কামাল আহমেদ ,বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে ওয়াশিংটনে গত সোমবার যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতি সবার একটু বাড়তি আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানিবাজার এবং রাজনৈতিক দিক থেকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে সাম্প্রতিক কিছু টানাপোড়েনের পটভূমিতে এ আগ্রহ খুবই স্বাভাবিক; বিশেষ করে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপনের উপলক্ষটি যখন উদ্যাপিত হয়েছে দুই দেশের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠকের মাধ্যমে। এ ছাড়া এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের লেখা চিঠিও বেশ উৎসাহের জন্ম দেয়।
জল্পনা ছিল যে মানবাধিকার প্রশ্নে র্যাব ও তার সাতজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গত ডিসেম্বরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে হয়তো ইতিবাচক আশ্বাস মিলবে। তবে উদ্বেগ ও শঙ্কাও ছিল যে এখনই সে রকম কিছু হবে না। কেননা, কয়েক সপ্তাহ আগেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এটা ‘জটিল ও কঠিন’ বিষয়। এরপর অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ‘গর্হিত কাজ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে।বিজ্ঞাপনবিজ্ঞাপন
নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ওয়াশিংটনের বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু জানায়নি। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন কিছুটা ধারণা দিয়েছেন। তাঁর কথাতেই আমরা জানতে পারছি, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটা একটি প্রক্রিয়াগত বিষয় এবং র্যাবের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহি প্রয়োজন বলে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তিনি কতটা আশাবাদী—এ প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মোমেন বলেছেন, তিনি আশাবাদী। তবে তারপরই যোগ করেছেন, এটাতে তাদের একটা প্রক্রিয়া আছে, সেটা আমাদের শেষ করতে হবে। ‘নানা কমিটি ও ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করতে হয়’ উপলব্ধিটুকু তিনি স্বীকার করে বলেছেন যে এটা সুইচের মতো নয় যে চাইলেই অন আর অফ করা যায়। চার মাসে কোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি বলে আত্মতৃপ্ত হলেই যে সমস্যার সমাধান মিলবে না—এ উপলব্ধিটুকু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা সম্ভবত মেনে নিয়েছেন যে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও অবিচারের অভিযোগগুলোর যে জবাবদিহির কথা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তার একটা গ্রহণযোগ্য পথ যত দ্রুত ঠিক করা যায়, ততই সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
পুরো সংলাপের বিষয়ে আসলে আমরা আব্দুল মোমেনের কথা থেকেই জানতে পারছি; যদিও বৈঠকের প্রথম বিবরণী প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে। তবে ওই বিজ্ঞপ্তিতে শুধু দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হয়। পরের আলোচনা সম্পর্কে তারা আর কিছুই প্রকাশ করেনি। পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই বিবরণীতে দেখা যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিক বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঋণী। কেননা, যখন তিনি রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন ও বেকার ছিলেন, তখন দেশটি তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতিকেরা সেই দেশের ভালো দিকগুলো বলে থাকেন, প্রশংসা করেন। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আব্দুল মোমেন সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতার কথা কিছুটা বাড়িয়ে বলেছেন কি না জানি না। ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার প্রধানকে যুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন একটা ঢং’–এর মতো বেফাঁস মন্তব্য করার গ্লানিমোচনের তাড়নাও হয়তো তাঁর আবেগপ্রবণ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কারণ হতে পারে। তবে তিনি ‘রাষ্ট্রহীন’ ছিলেন—এমন দাবি কেন করলেন, সে প্রশ্ন না করে পারা যায় না।বিজ্ঞাপন
বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য বিদেশিদের উৎসাহিত করলেন না? আমরা কি তাহলে ধরে নেব যে এটি সরকারের নতুন নীতি? কেননা, তাঁর দল এবং সরকার প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে যে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। বিরোধী দলগুলো অবশ্য প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেই এ অভিযোগ বেশি করে অভ্যস্ত।
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনে ২০১৬ সালে কিছু সংশোধনী যুক্ত করার আগপর্যন্ত জন্মসূত্রে নাগরিক—এমন কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে—এমন কোনো নজিরও নেই। এমনকি আমাদের সুপ্রিম কোর্ট যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা যাবে না বলে রায় দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরি করার পর কোনো এক সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন দেশান্তরি হয়েছিলেন। তিনি তখন রাজনীতিতেও ছিলেন না যে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হবেন। কবে ও কীভাবে তিনি রাষ্ট্রহীন হয়েছিলেন, তা জানতে চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে আমি অবশ্য তাঁর কোনো সাড়া পাইনি। তাঁর এই অদ্ভুত দাবির রাজনৈতিক যৌক্তিকতা আমরা বুঝতে অক্ষম।
আরও চমকপ্রদ খবর হলো বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রথম আলোতেই কূটনৈতিক সংবাদদাতা লিখেছেন, সোমবার রাতে ওয়াশিংটনে মার্কিন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ও নির্বাচনের তাগিদ দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়ার মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। সে কারণে বিএনপিরও নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রয়োজন। বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যও চান তিনি।আরও পড়ুনসুবর্ণজয়ন্তীর রূপকল্প ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়ে তিনি কি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের জন্য বিদেশিদের উৎসাহিত করলেন না? আমরা কি তাহলে ধরে নেব যে এটি সরকারের নতুন নীতি? কেননা, তাঁর দল এবং সরকার প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে যে পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে। বিরোধী দলগুলো অবশ্য প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেই এ অভিযোগ বেশি করে অভ্যস্ত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের এ অনুরোধ বিশেষভাবে বিস্ময় জাগায় এ কারণে যে দুই বছর আগে তিনিই বলেছিলেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকেরা ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ (আচরণবিধি) মেনে চলতে না পারলে তারা নিজ দেশে চলে যাক (‘“কোড অব কন্ডাক্ট” না মানলে চলে যান, কূটনীতিকদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী’, সমকাল, ৩০ জানুয়ারি ২০২০)। তখনো উপলক্ষ ছিল নির্বাচন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে কিছু বিদেশি কূটনীতিক ব্রিটিশ হাইকমিশনারের বাসভবনে একটি বৈঠক করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হলে তিনি কূটনীতিকদের এই পরামর্শ দেন। গত বছরেও তিনি বলেন, বিদেশি লোকগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে, এটা একটা তাজ্জবের জায়গা। আর আপনারা মিডিয়াও এসবের কাভারেজ দেন (‘আমাদের দেশ একটা তাজ্জবের দেশ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী’, প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০২১)। ওই সব লোক এখানে এসে মাতব্বরি করবে কেন। আমাদের তো তাদের পাবলিসিটি দেওয়া বন্ধ করা উচিত।
বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের তদবির অথবা মধ্যস্থতা কোনটা চাইছেন তিনি, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের কথায় তাদের রাজনৈতিক নীতি ও করণীয় ঠিক করবে কি না, সেটা দলটির নেতারাই ভালো বলতে পারবেন। বিএনপির সঙ্গে সরাসরি নিজেরা আলাপ না করে ভিনদেশি একটি শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা কতটা যৌক্তিক—এ প্রশ্ন দেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে নিশ্চয়ই তোলা যায়। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে নিয়ে যাওয়ার দায় যেহেতু সরকারের, সেহেতু গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর দায়িত্বও তাদেরই।
আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ ও স্বচ্ছ হয়, জনগণ যাতে নিজেদের মতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য ভোটে অংশ নিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রও তার ওপরই জোর দিচ্ছে। কিন্তু সেই অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার এবং কার্যকর ও স্বাধীন কমিশনের প্রশ্নগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টায় মনোযোগী না হয়ে বিদেশিদের সাহায্যপ্রার্থী হওয়া কোনো কাজের কথা নয়, বরং তা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।