লিখেছেন মাহবুব রব চৌধুরী
বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং একমাত্র মহিলা নবাব। তিনি কুমিল্লার : লাকসামের অন্তর্গত হোমনাবাদ পরগনার জমিদার ছিলেন। নিজ যোগ্যতা , দক্ষতায় গড়েছেন ইতিহাস। দৃঢ়চেতা এবং প্রজা হিতৈষী জমিদার হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পরিচিতি কেবল মাত্র একজন নারী নবাব হিসেবেই নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজ সেবা এবং জনহিতকর কাজের জন্য তিনি ছিলেন নিজেই নিজের তুলনা। ধর্ম , কর্ম, সমাজসেবা সহ উপমহাদেশের ইতিহাসে রূপ ও গুনের অনন্য অসাধারন সমন্বয়।
১৮৩৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন । জমিদার আহমেদ আলী চৌধুরী আর মা আরাফান্নেসা চৌধুরাণীর তিনি ছিলেন প্রথম কন্যাসন্তান। দুই ভাই আর দুই বোন মিলে চার ভাই বোন।
ছোট বেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী। লেখাপড়ায় আগ্রহী। পরিবারিক নিয়মানুবর্তিতা সুপরিবেশ তার জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলে। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা দ্রুতই কয়েকটি ভাষার উপর দক্ষতা অর্জন করেন । বাংলা, আরবি, ফার্সি ও ইংরেজি এ চারটি ভাষায় ছিল তার ব্যুৎপত্তি ।
১৮৭৩ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর নিজ গুনে অন্যান্য ভাই বোনের সম্মতিতেই তিনি হোমনাবাদ, পশ্চিমগাঁও-এস্টেটের জমিদারি লাভ করেন এবং ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি মাতুল সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হন। ফয়জুন্নেসা তার চিন্তা কাজ ও কর্মে ছিলেন সে সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক অগ্রসর । তখনকার প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সবরকম বাঁধা এবং কুসংস্কার পার হয়েই তিনি নিজ চিন্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মুক্ত সমাজ গঠনে মনোযোগি হতে পেরেছিলেন । তাই একজন নারী হয়েও সে সময়ে জমিদারির কঠিন দায়িত্ব তিনি সঠিক ও সফলভাবেই পালন করতে পেরেছিলেন ।
১৮৭৩ সালেই নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের জন্য তিনি কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীন স্কুলগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি ‘বেগম রোকেয়া’র জন্মের সাত বছর পূর্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
নওয়াব ফয়জুন্নেসা (পশ্চিমগাঁয়ে) একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাসও করেন। পরবর্তিকালে ১৯৪৩ খ্রীঃ এটি উচ্চ মাধ্যমিক ইসলামিক কলেজে রূপান্তরিত হয়। অতঃপর ১৯৬৫ খ্রীঃ কলেজটি ডিগ্রী কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৮২ খ্রীঃ এ কলেজটিকে সরকারি করা হয় এবং নাম করা হয় নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজ। তিনি পবিত্র মক্কা শরিফে ‘মাদ্রাসা-ই-সওলাতিয়া ও ফোরকানিয়া সহ বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানে প্রচুর পরিমানে সহায়তা করেন। তখনও সৌদি আরব এখনকার মত পেট্রোডলারে সমৃদ্ধি অর্জন করেনি।
শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মেয়েদের স্বাস্থ্য রক্ষা ও সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন। ১৮৯৩ সালে কুমিল্লা শহরে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল’। ১৮৯৩ সালে নওয়াব বাড়ির কাছেই তিনি মেয়েদের জন্য একটি স্বতন্ত্র হাসপাতাল নির্মাণ করেছিলেন। তিনি তার জমিদারির ১৪টি মৌজায় ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অনেকগুলো দাতব্য প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এতিমখানা এবং সড়ক নিমার্ণ করে তার মানবতাবাদী ও সমাজ সংস্কারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি নওয়াব বাড়ীর সদর দরজায় একটি দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করার সময় তিনি মক্কায় হাজীদের জন্য একটি মুসাফিরখানাও প্রতিষ্ঠা করেন।
ত্রিপুরা- কুমিল্লার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. ডগলাস । স্থানীয় উন্নয়ন কাজে সরকারি অর্থ বরাদ্দ হয়ে আসতে দেরি হওয়ায় তিনি নিজ উদ্যোগেই উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে স্থানীয় হিন্দু জমিদার ও ধনাঢ্যদের নিকট ঋণ হিসাবে ১০ হাজার করে ৯ জনের কাছে সুদে সর্বমোট ৯০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর কাছেও তিনি ১০ হাজার টাকা ঋণ চান। এভাবে মি. ডগলাস তার ১ লক্ষ টাকার ঘাটতি বাজেট পূরণের প্রচেষ্টা নেন। এই প্রজেক্টটি ছিল মি. ডগলাসের কর্ম জীবনের এবং সুনামের একটি চ্যালেঞ্জ। টাকাটি তখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সুদের হার বাজার দর থেকে অনেক কম এবং পরিশোধ সময় সীমা বেশি হওয়ার কারনে প্রথম ৯ জন ইতিমধ্যেই গড়িমসি শুরু করে। অনিশ্চয়তার এমন এক চাপের মুখেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাস টাকার জন্য এবং সুদ বিষয়টির ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধে মি. ডগলাস নিজেই বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সঙ্গে দেখা করেন।
সাক্ষাৎ কালীন সময় বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাস থেকে নিজ কানে ১০ হাজার টাকা সুদ সহ ঋণ দেবার প্রস্তাব শুনার পর উত্তরে বলেন , আমি সুদে টাকা লগ্নি করতে চাই না। মি. ডগলাস এরপর বলেন আরো ৯ জনও একই ভাবে টাকা দিচ্ছেন। এটি শুনবার পর শান্ত ভাবেই বেগম ফয়জুন্নেসা বলেন এখন তো আবার সুদ ছাড়া আপনাকে টাকা দিব – সে পরিবেশ পরিস্থিতিও থাকছে না। কারন একই প্রজেক্টে সমতাহীন অবস্থানও কাম্য নয়। এটি শুনার পর মি. ডগলাসের চিন্তা ও পেরেশানির মাত্রা যখন উর্ধ্বমুখী তখন তিনি বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর থেকে একটি পাল্টা প্রস্তাব পেলেন। আর তা হল, মি. ডগলাস যদি আমি একাই পুরা এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিই ? এবং তা যদি হয় সুদ মুক্ত এবং ঋণ মুক্ত ! এক কালীন গ্রান্ট। আপনি কি তা গ্রহণ করবেন ? অতঃপর এ কথার বাকি আর কি থাকে । মি. ডগলাস সেদিন বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে সহস্র ধন্যবাদ জানিয়ে সফল আলোচনা শেষে ফিরে এসে ছিলেন। এরপরই বেগম ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ব্রিটিশ মহারানি ভিক্টোরিয়া থেকে নবাব উপাধি পান।
ফয়জুন্নেসা শিল্প , সাহিত্যেও তিনি চিন্তা ধারার স্বাক্ষর রেখেছেন । রূপজালাল , সঙ্গীত লহরী ও সঙ্গীত সার নামে তিনটি বই তিনি প্রকাশ করেছেন। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না সাহিত্য সাধনায় ফয়জুন্নেসার পথ ধরেই বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব হয়েছে। বাংলার নারী সাহিত্যে তার অবদান কখনই অস্বীকার করা যাবে না ।
২০০৪ সালে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয় এবং তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী নিবাসের নামকরণ করা হয়েছে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছাত্রী নিবাস।
১৯০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে বাংলার এ মহীয়সী নারী ইন্তেকাল করেন । নিজ প্রতিষ্ঠিত দশগুম্বুজ মসজিদের পাশে পারিবারিক কবরস্থানে তিনি আজ চির নিদ্রায় শায়িত ।
লেখক : মাহবুবুর রব চৌধুরী, ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক, টরন্টো।