লিখেছেন ফরিদুল আহসান সৌরভ
নিরীক্ষণধর্মীতা বিবেচনায় রাশিয়ান আর্ক বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্করণ। কেননা, সিঙ্গেল শটে সমগ্র ফিল্ম ধারণ অর্থাৎ ৯৬ মিনিটের নিরবচ্ছিন্ন এক চলচ্চিত্র নির্মাণের অনন্য কীর্তি গড়ে মুভিটি। শুটিংয়ের সময়ে আরমিতাশ (Hermitage Museum, St petursburg) মিউজিয়ামের ৩৩টি কামরা ব্যবহৃত হয়েছে ছবিতে, যাতে অংশ নিয়েছেন দুই হাজারেরও বেশি অভিনয়শিল্পী। ৩টি লাইভ অর্কেস্ট্রা পারফরমেন্স আর প্রায় তিন হাজার বছরের রাশিয়ান ইতিহাসের পথে টাইম ট্র্যাভেল করেছে এই সিনেমা। অথচ এর সবই হয়েছে কেবলমাত্র একটি সিঙ্গেল টেইকে! এজন্যই বোধহয় রাশিয়ান আর্ককে বলা যেতে পারে ওয়ার্ল্ড সিনেমার লংগেস্ট চ্যাট!
ফিল্মটির ট্যাগলাইনও সায় পাওয়া যায় এ বক্তব্যের— “2000 Actors, 300 years of Russian History, 33 Rooms at the Hermitage Museum, 3 Live Orchestras, 1 Single Continuous Shot!”
রাশিয়ান আর্ক একাধারে ইতিহাস অধ্যয়নের এবং ভার্চুয়াল ট্যুরের। আরমিতাশে রাশিয়ার খ্যাতনামা সব ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচয়ের এক সুবর্ণ সুযোগ সকুরভের এক্সপেরিমেন্টালটি। বলে রাখা ভালো, সেইন্ট পিটার্সবার্গে অবস্থিত আরমিতাশ রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী পুরনো সুদৃশ্য এক জাদুঘর, যা দেখতে প্রতিবছরই লক্ষ লক্ষ টুরিস্ট এখানে বেড়াতে আসেন। সেজন্য রাশিয়ার ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত হবার তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় একে। মুভিতে ইতালিয়ান টুরিস্ট ও লেখক মারকিউস দে কাস্তাইনের সাথে দর্শক ভ্রমণ করে মিউজিয়ামের একেকটি কামরা, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের নানা পাঠ। তবে সেই ইতিহাস অধ্যয়নে ক্রনোলজিক্যাল অর্ডার অনুসরণ করা হয়নি বিধায় কালের অবিন্যস্ততা চোখে পড়ে, যা বোধগম্যতায় খানিকটা জটিলতা তৈরি করে। অনুরূপভাবে ন্যারেটরকে আমরা পর্দায় দেখতে না পেলেও তার দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ান আর্কের ইতিহাসনির্ভর পথে পা বাড়াই। তাতে চমকের পাশাপাশি একধরনের অস্পষ্টতাও সৃষ্টি হয়। যদিও তার বর্ণনাতে উঠে আসে শতবর্ষ আগের জানা-অজানা অধ্যায়। তিনি অদৃশ্য, তিনি অস্পৃশ্য রয়ে যান সমাপ্তি পর্যন্ত।
“In Russia, it is said that freedom knows no price.”
মুভিতে পিটার দ্য গ্রেটকে দেখা যায় তার এক জেনারেলকে হেনস্থা করতে। জানিয়ে রাখা ভাল, এই পিটার প্রথম হলেন সেইন্ট পিটার্সবার্গ (পূর্ব নাম লেলিনগ্রাদ) শহরের প্রতিষ্ঠাতা। পরে তার নামেই শহরের নামকরণ করা হয়। এরপর আমরা ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটকে জরুরিভিত্তিতে টয়লেটের সন্ধান করতে দেখি। তারপর আমরা শাহ অব ইরানের পক্ষ থেকে জার প্রথম নিকোলাসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখপ্রকাশের দৃশ্য পাই। অতঃপর সন্তানাদিসহ আগমন ঘটে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের। একপর্যায়ে জোসেফ স্তালিনের সময়ে আরমিতাশ মিউজিয়ামের সংস্কার ও মেরামতের বিষয়ে মিউজিয়াম পরিচালককে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতেও দেখা যায়। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অধ্যায়ে দেখা মেলে লেলিনগ্রাদের কফিন প্রস্তুতির। সেখানে রুশ সংস্কৃতির নিজস্ব সত্তা নিয়ে কিয়দাংশ আলাপ হয়। ইউরোপিয়ান সংস্কৃতির আগ্রাসন নিয়ে উৎকণ্ঠিত মনের প্রশ্ন জাগে।
“Why do you find it necessary to adopt European culture?”
চলচ্চিত্রে গোটা টিমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কলাকুশলী কাজ করেছেন। মিউজিয়ামের পূর্ব-অনুমতি নিয়ে এবং তা সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ রেখে একদিনেই বিশাল সেট সাজানো, এবং শুটিংযজ্ঞ সম্পন্ন করেন নির্মাতা আলেক্সান্দার সকুরভ ও তার টিম। জার্মান সিনেমাটোগ্রাফার টিলম্যান বাটনার জাদুর ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করেছেন জাদুঘরের আনকাট সৌন্দর্য ও ইতিহাস। যদিও তা প্রথম টেইকে নেয়া সম্ভব হয়নি। প্রথম তিনবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর চতুর্থবারে আসে সাফল্য। ডে-লাইটের বাকি ছিল মোটে চার ঘণ্টা! আর তখন ক্যামেরার ব্যাটারির চার্জে পূর্ণাঙ্গ একটি শট নেয়ারই সুযোগ ছিল কেবল। চলচ্চিত্রের ভিজুয়্যাল কনসেপ্ট এবং প্রিন্সিপ্যাল ইমেজ ডিজাইনের কাজটি করেছেন সকুরভ নিজেই। ডিরেক্টরের ভাষ্যমতে- লিখিত গতানুগতিক চিত্রনাট্য অনুসরণ করা হয়নি ছবিতে। তবে ব্যবহৃত সংলাপ পূর্বনির্ধারিত এবং সুবিন্যস্ত ছিল।
চলচ্চিত্রের কিছু অংশে ভিন্ন ভিন্ন টাইম পিরিয়ডের ব্যক্তিদের একই ফ্রেমে দেখানো হয়েছে। তদ্রূপ, কস্টিউম ডিজাইনেও আধুনিক সময়কার পোশাকের চিহ্ন লক্ষ্য করা গেছে। ক্যাথেরিন দ্য গ্রেটের পরিহিত গাউনের পেছনে জিপ দৃশ্যমান হয়েছে। অথচ জামায় জিপের প্রচলন শুরু হয় তারও অনেক পরে। আবার এক্সট্রা অভিনয়শিল্পীদের অনেকেই ভুলবশত ক্যামেরার এঙ্গেল না বুঝে সরাসরি লেন্সের দিকে তাকিয়েছে। অবশ্য দ্রুততম সময়ে তারা নিজেদের লুক শুধরেও নিয়েছে। কিন্তু সচেতন চোখে ঐ ত্রুটি নজর এড়ায় না। এছাড়া, গার্ড অব অনারের দৃশ্যে ভুল ডিরেকশনে সৈন্যদের মার্চ করে এগোতে দেখা গেছে। ইতিহাসবেত্তাদের কাছে সন্দেহাতীতভাবে দৃষ্টিকটু লাগবে সিনটি। ফলে এর চিত্রনাট্যে ইতিহাসের পর্যালোচনা কতটুকু হলো বা আদৌ যথাযথ হলো কিনা সেই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থেকে যায়। তদুপরি, রাশিয়ান আর্ক প্রকৃতপক্ষে এক্সপেরিমেন্টাল হিস্ট্রিক্যাল ড্রামা নাকি ডকু-ফিকশন তা নিয়েও দ্বিধান্বিত হবার সুযোগ রয়েছে।
ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং মিউজিক এই ছবির গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক। ৩টি লাইভ অর্কেস্ট্রার মনভোলানো সুর-মূর্ছনা দর্শকদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তি। মিউজিক্যাল এ অংশটুকু ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশেষ পছন্দের। এই ভালোলাগা থেকে সাউন্ড ইফেক্টস সৃষ্টিতে রাশিয়ান আর্ককে ফুল মার্কস দেয়া যাবে। মেকআপও হয়েছে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এবং যুগোপযোগী। কস্টিউম ডিজাইনে দুয়েক জায়গায় আধুনিকতার চিহ্ন থাকলেও সামগ্রিকভাবে সময় ধারণের চ্যালেঞ্জে সফলতা দেখিয়েছে তা। আর্টহাউজ ফিল্ম হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক ব্লকবাস্টার তকমা পায়নি এ সিনেমা। কিন্তু তাতেই বা কী! রাশিয়ান আর্ক ঠিকই জায়গা করে নিয়েছিল ২০০২ এর কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। তার ওপর আবার এক শটে ফিল্ম বানানোর কীর্তি গড়ে ইউরোপের বৃহত্তম চলচ্চিত্র আসরে পাম ডি’অর এর নমিনেশনও পেয়েছিল।
রাশিয়ান ফেডারেশনের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আরমিতাশ মিউজিয়ামের যৌথ অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্র রাশিয়ান আর্ক‘-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় এর শুটিংস্পট আরমিতাশ মিউজিয়াম হলে। রিলিজের পরে দেশের অভ্যন্তরে বিশিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা পান নির্মাতা সকুরভ। এমনকি, বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মের দুয়ার প্রসারিত হয়। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে এটি নিঃসন্দেহে বেশ অপ্রচলিত ভিন্নধর্মী ফিচার ফিল্ম। সত্যি বলতে, ভ্রমণ এবং ইতিহাসপ্রেমীদের জন্যে রাশিয়ান আর্ক বাকেট লিস্টে রাখার মতো এক অমূল্য সম্পদ।