাষ্ট্রপতি আহসান উদ্দীন চৌধুরী, ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিচারপতি থেকে রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তবে অষ্টাদশ রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ছিলেন পেশায় শিক্ষক। অষ্টম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও দ্বাদশ রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাশাসক থেকে রাষ্ট্রপতি পদ দখল করে নেন। ক্ষমতায় থেকে পরে দুজনই রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
অবশ্য রাষ্ট্রপতি রাজনীতিবিদই হতে হবে এমন কোনো নিয়ম না থাকলেও যেহেতু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে সেক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মধ্যে এই নিয়ে নেতিবাচক একটি ধারণা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন রাজনীতি সম্পৃক্ত। তবে তিনি বিচারক হলেও তৃণমূল পর্যায়ের রাজনীতি করা। প্রবীণ এ নেতা বলেন, ‘বিচারক, আমলা হওয়ার আগে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় আমি আশাবাদী তিনি রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।’
পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য বলেন, রাষ্ট্রপতি রাজনীতিবিদ হতেই হবে এমন কথা নেই। বাংলাদেশ যেহেতু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নিয়েছে, সেক্ষেত্রে একটু কেমন দেখাতে পারে। রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য দরকার। রাষ্ট্রপতির কাজ যেন শুধু মাজার উদ্বোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। তার কাজে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হোক।’