মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
ম্যাগনা কার্টা: বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাস ক্ষমতার এবং রাজা, বাদশা ও জনতার। ১৫ই জুন, ১২১৫ সালে ইংরেজ রাজা কিং জন ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী ব্যারনদের সাথে রানিমেইড নামক স্থানে নদীর পাড়ে বসে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবেরির মধ্যস্থতায় লিখিত চুক্তিটিতে চার্চের অধিকার, অন্যায়ভাবে ব্যারনদের কারাবাস না দেবার প্রতিশ্রুতি, সবার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুরক্ষিত রাখা হয়। সামন্তরা কোন শর্তে কী পরিমাণ অর্থ রাজকোষাগারে দেবেন এ বিষয়টিও চুক্তিটিতে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকে। এটি রাখা হয় ব্যারনদের ২৫ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত পর্ষদের কাছে।
রাজা জন চাপে পড়ে রাজার অধিকার সংক্রান্ত এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির কারণেই রাজা কেও হতে হয়েছিলো নিয়ম, আইন, কানুনের অধীন। এটিই ইতিহাসে ম্যাগনা কার্টা। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এটি একটি ণ্ডরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ‘ম্যাগনা কার্টা’ রাজার ক্ষমতা খর্ব করার একটি ঐতিহাসিক দলিল। ‘ম্যাগনাকার্টা’ কে বলা হয় ব্রিটিশ গঠনতন্ত্রের বাইবেল।
ওই সময় কালেই- ১২০৪ সালে বাংলায় শুরু হয় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ারের শাসন আমল।
ফরাসি বিপ্লব: ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্স এ প্যারিসের কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত “থার্ড স্টেট” বা সাধারন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
ফার্স্ট স্টেট: কিং, জমিদার, ব্যারন, সামন্ত অভিজাত কুল এবং পুরহিত যাজোক শ্রেণীর মিলিত গ্রূপ।
সেকেন্ড স্টেট: ঊচ্চ বুর্জুয়া- ব্যাংকার, উচ্চবিত্ত শ্রেণী। মধ্য বুর্জুয়া- ডাক্তার, উকিল, প্রফেসর শ্রেণী।
থার্ড স্টেট: গরিব মজলুম কৃষক, মুজুর শ্রেণী।
The causes of the French Revolution are generally seen as arising from the failure of the Ancien Régime to manage social and economic inequality. Rapid population growth and the inability to adequately finance government debt resulted in economic depression, unemployment and high food prices. Combined with a regressive tax system and resistance to reform by the ruling elite, it resulted in a crisis Louis XVI proved unable to manage.
ফরাসি বিপ্লব বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে ণ্ডরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং একই সাথে দেশের রোমান ক্যাথলিক চার্চ গোঁড়ামী ত্যাগ করে নিজেকে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এই শ্লোগানটিই বিপ্লবের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছিলো যার মাধ্যমে সামরিক এবং অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্লোগানটি তখন খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলো।
বিপ্লবের সময় সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল ৫ ভাগ মানুষ। এরাই যত আয়কর দিত। অথচ বিনিময়ে তারা তেমন কোন সুবিধা ভোগ করতে পারত না। এবং এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে নির্যাতন করা হত। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক।
একবার কোন বন্দী সেখানে প্রবেশ করলে জীবন নিয়ে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকত না। ণ্ডম খুন ছিল নির্যাতনের হাতিয়ার। ছিল অসংখ্য বন্দী। এই অবস্থায় শেষ মেশ বিক্ষুব্ধ মানুষ ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই নির্বাচিত প্রতিনিধি, সেনা পুলিশ রক্ষী বাহিনির সদস্যরা বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে রওনা হয়। রক্তক্ষয় এড়াতে প্রতিনিধিরা দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন।
প্রস্তাব ছিল বাস্তিলে ৭ জন রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া। দ্য লোন সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়াতে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢেউ বাস্তিল দুর্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুর্গের সৈন্যরাও ভিতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। প্রায় দুইশো বিপ্লবী মানুষ হতাহত হয়। এরপর চারিদিক থেকে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ ধ্বংস করে। জয় হয় সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার। তার পর থেকে এই ঘটনাটি ফ্রান্সের জাতীয় উৎসব বলে পালন করা হয়।
ফরাসি বিপ্লব আমেরিকান রাজনীতিকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এরপর প্রথম আমেরিকায় পার্টি সিস্টেম তৈরি হয়। ১৭৯৩ সালে, ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হলে টমাস জেফারসনের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি ফ্রান্সের পক্ষে অবস্থান নেয়। তবে জেফারসন সহ জর্জ ওয়াশিংটন এবং তার মন্ত্রিসভা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই চুক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়াবে না।
এই সময় কালটি আবার ছিল। ঐতিহাসিক ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধ শেষে বাংলার স্বাধীনতা হারানর অল্প কিছু দিন পরের ঘটনা। পলাশীর ঠিক শত বছর পর ১৮৫৭ তে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের মহা বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। বিদ্রোহ শেষে, ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপের মাঝেই এক রাজকীয় ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতায় পর্যায় ক্রমে অংশ গ্রহণ এবং দেশবাসীর প্রতি বন্ধুত্ব ও ন্যায়বিচারের আশ্বাস পূর্ণ বাণী দেন। অনেকে এই ঘোষণাকে ভারতবাসীর জন্য এক ধরনের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে অভিহিত করেন।
ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকেই বিশ্ব মানুষের চিন্তা চেতনা আর রাজনৈতিক গতির ধারা অনুধাবন করা যায়। মানুষ চির দিনই ন্যায়, সাম্য, মৈত্রী স্বাধীনতা সুবিচার, সু শাসনের পক্ষে ধাববান।
বিপরীত ঘটনা ক্রোমই সৃষ্টি করে বিপ্লবের পরিবেশ আর অশান্ত পরিস্থিতি।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরোন্ট
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)