মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান বাংলার ইতিহাসের বাঁকে লুকিয়ে থাকা মেঘে ঢাকা এক সুর্য। এক সংগ্রামী বীরের উপাখ্যান ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার আন্দলনে জীবন বাজি রাখা বাংলার বীর।
১৭৫৭’ র পলাশী যুদ্ধ পরবর্তী দেশের আকাশে ঘন কালো অন্ধকার মেঘের মাঝে ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার প্রশ্নে এবং এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে যিনি রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান। বিলাসিতার পথে নয় সময়ের ডাকে জীবনের সবটুকু দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি ও আনন্দে গা ভাসিয়ে বিলাসী জীবনে চলতে পারতেন। বাংলার সৌভাগ্য তিনি যাননি সে পথে।
স্বাধীনতাকামীদের জন্য তিনি হয়ে থাকবেন চির দিন স্মরণীয় অনুপ্রেরণা। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৪’র- সাত বছর টানা যুদ্ধের মাঝে ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
পলাশীর বিশ্বাস ঘাতকতা মূলক- যুদ্ধ শেষে ক্লাইভ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের ষড়যন্ত্রের সাথী জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ, রায় দুর্লভ, কেদার রায়দের নীল নকশা আর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় মীর জাফর আলী খানকে করে বাংলার নুতন নবাব। প্রথম পর্বে যা ছিল ৫৭’- থেকে ১৭৬০ তিন বছর পর্যন্ত। ১৭৬০ সালে তারা আরো নত জানু নবাব পেতে- মুসলিম নবাব পরিবারের প্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে খুঁজে আনে জামাই মীর কাসিম আলী খান কে।
চতুর ইংরেজ আর তার ষড়যন্ত্র কারি দেশি চাটুকারদের হিসাবটা এবার ঠিক ঠিক মেলেনি। মীর কাসেম কারো হাতের মোয়া বা গোয়ালের গাধা হতে জন্ম নেননি।
১৭৬০ থেকে ১৭৬৩ তিন বছর ইংরেজ প্রভাবিত পথে আর ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৪ এক বছর বাংলার মানুষের মুকুটহীন নবাব হয়ে, চারটি বছর- ইংরেজের বিরুদ্ধে উপহার দিয়েছেন দেশ প্রেমী, স্বাধীনতা কামি মানুষের পক্ষ থেকে, ইংরেজের- ঘুম হরন করা ৭টি যুদ্ধ।
এণ্ডলি ছিল ১. কাটোয়া ২. মুর্শিদাবাদ ৩. গিরিয়া ৪. উদয়নালা ৫. সুটি ৬. মুঙ্গের এবং সব শেষে বঙ্ার এ। (১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর ) বাংলার বুকে বাঙালির পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এককভাবে তিনিই ছিলেন সব থেকে বেশি যুদ্ধের সংগঠক। এবং একই সাথে ছিলেন নবাবের ভূমিকায় এবং বিদ্রোহী জনতার কাতারে থেকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে ইংরেজ আবারো মির্জাফরকে লোভের টোপ দিয়ে পুতুল নবাব বানায়। এর মাঝে উদ্দেশ্য ছিল মীর কাসিমকে কন্ট্রোল করা এবং মুসলিম নবাবদের রেজিস্টেন্স মুভমেন্ট কে শিকড় সহ তুলে ফেলতে, তাই লোভ দিয়ে ইংরেজ পুনরায় মীর জাফরকে ক্ষমতায় বসায়।
মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান। উদয়নালা ও মুঙ্গের যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন নি। তাই যুদ্ধ শেষে মীর কাসিম পাটনায় চলে যান। তারপর পাটনা থেকে যান অযোধ্যায়। সেখান থেকেই- অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার সঙ্গে এবং দিল্লির দুর্বল মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমেরে সঙ্গে ইংরেজ বিরোধী জোট গঠন করেন।
তাদের সামনে তিনি ইংরেজের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করতে রাজি করান। এই জোট শক্তিতে নয় তবে মরাল বুস্ট আপ গড়ে তুলতে কার্যকরি হয়েছিল। সময়ের প্রেক্ষিতে এটি ছিল দারুন কৌশল। এই তিন নেতা ত্রিপক্ষীয় শক্তিসংঘ গঠন করে ইংরেজদের হাত থেকে বাংলাকে পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হন। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর বঙ্ার এ চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইংরেজ আবারও কুট কৌশলে এবং – বিভেদ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে – এই কাজে নিজেদের কে চ্যাম্পিয়ন প্রমান করেই, প্রায় হেরে যাওয়া – যুদ্ধে জয়ী হয়ে, বাংলা তথা সারা ভারতকে ১৯০ বছরের জন্য গোলামীর জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধ শেষে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ইংরেজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে ফিরে যান এবং অযোধ্যা ইংরেজদের পদানত হয়। আর মীর কাসিম হন নিরুদ্দেশ।
ষড়যন্ত্র কারি এবং ইংরেজ ণ্ডপ্ত ঘাতক থেকে দূরে থাকতেই তিনি এই কৌশল অবলম্বন করেন।
অনেক বোদ্ধা ঐতিহাসিকের মতে বঙ্ারের যুদ্ধের সাফল্য ইংরেজদের জন্য পলাশীর যুদ্ধের সাফল্যের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। এই যুদ্ধ শেষে সত্যিকার ভাবে তারা শক্তপোক্ত হয়ে উপমহাদেশে ক্ষমতার পরিধি বিস্তার করতে সাহসী হয়ে উঠে। তার আগে পর্যন্ত অন্যের মুখে ঝাল খেয়েই তাদের সন্তষ্ট থাকতে হচ্ছিলো। উদ্যোম, স্পৃহা, সামর্থ্য বা দূরদর্শিতা কোনোটারই অভাব ছিলো না নবাব মীর কাসিমের। হয়তো ভাগ্যই তাকে সফলতার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তারপর ও দেশকে বিদেশী শোষণ থেকে মুক্ত করার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবেই নিজেই- নিজেকে একদিন আড়ালে নিয়ে গেলেন। তবে তারপরও আমাদের ইতিহাসে তিনি একজন স্বাধীনতার অনন্য স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবেই গণ্য হবেন।
মুহম্মদ কাসিম আলী খান ও তার পরিচয়।
Mir Muhammad Qasim Ali Khan was the son of Mir Muhammad Razi Khan, and claimed descent from Ali al-Ridha. His paternal grandfather, Syed Husayn Ridhwi, came to the Mughal Empire during the reign of Aurangzeb, who married him to the daughter of Mir Hadi (Shaikh Sulayman Fazail Khan). Ridhwi was conferred the title of Imtiaz Khan, and made the Waqia-navis (Interior Minister) and subsequently the Dewan of Bihar. Qasim’s grandfather also wrote Persian poetry under the pen name of Khalis, and a lengthy diwan is attributed to him.
মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান। মীর জাফর আলী খান ও তার স্ত্রী শাহ খানুম এর মেয়ে নোয়াবজাদী শাহ ফাতিমা বেগমের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন।
সামাজিক ভাবে উভয় পরিবারই সম্ভ্রান্ত উচ্চ বংশ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। বাংলার নবাব হবার আগে তিনি নবাবী বাংলার সেনা দফতর রংপুর ও ফরিদপুরের কমান্ডার বা ফৌজদার ছিলেন। অত্যান্ত যোগ্যতা ও দক্ষতায় দীর্ঘদিন তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থেকে কাজ করেছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ১৭৬০ সালের ২০ অক্টোবর শ্বশুর মীরজাফরকে অপসারণ করে জামাতা মীর কাসিমকে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসায়। সুদক্ষ, যোগ্য ও উচ্চাভিলাষী মীর কাসিম প্রথম সুযোগেই নিজের অবস্থান পোক্ত করায় উদ্যোগী হয়ে ছিলেন। ইংরেজ সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের রাজস্ব তুলবার ভার তাদের হাতে দিয়েছিলেন ।
তিনি ভেবেছিলেন, যেহেতু তিনি ইংরেজ কোম্পানি ও তার কর্মকর্তাদের প্রচুর প্রচুর অর্থ উপ ঢৌকন দিয়েছেন তাই কোম্পানির উচিত হবে তাঁকে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে দেওয়া। কিন্তু কোম্পানির তেমন কোনো অভিপ্রায় ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
নবাব মীর কাসিম সিংহাসনে বসে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে গিয়ে দেখেন, ইংরেজরা সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বিনা শুল্কে অথবা অতি সামান্য শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে এদেশে বাণিজ্য করে যাচ্ছে। ব্যাপারটার শুধু সেখানেই শেষ নয়। নবাব লক্ষ্য করেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী তো শুল্কের সব ফায়দা লুটছেই, সেই সাথে ইংল্যান্ড থেকে আসা সাধারণ ব্যবসায়ীরাও শুধু ইংরেজ বলে কোম্পানীর ভোগকৃত সুবিধাসমূহ ভোগ করে যাচ্ছে।
নবাব মীর কাসিম দস্তক প্রথার পূর্ণ বিরোধিতা করেন।
মীমাংসায় ব্যর্থ হয়ে মীর কাসিম দেশে সকল প্রকার বণিকের শুল্ক প্রদানের ব্যবস্থা রহিত করেন। শুধু নিরীহ বণিকেরাই শুল্ক দেবে, আর ইংরেজরা সব বিনা শুল্কে এদেশে বাণিজ্য করবে, এমন অসম প্রথা তিনি মেনে নিতে পারেন নি।
ক্ষমতায় বসার অনতিকাল পরেই নবাব মীর কাসিম রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তরিত করেছিলেন। সেখানে তিনি একটি স্বতন্ত্র সেনাবাহিনীও গড়ে তোলেন। ইংরেজদের প্রভাবমুক্ত হবার এবং স্বাধীনতার বাসনা তার গোড়া থেকেই ছিলো। ইংরেজদের সাথে শুল্ক নিয়ে বিরোধের জের ধরে মীর কাসিমের জন্য একাধিক সশস্ত্র সংগ্রাম অবধারিত হয়ে পড়ে। বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরও ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে নিজ জামাতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন।
এই জন্য আজ পর্যন্ত মীর জাফর ও বিশ্বাসঘাতকতা সমার্থক হিসাবেই বিবেচিত।
আর মীর মুহম্মদ কাসিম আলী খান বিবেচিত হন স্বাধীনতার অনন্য এক স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে।
মাহবুবুর রব চৌধুরী -টরন্টো, কানাডা
(আহবায়ক-২০০০- উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলন ফোবানা টরন্টো- কানাডা। )