পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য আবারও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ভারতে গিয়ে তিনি বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ‘যা যা করা দরকার’ তাই করার অনুরোধ করেছেন। দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি যেমন দেশের জন্য মর্যাদাহানির কারণ হয়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তি তৈরি করেছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে সরকার। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ ভারত সফরের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য দুই দেশের কূটনীতিকদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী দলের কেউ নন দাবি করে ইস্যুটি এড়িয়ে যেতে চাইলেও তা পারছেন না। কারণ, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির এক নম্বর সদস্য এ কে আব্দুল মোমেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ইস্যুটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
শুক্রবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে সরকারের নয়, তার ব্যক্তিগত বলে ‘আত্মরক্ষার’ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের বক্তব্য বলেই ধরে নেওয়া হয়।
গতকাল শনিবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের নিয়ে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের অপর সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আওয়ামী লীগের কেউ নন। তাই তার এ বক্তব্যে আমাদের দল বিব্রত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ওই অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভা শেষ হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে কথা হয়েছে, সেখানে তিনি মন্ত্রীকে দায়িত্বশীল হয়ে কথা বলার অনুরোধ করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে আবদুর রহমান আরও বলেন, ‘এই বক্তব্যের ব্যাখ্যাটি পররাষ্ট্রমন্ত্রীই ভালো দিতে পারবেন। তবে তার বক্তব্য আমাদের দলের কথা নয়।’
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের ব্যাপারে এখনো কোনো বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে অপ্রকাশ্যে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মোমেনকে বেশ ভর্ৎসনা করা হয়েছে বলে দায়িত্বশীল একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। ওই সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের লাগামহীন বক্তব্য সরকারকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে দেশটিকে অনুরোধ করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এ নিয়ে তখন রাজনৈতিক মহলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ। মানবাধিকার ইস্যুতে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে গত ডিসেম্বরে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে প্রতিবেশী ভারতকে অনুরোধ করার বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী; যা ভারতের জন্য অস্বস্তি তৈরি করে। ওই মাসেই ঢাকা সফরের সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন। জয়শঙ্করের জবাব ছিল, ‘প্রশ্নটা বরং ড. মোমেনকেই করুন।’
সরকারের একজন মন্ত্রী বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাবেন। এই সফরের ঠিক আগে মোমেনের বক্তব্য দুই দেশের সরকারকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তিনি মনে করেন, এ সফরের তাৎপর্য ও গুরুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে যদি মোমেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত যান। তাই সরকার ও দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সফরসঙ্গী হিসেবে রাখা ঠিক হবে কি না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের একজন মন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, মোমেনকে সফরসঙ্গী রেখে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর আরও সমালোচনার জন্ম দেবে। নানা প্রশ্নও উঠবে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের একটি অংশ মনে করছে, ভারত সফরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাদ দেওয়াই উত্তম হবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদে থাকা চারজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এ কে আব্দুল মোমেনকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আর দেখতে চান না। তাকে দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা নিলে ভালো হবে সেই পরামর্শও রেখেছেন তারা। কারণ, এরই মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একাধিক বেফাঁস কথায় সরকার ও আওয়ামী লীগকে বিব্রত হতে হয়েছে। তাকে দায়িত্বে রাখা হলে নতুন নতুন জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও করছেন ওই নেতারা। এই ইস্যুতে তারা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা ভীষণ ক্ষুব্ধ। কিন্তু তারা দল ও সরকারের স্বার্থে মুখ খুলতে পারছেন না। তারা মুখ খুললে তা সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিদেশিদের সঙ্গে নানা দেনদরবার থাকবে। ফলে এই মন্ত্রণালয়ে পরিপক্ব ও রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কূটনীতিতে দক্ষ কাউকে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। সভাপতিমন্ডলীর ওই সদস্য আরও বলেন, সময়-সুযোগ বুঝে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় রদবদলের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। কবে হতে পারে সুনির্দিষ্ট করে ওই নেতা কিছু না বলতে পারলেও জানান, আগামী নির্বাচনের আগেই রদবদল আসবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। দলে সাধারণ সম্পাদক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাপারে যা বলেছেন, সেটাই দলের অবস্থান।
তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় মনে করে, এখন মোমেনকে সরিয়ে দেওয়া হলে লাগামহীন বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়া না নিজের থেকে সরে যাওয়া কোনটি দৃষ্টিকটু হবে না, সেটা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। সরকারের দায়িত্বশীল অন্য একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানায়, মোমেনের ব্যাপারে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে চান না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করতে চান তিনি। এর মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে চায় সরকার।
ওই সূত্রটি আরও জানায়, আগামী মাসের ৫ তারিখ ভারত যাবেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সফরে মোমেন থাকলে প্রতিক্রিয়া কী হবে তা দেখতে চায় সরকার। বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে তাকে ছাড়াই সফর হতে পারে।