প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মহাদেশ, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে উত্তাপ প্রবাহ দীর্ঘ সময় ধরে প্রবাহিত হচ্ছে।
এই সালের জানুয়ারির মধ্য ভাগে দক্ষিণ আমেরিকার,আর্জেন্টিনা,ব্রাজিল, প্যারাণ্ডয়ে, উরুণ্ডয়ে এসব দেশে রেকর্ড ভাঙা ৪৪ ডি. সেলসিয়াসের বেশি উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে, আর্জেন্টিনা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ ছিল। ফেব্রুয়ারীর ২য় সপ্তাহে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিস্কো, লস এঞ্জেলস এবং সান দিয়েগো শহরে রেকর্ড ভাঙা তাপ প্রবাহ প্রবাহিত হয়। মার্চের শেষ দিক থেকে ভারত স্মরনাতীত কালের সবচেয়ে বেশি মার্চ-এপ্রিল উত্তপ্ত সময় পার করে। মে মাস জুড়ে আমেরিকার বিভিন্ন শহরে তীব্র তাপদাহ প্রবাহিত হয়। এই বছরের মধ্য জুন থেকে আমেরিকার প্রায় অর্ধেক অঞ্চলে রেকর্ড ভাঙা উত্তাপ প্রবাহিত হতে থাকে। জুনের শেষ দিকে জাপানে বিগত ১৫০ বছরের সর্বাধিক তাপ মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। ২০২২ সালে ইউরোপীয় তাপ প্রবাহ পশ্চিম ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ ও ব্রিটেনে ছড়িয়ে পড়ে। স্পেনে ৪৫.৭ ডি. সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। পর্তুগালের পিনহাউ-এ ১৪ জুলাই ৪৭ ডি. সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উঠে। লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে ১৯ জুলাই স্মরনাতীত কালের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডি. সে. অতিক্রম করে। ব্রিটিশ সরকার ১১ আগস্ট দক্ষিণ, পূর্ব ও মধ্য ব্রিটেনকে মারাত্মক খরা পীড়িত অঞ্চল বলে ঘোষণা করে। এই সময় তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা জারি করা হয়।
চীনের উত্তর ও মধ্য অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ পরিলক্ষিত হয় যদিও ওই সময় দক্ষিণ অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাতের জন্য ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেন ও জাপানে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। আগস্টের প্রথম দিকে নাইজেরিয়ার জিগোয়া প্রদেশ মারাত্মকভাবে বন্যা কবলিত হয়।
জাম্বিয়াতেও ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। শ্রীলংকায় প্রচুর বৃষ্টির ফলে বন্যা ও ব্যাপক ভূমিধ্বস ঘটে।
এই বছরের ৮ আগস্ট দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল ও আশপাশের অঞ্চল ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। এই অঞ্চলে গত ৮০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়। ২,৮০০ এর বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কমপক্ষে ৯ জনের প্রাণহানি হয়।
ভারত ও বাংলাদেশেও ২০২২ সালে ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। এ বারের বন্যায় বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ও দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি এখনো ভারতের গজলডোবার তিস্তার সবণ্ডলো স্লুইসগেট খুলে দেয়ার ফলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকা অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের স্মরনাতীত কালের বন্যার ফলে এখন পর্যন্ত ৫০০ এর অধিক লোকের প্রাণহানি হয়েছে। বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা বিনষ্ট হচ্ছে।
২০২২ সালের প্রথম ভাগে তীব্র তাপদাহের কারনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বন ভূমির ব্যাপক দহন ঘটে। এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়ার উলজিন প্রদেশে মার্চের প্রথম দিকে থেকে শুরু হওয়া বনভূমিতে যে আণ্ডনের সূত্রপাত হয় তাতে ৪২,০০৮ একর এলাকা পুড়ে যায়।আফ্রিকার মরক্কোর বনভূমির আণ্ডনে প্রায় ৫,০০০ একর অঞ্চল পুড়ে গেছে। জার্মানির সীমানার চেজ জাতীয় পার্কে ২০২২ সালের ২৪ জুলাই যে আণ্ডনের সূত্রপাত হয় তাতে প্রায় ৫,৬৬১ একর অঞ্চল বিনষ্ট হয়।
ফ্রান্সের দক্ষিণ -পশ্চিম অঞ্চলে যে বনদাহের সূচনা হয় এতে ১৯ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৪৭,৭০০ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ফ্রান্সের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আগের লাগা আণ্ডন তীব্র তাপদাহ এবং খরার কারনে আবারও মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রীসে ১৯ জুলাই তুর্কী সীমানার কাছের লেসবস দ্বীপের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৪,২০০ একর অঞ্চল পুড়ে যায়। ইতালির কারসোতে জুলাই মাসের বনদাহের ফলে প্রায় ৫,০০০ একর অঞ্চল পুড়ে যায়। পর্তুগালের বনদাহে প্রায় ২৪,৭১১-২৯৬৫৩ একর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্পেনে ১৯ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি অঞ্চলে বনভূমিতে দহন চলছিল। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় ১৪ জুলাই লাগা আণ্ডনে প্রায় ২,০০০ একর বনভূমি পুড়ে যায়। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের এম-সি অঞ্চলের বনদাহে ৫৬,০০০ অঞ্চলের বনভূমি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিমের ইউসীমাইট জাতীয় উদ্যানের ওক বনে লাগা আণ্ডনে প্রায় ১৯,২৪৪ একর অঞ্চল ২৬ জুলাই পর্যন্ত পুড়ে গেছে। এর আগে, ২০২১ সালের জুন মাসের শেষ দিকে কানাডার পশ্চিম অঞ্চল, ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং আমেরিকায় উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সুতীব্র তাপদাহের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। কানাডার ইতিপুর্বের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছিল ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, কিন্ত ওই সময় বিট্রিশ কলম্বিয়ার ছোট গ্রাম লাইটনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৯.৬ ডিগ্রি সে. উঠে। একটি সমীক্ষায় গবেষকেরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন এই মারাত্মক তাপদাহটি হাজার বছরের ঘটে যাওয়া একটি বিরল ঘটনা।
আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত কারণে বিশ্ব বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতেও বেশ ঘন ঘন ঘটবে বলে গবেষকদের অভিমত। ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্ব তাপ মাত্রা রেকর্ড শুরুর পর ২০২১ সালের জুন বিশ্বের ৫ম উষ্ণতম জুন, তবে শুধু স্থল ভাগের বিবেচনায় সব চেয়ে উষ্ণ রেকর্ডকৃত জুন।
বিজ্ঞানীদের আশংকা বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার বৃদ্ধি মূলত জীবাশ্ব জ্বালানি- পেট্রোল জাতীয় পদার্থ, কয়লা ইত্যাদির দহন ইতিপূর্বের মডেলের ধারণার চেয়েও বেশি ঘটছে বলে বিশ্ব বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এ ভাবে সীমাহীন ভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়ার পরিবর্তনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ বছর ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। জার্মানিতে স্মরনাতীত কালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় ১০০ এর বেশি লোক মারা গেছে এবং হাজারের বেশি লোক (২০ জুলাই পর্যন্ত) নিখোঁজ রয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, চীন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ মারাত্বক বন্যার প্রকোপে পড়েছে।
গত বছর মার্চের শেষ দিকের বন্যায় অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের মারাত্মক বন্যার
সময় প্রায় ১৮ হাজারের বেশি লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে হয়েছিল।
উইকিপিডিয়ার তথ্যা অনুযায়ী আমেরিকায় বছরের শুরু থেকে ১০১০ টি টর্নেডো সংঘটিত হয়। এই বছরের জুলাই মাসে আমেরিকায় ৩২টি টর্নেডো ঘটে। জুলাই মাসের ২-৪ সময় কালে চীনের দক্ষিণ অঞ্চল টর্নেডো চাবার আঘাতে বিপর্যস্ত হ্য়। ৭ জুলাই কানাডার আলবার্ট প্রদেশে এক মারাত্মক টর্নেডো আঘাত হানে। ১৮ জুলাই একটি টর্ণেডো আমেরিকার মনটানা এবং কানাডার আলবার্ট প্রদেশে আঘাত হানে। ২২ জুলাই একটি মারাত্মক টর্নেডো চীনের হেনান প্রদেশে আঘাত হানা।
এর আগের বছরণ্ডলোর পর্যালোচনা করা যাক। ১৯৭৭ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, সিডর আঘাত হানে। এর ফলে উপকূলীয় ১৭ টি জেলায় ব্যাপক প্রাণহানি, ফসল বিনষ্ট ও সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী সিডরে ১০ হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে।
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট আমেরিকার গালফ অব মেক্সিকো উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হ্যারিকেন ক্যাটারিনার প্রভাবে এক ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে।
বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সাম্প্রতিক কালের টর্নেডো, হারিকেনসমূহের এই তান্ডবণ্ডলো কি কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রলয়ঙ্করী বন্যাণ্ডলো
কেন এত ঘন ঘন সংঘটিত হচ্ছে? এ বছর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে স্মরনাতীত কালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?
আবহাওয়াবিদরা এ জাতীয় ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে বেশ ঘন ঘন এবং আরো প্রচন্ডতা ও তীব্রতার সঙ্গে ঘটতে পারে বলে দীর্ঘ দিন ধরেই আশংকা ব্যক্ত করছিলেন। বিভিন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাস যথা- কার্বনডাইঅক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন, ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন ( সি এফ সি), সালফার হেক্সা ফ্লোরাইড ইত্যাদি গ্যাসের বায়ুমন্ডলে ঘনত্ব ধীরে ধীরে বাড়ার ফলে বিশ্ব আবহাওয়ার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে আবহাওয়াবিদ ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই বিশ্ববাসীকে সজাগ করার চেষ্টা করছিলেন।
গ্রিনহাউজ গাসণ্ডলোর সম্মিলিত ফল প্রভাবে বিশ্ব বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই ৩-৫ ডিগ্রী পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন আবহাওয়া মডেল থেকে ভবিষ্যতবাণী করা হয়েছিল। গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে যেহেতু বিশ্ব বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা বাড়ছে, তাই প্রক্রিয়াটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে সমধিক পরিচিত। অবস্থা পর্য্যবেক্ষনে মনে হচ্ছে প্রক্রিয়াটি ইতিমধ্যেই বেশ ভালভাবে শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে বিশেষত পূর্ব মধ্য উপকূল বেশ কয়েকবার মারাত্মক সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়েছে। ১৯৬০ সালের পর এ জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ্ প্রাণ হারিয়েছে, বিনষ্ট হয়েছে গবাদিপশুসহ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ১৯৭০ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১ লাখ ৩৯ হাজারের বেশী মানুষের জীবন চলে যায়। ১৯৭০ সালের পর ১৯৯১ সালে আরও একটি প্রবল সাইক্লোনের কবলে পড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। আর সাম্প্রতিক সাইক্লোন, সিডরের ধ্বংসজ্ঞের তাজা স্মৃতিতো অনেকেরই মনে।
গ্রিণহাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে বিশ্ব বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা ২-৫ ডিগ্রী সে. বৃদ্বি পেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হবে বলে অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানীই আশংকা ব্যক্ত করেছেন।
আগামী ৭০-৮০ বছরের ভেতর গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় ফলে বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা ৫ ডিগ্রী সে. বেড়ে গেলে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য যে সম্পূর্নভাবে বিনষ্ট হবে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। বিগত তুষার যুগের অবসান হয়েছিল, সম পরিমান অর্থাৎ ৫ ডিগ্রী সে. উষ্ণতা বৃদ্বির জন্য, আর তা ঘটেছিল হাজার হাজার বছর সময় ধরে। অন্য দিকে আগামী ৮০ বছরের মধ্যেই তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রীর মত বাড়লে যে এক মহাদুর্যোগের সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য।
গ্রিণহাউজ গাসণ্ডলোর প্রধান হচ্ছে কার্বনডাইঅক্সাইড। শিল্প যুগের আগের সুদীর্ঘ সময়, হাজার হাজার বছর প্রকৃতিতে এই গ্যাসের ঘনত্ব প্রায় স্থির ছিল – ২৭০ পি পি এম (দশ লক্ষ ভাগে ২৭০ ভাগ), এখন এই পরিমাণ ৪১০ পি পি এম, যা ক্রমশ বাড়ছে।
এখন মানব সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, জীবাশ্ব জ্বালানির দহন, বনভূমির বিনাশ ও অন্যান্য কারনে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যন্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে, বিশ্ব বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। এর ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠদেশের উচ্চতাও ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। এই উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রের পানির নীচে চলে যাবে। মালদ্বীপ ও পৃথিবীর অনেক নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে। এই প্রক্রিয়া থামানো ও বিপরীতমুখী করার জন্য আর দেরী না করে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
গাছপালা থেকে প্রাপ্ত কাঠ নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনও কাঠের ব্যপক ব্যবহার রয়েছে। তাই কাঠ সংগ্রহের জন্য দেশে দেশে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে বিরামহীন ভাবে।
অন্যদিকে বনায়ন বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান হ্রাসে খুব ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদ জগৎ বায়ু মন্ডল থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড, ঈঙ২ গ্রহণ করে সূর্যালোক ও পানির উপসি্হতিতে ফটো-সিনথেসিস বা সালোক-সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। আর মানুষসহ অন্যন্য প্রানীরা শ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড পরিত্যাগ করে। এ ভাবেই ১৭৫০ সালে শিল্প যুগ শুরুর আগে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন-কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভারসাম্য বজায় ছিল।
এখন মানব সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, জীবাশ্ব জ্বালানির দহন, বনভূমির বিনাশ ও অন্যান্য কারনে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যন্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। এই প্রক্রিয়া থামানো ও বিপরীতমুখী করার জন্য বনায়ন খুব ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর জাপানের কিয়োটো শহরে গ্রিনহাউজ গ্যাসসমূহের নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তিতে নতুন বনায়ন তৈরির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী গ্রীন হাউজ গ্যাস, বিশেষত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের উপর ণ্ডরুত্ব দেয়া হয়। বিশ্বের ৮৪ টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তখন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ স্বাক্ষর দানে বিরত থাকে, ওই সব দেশের যুক্তি ছিল, “আমাদের প্রচুর বনায়ন যোগ্য ভূমি রয়েছে, আমরা প্রতি বছর বেশি করে বনায়ন করবো।“ কিন্ত এর পর থেকে প্রায় প্রতি বছর ভয়াবহ দাবানলে ওই সব দেশের হাজার হাজার একর বনভূমির বিনাশ হচ্ছে।
এর পর ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল প্যারিসে জাতিসংঘের তত্বাবধানে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার বৈরী আচরণ রোধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার মার্কিন প্রশাসন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, এই চুক্তিতে আবহাওয়া পরিবর্তন রোধ, খাপ খাওয়ানো এবং এসব কাজে অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা ছিল, কিন্ত ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকা এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই জন কেরিকে তাঁর আবহাওয়া বিষয়ক বিশেষ দূত মনোনীত করেছেন। আমেরিকা ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, বাইডেনের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই প্যারিস চুক্তিতে পুন:যোগদান করে। ২ দিন আগে মার্কিন সিনেটে ক্লীন এনার্জি টেকনোলজির জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়, এটি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ২০৩০ সাল নাগাদ গ্রীন হাউস গাসসমূহের উদগীরন ৫০% হ্রাসের এক উচ্চাভিলাসী পরিকল্পনা।
জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন কানাডার লিবারেল সরকার প্যারিস চুক্তি, আবহাওয়া ও বিশুদ্ধ বায়ু কোয়ালিশন, আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তা এবং অন্যান্য চুক্তি পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ ছাড়াও উন্নয়নশীল দেশণ্ডলোতে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব কর্মসূচিতে সব সময়ই সহায়তা প্রদান করে। এই সরকার একটি পরিবেশ বান্ধব সরকার।
গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে প্রধান ভূমিকা শিল্পোন্নত দেশণ্ডলোর। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ দেশসমূহ থেকে বিভিন্ন প্রটোকলের নির্ধারিত সীমার বেশি গ্যাসের নিঃসরণ হয়। অন্য দিকে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশ থেকে খুবই অপ্রতুল পরিমানে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়ে বায়ুমন্ডলে মিশে। অথচ গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় প্থম সারির শিকার হবে বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ।
মূলকথা হচ্ছে, বিশ্বের ধনী-গরীব, শিল্পে উন্নত-অনুন্নত সব দেশের মানুষই এখন মহাসমুদ্রে প্রায় ডুবন্ত এক জাহাজের যাত্রীদের ন্যায়। গ্রিনহাউজ গাসণ্ডলোর নি:সর৯৯ন দ্রুত হ্রাস করে বিশ্বের বায়ুমন্ডলের তাপ বাড়ার প্রক্রিয়া থামাতে না পারলে ক্যাটারিনা, সিডর এণ্ডলোর মত আরও অনেক হ্যারিকেন, টাইফুন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং প্রলয়ংকরী বন্যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশে আঘাত হেনে চলবে। তাই আর অপেক্ষা করার সময় নেই। বিশ্বের ধনী, গরীব নির্বিশেষে সব দেশকে গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়া হ্রাস তথা গ্লোবাল ওয়ার্মিং হ্রাসের জন্য প্যারিস চুক্তির সব শর্তণ্ডলো যথাযথ ভাবে মানতে হবে, প্রয়োজনে আরও কঠিন শর্তযুক্ত নতুন চুক্তিতে উপনীত হতে হবে। তা হলেই আমরা আমাদের ভবিষ্যতে প্রজন্মের জন্য এক নিরাপদ বিশ্ব রেখে যেতে পারবো – আমরা মানব জাতির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ শঙ্কা মুক্ত করতে পারবো।
প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ গবেষক ও পরিবেশবিদ।