মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
বর্বর মঙ্গোল আক্রমন বীরত্বের সাথে রুখে দেবার জন্য- মুসলিম ইতিহাস চিরদিন এই তিন বীর যোদ্ধার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। এবার মূল কাহিনীতে যাবার আগে ছোট্ট করে জেনে নেওয়া যাক বিশ্বের বুকে মঙ্গোল উত্থানের বিস্ময় কর ইতিহাস। মঙ্গল কারা? চেঙ্গিস খান ১১৬২ সালে মঙ্গোলিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি তার পিতাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাবার ট্রাইবের – নিজ ণ্ডষ্ঠির নেতৃত্বকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। ১২২৭সালে চেঙ্গিস খান মৃত্যু বরণ করেন। ৬৫ বছর জীবনীতে তিনি নিজেকে বিশ্ব ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি ছিলেন মঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। গ্রেট খান উপাধি নিয়ে ১২০৬ সাল থেকে ১২২৭ পর্যন্ত ২১ বছর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তার এই সম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি রূপে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। ইউরোপ, এশিয়া ও মধ্যে প্রাচ্যের বিশাল ভুখন্ড এই সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়। অবাক লাগে ১২০৬ সাল থেকে ১২৬০ সাল পর্যন্ত অর্ধশত বছরে তারা বেইজিং, বাগদাদ, বুখারা, বুলগেরিয়া, সমরখন্দ, আলেপ্পোর মত শক্তিশালী বড় বড় শহর দখল করে নিতে পেরেছিল। ইউরোপ ও এশিয়া দুদিকেই তাদের গতিবেগ ছিল অপ্রতিরুদ্ধ। তখন দুনিয়ার মানুষ ভাবতে শুরু করেছিল মোঙ্গলদের থামানো বোধ হয় অসম্ভব। ৫০ বছরে তারা যত টুকু অর্জন করেছিল রোমানরা তা ৪০০ বছরেও অর্জন করতে পারেনি। মঙ্গোল জাতি ণ্ডষ্টি অবাক করা এক বিচিত্র ইতিহাস বিশ্ব মাঝে রেখে গেছে।
এই মঙ্গোলরা ইলতুৎমিসের শাসন আমলে প্রথম ভারত আক্রমণ করে। ১২২১ সালে চেঙ্গিস খান আফগান খোরেজম সাম্রাজ্যের যুবরাজ জালালউদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করে ভারতবর্ষের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সিন্ধু নদীর তীরে সংঘটিত প্রচন্ড এক যুদ্ধে তিনি জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন, অতঃপর চীন বিষয়ে তার নিজস্ব পূর্ব পরিকল্পনার কৌশল গত প্রয়োজনে মঙ্গোলিয়ায় ফিরতে বাধ্য হন। ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তনের এটিই ছিল মূল কারন।। তৎকালীন দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস তখন বীরত্বের সাথে মঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করবার পূর্ন প্রস্তুতি নিয়ে রাখেন।
এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে মঙ্গোল আক্রমনের প্রথম দিকের শুরু।
১২৯০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১০ বছরে মোঙ্গলরা পরপর ৬ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে। এবং ২ বার দিল্লি দখলেরও চেষ্টা করে। মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর ফলে ভারতবর্ষ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায়। যার মূল কৃতিত্ব অসাধারন যোদ্ধা, রণ কৌশলী সুদক্ষ রাষ্ট্র নেতা সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির।
প্রথম মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৭-১২৯৮) : ১২৯৭ সালের শীতকালে চাঘাতাই খানাতের খান ভারত আক্রমণের জন্য ১ লক্ষ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী প্রেরণ করেন। বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন মোঙ্গল সেনানায়ক কদর। কদরের নেতৃত্বে মোঙ্গল সৈন্যরা সুলাইমান পর্বতমালা অতিক্রম করে এবং দিল্লি সালতানাতের অন্তর্গত পাঞ্জাব অঞ্চলে আক্রমণ চালায়।
এটি ছিল ভারতবর্ষে প্রথম বড় মাত্রার মোঙ্গল আক্রমণ। মোঙ্গল সৈন্যরা পাঞ্জাবে ব্যাপক হারে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ চালায় এবং কাসুর শহর পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং শহরটি জ্বালিয়ে দেয়। মূল উদ্দেশ্যে ছিল জনমনে ভয় ভিত্তি ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেওয়া।
পাঞ্জাবে মোঙ্গল আক্রমনের খবর শুনে সুলতান আলাউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করার জন্য তার ভাই উলুঘউদ্দিন খান এবং সেনাপতি জাফর খানের নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনী দ্রুত পাঞ্জাব প্রেরণ করেন। দিল্লির সৈন্যরা ত্বড়িৎ গতিতে পাঞ্জাবে এসে পৌঁছায়। ‘জারান মাঞ্জুর’ নামক স্থানে দিল্লির সৈন্যরা মোঙ্গল সৈন্যদের মুখোমুখি হয়। ১২৯৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত এই যুদ্ধে মোঙ্গল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৮-১২৯৯) : ১২৯৮ সালের শেষদিকে মোঙ্গলরা দিল্লি সালতানাতের পশ্চিম সীমান্ত অবস্থিত সিন্ধু প্রদেশে আক্রমণ চালায় এবং সিভিস্তান দুর্গ (বর্তমান পাকিস্তানের সেহওয়ান শহর।) আক্রমন করে।
দিল্লির সেনারা তখন উলুঘ খান ও নুসরাত খানের নেতৃত্বে ণ্ডজরাট অভিযানে ব্যস্ত ছিল। সুলতান আলাউদ্দিন সিভিস্তান পুনরুদ্ধারের জন্য জাফর খানের নেতৃত্বে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র এক সৈন্যদল প্রস্তুত করে প্রেরণ করেন। ১২৯৯ সালের প্রথম দিকে দিল্লির সৈন্যদল সিভিস্তান দুর্গের নিকটে পৌঁছে এবং দুর্গটি অবরোধ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর দিল্লির সৈন্যরা দুর্গটি পুনর্দখল করে নিতে সক্ষম হন।
তৃতীয় মোঙ্গল আক্রমণ (১২৯৯) : ১২৯৯ সালের মাঝামাঝিতে পর পর দুবার ব্যর্থ হবার পর চাঘাতাই খানাত পূর্ণ শক্তিতে দিল্লি সালতানাতের ওপর আক্রমণ চালায়। মোঙ্গল খান দুয়ার ছেলে কুৎলুঘ খাজার নেতৃত্বে প্রায় ২ লক্ষ সৈন্য এই আক্রমণে অংশ নিয়েছিল।
মোঙ্গলদের এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ। দিল্লি সালতানাতকে ধ্বংস করা এবং ভারতবর্ষে চাঘাতাই খানাতের কর্তৃত্ব স্থাপন করা। আবার মোঙ্গলরা দীর্ঘমেয়াদী একটি অভিযানের জন্য প্রস্তুত নিয়েই এসেছিল। সঙ্গে ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য ও রসদপত্র। নিয়ে এসেছিল। স্থানীয়ভাবে রসদপত্র সংগ্রহের সুবিধার জন্য এবার তারা শহর লুণ্ঠন থেকেও বিরত ছিল।
মোঙ্গলরা দিল্লির থেকে প্রায় ১০ কি.মি. দূরে কিলি নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে। আলাউদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে মোঙ্গলদের আক্রমণ না করে মুখো মুখী অবস্থান নেন। এ কৌশলের উদ্দেশ্য ছিল, বিলম্বের ফলে মঙ্গোল সেনাদের অস্থির ও ক্লান্ত করে তোলা। এবং ইতি মধ্যে মোঙ্গলদের রসদপত্রও হ্রাস পেতে থাকবে । অতঃপর এ যুদ্ধে মোঙ্গলদের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় মোঙ্গলরা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয় । এবং যুদ্ধে মোঙ্গল নেতা কুৎলুঘ খাজা ণ্ডরুতরভাবে আহত হন।
পশ্চাৎপসরণের সময় পথিমধ্যে আহত কুৎলুঘ মৃত্যুবরণ করেন। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তারপরও চূড়ান্ত বিচারে মোঙ্গলদের এই আক্রমণটিও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
ভারত এবং ভারতবাসীকে মঙ্গল আক্রমন ও নির্মমতার খপ্পর থেকে বাঁচাতে প্রচন্ড সাহসিকতার সঙ্গে নিজ জীবন বাজি রেখে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি : তাদেরকে নিরাপত্তার চাদরে জড়িয়ে রাখেন।
বিশ্ব মোঙ্গল বিভীষিকা যখন চারিদিক প্রায় গ্রাস করে ফেলেছিলো তখনই ঘটে ছিল এই অসম্ভব সম্ভবের ঘটনা। ১২৬০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হঠাৎই থেমে গেল অপ্রতিরোধ্য মোঙ্গলদের জয়রথ।এক অসাধ্য সাধন হল ফিলিস্তিনের গাজার অদূরে আইন জালুত প্রান্তরে।
প্রেক্ষাপট্ এইরূপ “পূর্ব ও পশ্চিমের মহান খানের পক্ষ থেকে প্রেরিত হল মামলুক সুলতান কুতুজের উদ্দেশ্যে একটি পত্র। আমাদের তলোয়ার থেকে পালিয়ে থাকবে কোথায় ? জানত আমাদের ঘোড়াণ্ডলি দ্রুতগামী, আমাদের তীর ধারালো, আমাদের তলোয়ার বজ্রের মত, আমাদের হৃদয় পর্বতের মত কঠিন, আমাদের সেনা অগণিত। দুর্গ আমাদের আটকাতে পারবে না, কোনো সেনাবাহিনী আমাদের থামাতে পারবে না। আল্লাহর কাছে তোমার মোনাজাত আর দোয়া আমাদের বিরুদ্ধে কাজে আসবে না। অশ্রু আমাদের চালিত করে না । শুধুমাত্র যারা আমাদের কাছে সুরক্ষা চাইবে এবং সারেন্ডার করবে তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। যুদ্ধের আণ্ডন জ্বলে উঠার আগেই দ্রুত জবাব দিন। প্রতিরোধ করলে আপনি সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হবেন। আমরা আপনাদের মসজিদণ্ডলি চুরমার করে দেব এবং এরপর আপনাদের সন্তান ও বৃদ্ধদেরকে হত্যা করা হবে। এই মুহূর্তে আপনি একমাত্র শত্রু যার বিরুদ্ধে আমরা অগ্রসর হয়েছি। এখন হিসাব করেই উত্তর দিন।
এটি ছিল ১২৬০ সালে হালাকু খানের চিঠির ভাষা। কায়রোতে সুলতান কুতুজের কাছে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করবার হুমকি পূর্ণ দাবি ।
সাইফউদ্দিন কুতুজ জানতেন ইতিপূর্বে যারা ভয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল তাঁদের কী করুণ পরিণতি হয়েছিল। তাই কাপুরুষের মত বিনা যুদ্ধে অপমানের সাথে মারা পড়ার চেয়ে তিনি চাইলেন এই বর্বর বাহিনীকে মোকাবেলা করতে। একটি উচিত শিক্ষা দিতে। চিঠির উত্তরটা সুলতান কুতুজ দিয়েছিলেন মোঙ্গল দূতের শিরশ্ছেদ করে। ফলাফল কি হবে তা ত সকলের জানা ।
অবধারিতভাবেই বেঁধে গেল যুদ্ধ। সুলতান কুতুজ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মোঙ্গলদের মোকাবেলা করার। সেই সময়ে মিশরে ইসলামিক স্কলার ছিলেন শেখ ইজ্জউদ্দিন আব্দুস সালাম । তিনি তার বক্তব্যে সুপষ্টভাবে সুলতান কুতুজের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেন এবং জনগণকে দলে দলে কুতুজের বাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান করলেন। এছাড়া সিরিয়া থেকে আরেক কিংবদন্তী সেনা নায়ক রুকনুদ্দিন বাইবার্স সুলতান কুতুজের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন।
শুরুতে মোঙ্গলদের আক্রমণের মুখে কুতুজের সৈন্যদের অবস্থা ছিল কিছুটা টালমাটাল। তখন সুলতান নিজে শিরস্ত্রাণ খুলে উঁচু জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের বললেন মা এর্বং মরো। নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সৈন্যদের মাঝে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য। যেহেতু প্রান্তরটি সরু তাই মোঙ্গলরা তাঁদের পুরনো সেই ট্যাক্টিক্স ব্যবহার করতে পারলনা। উপরন্তু সিরীয় সৈন্যদের ভেদকরে কুতুজের ব্যুহের ভেতরে প্রবেশ করার পর তারা সুলতান কুতুজের সব থেকে প্রশিক্ষিত এলিট বাহিনীর মুখের সামনে পরে গেল । এদিকে সিরীয় সৈন্যদের জন্য তাঁরা আর পিছিয়েও আসতে পারছিলনা।
সাথে সাথে দুই পাশ থেকে মোঙ্গলদের উপর নেমে আসল তীর বৃষ্টি। এক পর্যায়ে তাঁদের সেনাপতি কিতবুকা যুদ্ধ ক্ষেত্রেই মারা যান। তারপরই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে মোঙ্গল সেনাবাহিনী।
দিণ্বিদিক বিক্ষিপ্ত ভাবে পালিয়ে যেতে মোঙ্গলরা।বাইবারসের নেতৃত্বে থাকা বাহিনীর হাতে ণ্ডটি কয়েকজন বাদে সকল হানাদার মঙ্গোল সৈন্যই নিহত হয়। যা বিশ্ব ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
এভাবেই পরাজয় ঘটে অহংকারী নির্দয় মঙ্গোল হালাকু বাহিনীর। নিমিষেই চূর্ণ হয়ে যায় তাঁদের আকাশছোঁয়া দম্ভ। পৃথিবীর ইতিহাসে তাই ণ্ডরুত্বপূর্ণ যুদ্ধণ্ডলোর মধ্যে এখনও আইন জালুতের যুদ্ধকেও ধরা হয়। এই যুদ্ধে সুলতান কুতুজ হেরে গেলে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও ইউরোপে এর্ক বড় অংশ হতে পারত বাগদাদ, সমরখন্দ ও বেইজিং এর মত রক্তাত্ব বধ্যভুমিতে। বর্বর মোঙ্গল বাহিনীকে রুখে দেওয়ার জন্য এবং অনন্য কীর্তির প্রতিদান হিসাবে বিশ্ববাসী তিন এই বীরের কথা ইতিহাসের সোনালী পাতায় যথোপযুক্ত মর্যাদায় স্মরনে রেখেছেন ।
মাহবুবুর রব চৌধুরী – টরন্টো