লিখেছেন গোপেন দেব
২৭ আগস্ট শনিবার। সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, তবে অবিরাম নয় – থেমে থেমে।একটু সময় বৃষ্টি আবার একটু বিরতি। বিরতিতে একচিলতে রোদের ঝলকানি।এভাবে চলেছে দুপুর পর্যন্ত। সাথে হয়েছে মেঘে রোদে লুকোচুরি খেলা। দিনের প্রথম ভাগের পুরোটাই কেটেছে অনিশ্চয়তায়! যদিও আগের দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সেরকম ছিল না।
এদিকে মন্ট্রিয়লের কেন্ট পার্কের বিরাট অংশ জুড়ে স্টেজ আর স্টলের স্থাপনা। বাংলা মেলার বিশাল আয়োজন। বৃষ্টি বিঘ্নিত প্রস্তুতি। তবু থেমে নেই কর্মিদের প্রাণচাঞ্চল্য! আয়োজক সংগঠক বাংলাদেশ সোসিও কালচারাল ফোরাম (BSCF)’র কর্মকর্তাদের মনোবল দৃঢ়। সুহেল মিয়া – যিনি বাংলা মেলার প্রধান সমন্বয়কারী, বললেন, “দাদা সূর্য উঠবেই”। ঠিকই ঝকঝকে সোনা-রোদ ছড়িয়ে মধ্যগগনে সূর্য। বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধতায় চারপাশ হয়ে ওঠে প্রশান্তময়। যেন অনুষ্ঠান শুরুর আগে শুদ্ধাচার হলো প্রকৃতির। আর সেটা অনুষ্ঠান শুরুর ঘন্টা দুই আগেই।
ধীরেধীরে মেলা স্থলে মানুষের পদচারণা বাড়তে লাগলো। সন্ধ্যার আগেই মন্ট্রিয়লের কেন্ট পার্কটি হাজারো বাঙালির কলকুন্জনে মুখরিত হয়ে ওঠলো। রূপান্তরিত হলো এক খন্ড বাংলাদেশে। আমার পাশেই বসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা একজন ভদ্রমহিলা। সরকারি কলেজের অধ্যাপনায় ছিলেন। গতবছর রিটায়ার করেছেন।মেয়ের সন্তান হবে, দু সপ্তাহ হয় এসেছেন এখানে। লাভালে থাকেন তাঁর মেয়ে আর জামাতা। এখানে এসে স্বদেশের লোকজন দেখে এতই আনন্দ পেয়েছেন খালাম্মা, বললেন “বাবা, এতো দেখছি বাংলাদেশেই আছি”। মেলায় এসে এরকম উচ্ছ্বাস ছিল অনেকেরই।
মাঝে বৈদ্যুতিক গোলযোগে সামান্য ছন্দপতন হলেও সাংষ্কৃতিক পর্বটি ছিল বেশ গোছানো, সংক্ষিপ্ত – টেনেটুনে দীর্ঘ করে বিরক্তির উদ্রেক করা নয়। ফলে পর্বটি একটানা উপভোগ করেছেন সবাই। অনুষ্ঠানে বহুজাতিক সমাজের নানা রকম পরিবেশনা বাংলা মেলার থিমটাকে বৈচিত্রময় করেছে নিঃসন্দেহে।
স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য, গানের পর মঞ্চে উঠেন অতিথি শিল্পী শুভ্র দেব। নেচে গেয়ে কথায় শুধু মঞ্চ নয় পুরো মেলা প্রাঙ্গনটাই যেন কাঁপিয়ে দিলেন তিনি।হ্যামিলনের সেই বাঁশিওয়ালার মতো তাঁর সুরের টানে তরুন যুবক পৌঢ় সবাই ছুটে আসেন মঞ্চের কাছে। শিল্পীর সাথে নেচে গেয়ে উল্লাসমুখর এক সুরময় আবহ সৃষ্টি করেন তাঁরা। শুভ্র দেব শুরু করেন দেশাত্মবোধক দিয়ে।পরপর তিনি তাঁর গাওয়া জনপ্রিয় অনেকগুলো গান করেন। করেন সিলেটের আঞ্চলিক গানও। “কৃষ্ণচূড়ার ছায়ে ছায়ে …”, কিংবা “প্রতিদিন ফোটে ফুল রাতে ঝরে যায়, যে বাঁশি ভেঙ্গে গেছে, ভেঙ্গে যেতে দাও, মিছে কেনো তারে পেতে চাও …” যখন গীত হচ্ছিল অনেকেরই কী তখন মনে হয়নি অভিমানী এই মন ‘কেনো’ অযথা কাঁদায়! নস্টালজিকতায় নিমগ্ন কী হননি কোনো কোনো জন ?
শিল্পী শুভ্র গানে, কথায় স্মৃতির ঝাঁপি যেমন খুলেছেন, তেমনি মেলে ধরেছেন আনন্দ-ডালি। বলা যেতেই পারে, মন্ট্রিয়লে এবারের শেষ বাংলা মেলাটি স্মরণীয় করে রাখার ব্যাপারে অন্যান্য অনুসঙ্গের সাথে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, কম্পোজার, মডেল, অভিনেতা চিরসবুজ শুভ্র দেবের ভূমিকা অনন্য মাত্রা হিসেবেই গণ্য হবে।
মেলার সাংষ্কৃতিক পর্বটির বর্ণনাও ছিল চমৎকার, সংক্ষিপ্ত। শুদ্ধ উচ্চারন আর যুৎসই শব্দ প্রয়োগে পর্বটির নানা পর্যায়কে বিনি সুতোর মালায় গেঁথেছিলেন সাংবাদিক ফরহাদ টিটো। মেলার অন্যান্য পর্বেও ছিল উজ্জ্বল উপস্থাপনা। সহ-উপস্থাপনায় ছিলেন মিলকি ফারুক ও সুধা হালদার।
মেলার স্টলগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভীড়। বিএসসিএফ’র কর্মিরাও ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই সক্রিয়। পার্কের প্রতিটি কোণায় লক্ষ্যনীয় ছিল তাঁদের কর্মমুখর উপস্থিতি। বৃষ্টি, বৈদ্যুতিক গোলযোগ কোনো কিছুই দমাতে পারেনি মেলার গতি। এ যেন ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’। বলতে দ্বিধা নেই, শতশত বাঙালির মিলনমেলায় মুখরিত এই বাংলা মেলার আনন্দ-কথা কমিউনিটিতে আলোচনা হবে বহুদিনই।
ধন্যবাদ বাংলাদেশ সোসিও কালচারাল ফোরামের সকল কর্মিকে একটি সফল বাংলা মেলা উপহার দেয়ার জন্য। আপনারা কমিউনিটির প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিলেন যে আরও।