প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
প্রতিবারের মতোই এবারও ৫ জুন জাতিসংঘ ঘোষিত কার্যক্রম অনুযায়ী বিশ্ব পরিবেশ দিবস পৃথিবীর ১৫০ টিরও বেশি দেশে পালিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য আমাদের সবার জন্য রয়েছে “একটি মাত্র পৃথিবী”।
জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী উদযাপিত এই দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশের ণ্ডরুত্ব তুলে ধরে এ সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরি করা। এই দিন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃতির অবারিত দান, আল্লাহর কৃপায় প্রাপ্ত সম্পদসমূহকে অপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করে আমরা বিনাশ করতে পারিনা।
১৯৭২ সালে সুইডেনের স্টকহোমে মানব পরিবেশ সংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ প্রতি বছর ৫ জুন “বিশ্ব পরিবেশ দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর দুই বছর পর প্রথম ১৯৭৪ সালে আমেরিকায় দিবসটি প্রতিপালিত হয়।
ওই বছরের প্রতিপাদ্য ছিল-
“Only One Earth”
অর্থাৎ “কেবল একটি মাত্র পৃথিবী”। আমাদের এই বিশ্বের আলো, বাতাস, পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ভাগিদার আমরা সবাই।
এর পর ১৯৮৭ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যায়ক্রমে দিবসটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ২০২১ সাল জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ইকোসিস্টেম বা প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার দশকের যাত্রা শুরু।
৫০ বছর আগে ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে প্রথম “একটি মাত্র পৃথিবী” এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের যাত্রা শুরু। এবারও একই প্রতিপাদ্য নিয়ে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল আয়োজন। ৫ দশক পরও এখনো এটি দ্রুব সত্যি যে এই পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আবাস ভূমি এবং মানব জাতিকে এর সীমিত সম্পদকে সুরক্ষার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। তাই দেশে দেশে কর্ম পরিকল্পনায় পরিচ্ছন্ন, সবুজ এবং টেকসই জীবন যাপনের পদ্ধতি যা প্রকৃতি সহায়ক, সে দিকে জোর দিতে হবে। সুইডেনে এই বছর ইউ এন ই এফ (UNEF) এবং অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় “স্টকহোম+৫০” শীর্ষক একটিআন্তর্জাতিক মিটিং জুনের ২ এবং ৩ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার মূল প্রতিপাদ্য ছিল- “একটি সুস্থ পৃথিবী সবার উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, যা আমাদের কর্তব্য এবং আমাদের জন্য সম্ভাবনার দিগন্ত।
৭ পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বনভূমির বিনাশ রোধ, প্রাকৃতিক ও মানবসমাজের কর্মকান্ডের ফলে প্রতিনিয়ত বিশ্বের আলো, বাতাস, মাটি, পানি, নদী-নালা, নদ-নদী, সাগর দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম গ্রহণ আর অন্য দিকে বনায়ন ও সামাজিক বৃক্ষ রোপন, শহরাঞ্চলের সবুজায়ন, পুকুর, খাল-বিল, হ্রদ, নদীর পানি পরিস্কার ও দূষণমুক্ত করা এবং বাগানের সঠিক পরিচর্চা গ্রহণ ইত্যাদি কর্মকান্ডে ণ্ডরুত্ব দিতে হবে।
সারা বিশ্বে এখন ৩১% বনাঞ্চল রয়েছে। এণ্ডলোর বেশিরভাগই কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া এ সব কয়েকটি দেশে। দক্ষিণ আমেরিকার ছোট একটি দেশ, সূরিনামে বনভূমির শতকরা পরিমান ৯৪%, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
শুধু কানাডাতেই পৃথিবীর মোট বনভূমির ৯% এবং দেশটির ৩৮% বনভূমি ।
বাংলাদেশে সরকারী তথ্য অনুযায়ী সামাজিক বনসহ প্রায় ১৭.৫% বনভুমি রয়েছে, তবে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে দেশে এখন কোন ক্রমেই ৯% এর বেশি বনভূমি নেই। আর এর পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছে এটাই স্বাভাবিক। একটি দেশের ভূমি মূলত কৃষি কাজ, বাসস্থান, বিভিন্ন স্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশের জন সংখ্যা ১৯৭০ সনে যেখানে ৭০ মিলিয়ন ছিল, এখন বেড়ে তা ১৬৭.৮২; মিলিয়নে এসে পৌঁছেছে। এই বাড়তি লোকের খাদ্য উৎপাদন, বাসস্থান এবং অন্যন্য স্থাপনার জন্য জমির প্রয়োজন, তাই বনভূমি বিনাশ পাবে এটিই স্বাভাবিক। বনায়ন এবং বনভূমির বিনাশ কখনও একই গতিতে হয়না। আমাদের দেশের সামাজিক বনায়নের কথাই ধরা যাক। এখনকার শ্লোগান হচ্ছে একটি গাছ কাটলে ৩টি চারা লাগাতে হবে। গাছ কাটা বেশ সহজ, দীর্ঘ দিনের পুরানো একটি গাছ করাত দিয়ে কাটলে যে সময় লাগবে, ইলেক্ট্রিক করাত দিয়ে তারও অনেক কম সময়ে কাটা যাবে। ধরা যাক, ওখানে তিনটি চারা লাগানো হলো, চারাণ্ডলোর সঠিক যত্ন নিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে পানি দিতে হবে।
প্রতিবেশীর- জমি পাশে, গাছ বড় হলে ছায়া দিলে জমির ফসলের ক্ষতি হতে পারে, তাই হয়তো রাতের বেলা ভেঙে দিলো, কিংবা ছেলে পিলেরা নিছক খেলাচ্ছলে চারার ডগা ভেঙে দিতে পারে, ছাগল গরু এণ্ডলোও সুযোগ পেলে চারা খেয়ে ফেলতে পারে। ঝড়ের কারণেও গাছ ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এসবের পর সব চারাই কি বড় হয়?
বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনভূমি। ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই বনভূমি সামুদ্রিক ঝড়, টর্নেডো ইত্যাদির হাত থেকে উপকূলীয় এলাকায় জনগণকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক বর্ম হিসেবে কাজ করে। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সুন্দরী গাছণ্ডলোর কিছু কিছু উপর থেকে মরে যাচ্ছে। একে “আগা মরা” রোগ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আমি বিশ্ব ব্যাংক এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগিতায় পরিচালিত “রেইন্স এশিয়া” নামক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্পে বাংলাদেশের টিম মেম্বার হিসেবে কাজ করেছি। আমরা ওই অঞ্চলের বাতাসে বিভিন্ন সময়ে সালফার ডাইঅক্সাইডের বায়ু মন্ডলীর ঘনত্ব নির্ধারণ করেছি। ফলাফল আমাদেরকে বিস্মিত করে।
আমরা দেখতে পাই, শীতকালে ওই অঞ্চলের বাতাসে সালফার ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব বর্ষা মৌসুমের তুলনায় কয়েকণ্ডণ বেশি। আমরা বায়ু প্রবাহের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, শীতকালে ভারত ও চীন থেকে বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়। ভারত ও চীনে প্রচুর কয়লা পুড়ানো হয়, ফলে এ থেকে প্রচুর পরিমানে সালফার ডাইঅক্সাইডের উদগিরন হয়। ওই সময় বৃষ্টি পাতের পরিমান কম থাকায় বায়ু প্রবাহের সঙ্গে সালফার ডাইঅক্সাইড বাতাসে ভেসে ভেসে অবশেষে সুন্দরবন অঞ্চলে এসে পৌঁছে। অন্য দিকে বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত কম দুষণযুক্ত বায়ু প্রবাহ আসে। সালফার ডাইঅক্সাইড একটি এসিডিক অক্সাইড, এটি এসিড ঘটিত বৃষ্টির অন্যতম উপাদান।
এজন্য সুন্দরবন অঞ্চলে শীত ও বর্ষা মৌসুমে বাতাসে এসিডত্ত্ব -এর পরিমানে বেশ তারতম্য হয় যা সুন্দরী গাছ সহ্য করতে পারে।
সুন্দরী গাছণ্ডলো ম্যানগ্রোভ জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছণ্ডলো মূল ও শিকড়ের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে, আর এ গাছণ্ডলো লবনাক্ত ও মিঠা পানির একটি সুষম পরিমানেই ভাল জন্মে। ভারত উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করার শুরুর পর থেকেই এই অঞ্চলে মিঠা পানি প্রবাহ দারুন ভাবে কমে গেছে এবং পানিতে লবণাক্ততা অনেক অনেক বেড়ে গেছে। আমার তিনজন পি এইচ ডি এবং একজন এম এস ছাত্র ওই অঞ্চলের জলীয় রসায়ন নিয়ে বেশ কাজ করেছে। আমাদের গবেষণা থেকে দেখতে পেয়েছি, উজানে পানি প্রত্যাহারের পর ওই অঞ্চলে লবণাক্ততা পরিমান একশ ণ্ডনেরও বেশি বেড়ে গেছে। তিনটি কারন (১) শীত ও বর্ষায় বাতাসে এসিডত্ব তারতম্য (২) মিঠা পানি প্রবাহ হ্রাস এবং (৩) পানির লবণাক্ততার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, এর ফলেই সুন্দরী গাছের আগা মরা রোগ হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভারতের ঋণ সহায়তায় সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে একটি কয়লা ভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা সুন্দরবন সুরক্ষার স্বার্থে এই প্রকল্প বাতিল করার দাবি করেছে।
কাঠ নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। জ্বালানি হিসেবেও পৃথিবীর অনেক দেশে এখনও কাঠের ব্যপক ব্যবহার রয়েছে। তাই কাঠ সংগ্রহের জন্য দেশে দেশে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে বিরামহীন ভাবে।
উদ্ভিদ জগৎ বায়ু মন্ডল থেকে কার্বনডাইঅক্সাইড, ঈঙ২ গ্রহণ করে সূর্যালোক ও পানির উপসি্হতিতে ফটো-সিনথেসিস বা সালোক-সংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় খাদ্য ও অক্সিজেন উৎপাদন করে। আর মানুষসহ অন্যন্য প্রানীরা শ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড পরিত্যাগ করে। এ ভাবেই ১৭৫০ সালে শিল্প যুগ শুরুর আগে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন-কার্বন ডাইঅক্সাইডের ভারসাম্য বজায় ছিল।
এখন মানব সমাজের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, জীবাশ্ব জ্বালানির দহন, বনভূমির বিনাশ ও অন্যান্য কারনে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ অন্যন্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে, বিশ্ব বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। এর ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠদেশের উচ্চতাও ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। এই উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই বাংলাদেশের প্রায় ১৭ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রের পানির নীচে চলে যাবে। মালদ্বীপ ও পৃথিবীর অনেক নিম্নাঞ্চল সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাবে। এই প্রক্রিয়া থামানো ও বিপরীতমুখী করার জন্য বনায়ন খুব ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর জাপানের কিয়োটো শহরে গ্রীন হাউজ গ্যাসসমূহের নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে নতুন বনায়ন তৈরির মাধ্যমে বিশ্ব ব্যাপী গ্রীন হাউজ গ্যাস, বিশেষত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের উপর ণ্ডরুত্ব দেয়া হয়। বিশ্বের ৮৪ টি দেশ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তখন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ স্বাক্ষর দানে বিরত থাকে, ওই সব দেশের যুক্তি ছিল আমাদের প্রচুর বনায়ন যোগ্য ভূমি রয়েছে, আমরা প্রতি বছর বেশি করে বনায়ন করবো। কিন্ত এর পর থেকে প্রায় প্রতি বছর ভয়াবহ দাবানলে ওই সব দেশের হাজার হাজার একর বনভূমির বিনাশ হচ্ছে।
এর পর ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল প্যারিসে জাতিসংঘের আওতায় বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার বৈরী আচরণ রোধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামার মার্কিন প্রশাসন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, কিন্ত ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আমেরিকা এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। আশার কথা হচ্ছে বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই আমেরিকা আবার প্যারিস চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয়, পৃথিবীর ১% মত ধনী দেশের অধিবাসীরা দরিদ্র দেশণ্ডলোর ৫০% এর বেশি মানুষের তুলনায় বেশি পরিবেশের দূষণ ঘটায়। তবে এই সত্যিকে উপেক্ষা করে হলেও সবাইকে একযুগে বিশ্ব পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে। আমরা সবাই ঝড়ের কবলে পড়া মহাসমুদ্রে ডুবন্ত এক জাহাজের যাত্রীদের ন্যায়, জাহাজ ডুবে গেলে সবাই নিমজ্জিত হবে। এমনি ভাবে আমাদের পৃথিবী, ধীরে ধীরে পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে বিনাশের দিকে এগিয়ে গেলে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই প্রয়োজন সম্মিলিত কার্যক্রম গ্রহণ।
বাংলাদেশে পরিবেশ সচেতনার শুরু বিগত শতাব্দীর আশির দশকের প্রায় শেষ দিকে। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে দেশে সর্ব প্থম পরিবেশ রসায়ন কোর্স চালু করি। প্রফেসর সৈয়দ সফিউল্লাহ ও আমি যৌথভাবে পরিবেশ সংক্রান্ত গবেষণা শুরু করি। ১৯৮৮ সালের বাংলাদেশের প্রলয়ংকরী বন্যার পর প্রফেসর সফিউল্লাহ ঢাকায় “বাংলাদেশে বন্যা” শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এর ফলশ্রুতিতে ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে ঢাকায় পরিবেশ গবেষণার জন্য একটি আন্তর্জাতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সময় “সমীক্ষা” এবং “বাংলাদেশ কোয়েস্ট” নামক দুইটি সাময়িকী প্রকাশিত হয় । আমার “গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া ও বাংলাদেশ” শীর্ষক একটি নিবন্ধ সমীক্ষায় প্রকাশিত হয়। খুব সম্ভবত দেশে এটিই প্থম গ্রীনহাউজ প্রতিক্রিয়ার উপর একটি সাড়া জাগানো নিবন্ধ।
এর পর থেকে আমি ও প্রফেসর সফিউল্লাহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে নিয়মিত পরিবেশ বিষয়ক জনপ্রিয় রচনা লিখতে থাকি এবং এণ্ডলো সংগ্রহ করে পুস্তক প্রকাশিত হয়। আমরা গ্রীনহাউজ প্রীতিক্রিয়া শ্লথকরনে বিশ্বের প্রধান প্রধান নদীণ্ডলো দিয়ে কার্বন প্রবাহের গতি প্কৃতি পরিমাপের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী মোহনা এবং সাগর উপকূলে ণ্ডরুত্বপূর্ণ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করি। ১৯৮৮ সালে আমাদের কার্বন পরিবহন সংক্রান্ত একটি যৌথ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
১৯৯৪ সালে বিট্রেনের ব্রাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় পরিবেশ শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালক প্রফেসর ওয়াল্টার ফিলহো, বৃটিশ ও ডি আই এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমি সম্মেলন সাংগঠনিক কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। এর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্থম পরিবেশ সমীক্ষা কেন্দ্র এবং পরে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের পর একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
আমরা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশ দূষণ সমস্যা, আর্সেনিক দূষণ এবং প্রতিকার এবং সচেতনতা তৈরির জন্যও অনেক ণ্ডরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছি।
ইতিমধ্যেই আমাদের দেশে পরিবেশ সংক্রান্ত বেশ কিছু আইন প্রণীত হয়েছে। তবে এণ্ডলোর সঠিক বাস্তবায়ন হয়না।
পরিবেশ দিবসে আমরা অঙ্গীকার করতে পারি বনভূমির বিনাশ রোধ, নুতন বনায়ন তথা বৃক্ষ রোপন, নদ নদীর পানি দূষণমুক্ত করন, শহরাঞ্চলকে সবুজায়ন করন, এসব কর্মকান্ডে সবাইকে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সচেতনা ও উদ্বুদ্ধকরণ সর্ম্পকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি। আমরা জানি বায়ো- ডিগ্রেডেবল নয় এ জাতীয় পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এ কথা জানা স্বত্বেও শপিং এ যাওয়ার পর এ জাতীয় পলিথিন ব্যাগে কিছু দিলে বাসায় নিয়ে এসে ওই পলিথিন ব্যাগ ডাস্টবিনে ফেলে পরিবেশ দূষণে অনেকেই অংশ নেয়। সচেতন হওয়ার পর নিজে উদ্বুদ্ধ হলে তিনি সেলসম্যানকে এ জাতীয় ব্যাগ ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন আর কোনক্রমেই এ ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়ে আসতেননা।
সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ব্যপকতা লাভ করে। এটি স্নো-বল প্রক্রিয়ার মত। শীতের দেশে যখন তুষারপাত হয়, প্থমে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা পরে, ধীরে ধীরে একটি ক্ষুদ্র কণাকে ঘিরে তুষার কণা জমে বৃহৎ বরফ খন্ড হয়। এমনি ভাবে সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণকে ছড়িয়ে দিয়ে বিপুল জনণ্ডষ্টির মাঝে উদ্বুদ্ধকরণ সৃষ্টি করতে হবে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীরা দুটি কথা বলে ু (১) আমাদের এই পৃথিবী আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে থেকে ধার করে নিয়েছি (২) ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বাসযোগ্য বিশ্ব রেখে যেতে চাই। বিশ্বায়নের এই যুগে, আমরা যে যেখানেই থাকিনা কেন প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশ দূষণরোধে সাধ্যমত অংশ নিতে হবে।
আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য বিশ্ব “আমাদের একমাত্র পৃথিবী” রেখে যেতে চাই, এই হোক এ বারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমাদের সম্মিলিত অঙ্গীকার।
প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিদ।