বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বাড়ি কেনায় দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কানাডার সরকার। মূলত লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখী আবাসন খাত নিয়ন্ত্রণে এমন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাস্টিন ট্রুডোর সরকার।
এদিকে কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড চলতি অর্থবছরের জন্য ফেডারেল বাজেট ঘোষণায় আবাসন খাত সংক্রান্ত কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। গৃহায়ণ খাতে রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে বাজার সম্পর্কে জনসাধারণে চলতি ধারণা এবং চাহিদার মধ্যে একটি সমন্বয় আনতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, বিদেশিদের বাড়ি কেনার ওপর দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি এক বছরের মধ্যে বাড়ি বিক্রি করতে চাইলে উচ্চ হারে কর দিতে হবে বলে জানানো হয়েছে। অবশ্য স্থায়ী বাসিন্দা এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই দুই পদক্ষেপের ক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রমের সুযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বাজেটে নতুন আবাসনের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ এবং আবাসন খাতে কানাডীয়দের সহায়তার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্ট এবং প্রথমবার যারা বাড়ি কিনছেন তাঁদের জন্য কর ছাড়ের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
গত বছর আবাসনের মূল্য ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এই খাতে হঠাৎ এই উল্লম্ফন নিয়ে বেশ চাপে রয়েছে সরকার। যেখানে বাড়ি দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ভাড়াও হু হু করে বাড়ছে।
মহামারির শুরু থেকে কানাডার গৃহায়ণ খাতে আগুন লেগেছে। দুই বছরের মধ্যে বাড়ির দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এর পেছনের কারণ নিয়ে নানা তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে— সরবরাহ সংকট, বহু বছর ধরে নিম্ন সুদহার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শহরতলী এবং শহরের বাইরে বিত্তবান অধ্যুষিত এলাকার সম্প্রসারণসহ আরও কিছু কারণ রয়েছে।
কানাডার গৃহায়ণ খাতে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছে। মহামারিতে সেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। কানাডিয়ান রিয়েল এস্টেট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের নভেম্বরের মধ্যে কানাডায় সাধারণ বাড়ির দাম ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। গড়ে ৭ লাখ ৮০ হাজার ৪০০ ডলারে বেচাকেনা হয়েছে তখন। অনেক শহরেই এখন বাড়ির গড় দাম ১০ লাখ ডলারের ওপর। রয়্যাল ব্যাংক অব কানাডার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩১ বছরের মধ্যে কানাডায় বাড়ির মূল্য এখন সবচেয়ে বেশি।
কানাডায় গৃহায়ণ খাতের এই পরিস্থিতির জন্য বিদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা অর্থের স্রোত সামলাতে সরকারের ব্যর্থতাকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। কানাডা এখন বিশ্বের অন্যতম ট্যাক্স হেভেন। এ দেশ কালো টাকার স্বর্গ এবং সম্পদ গোপনকারীদের নিরাপদ আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং পর্যবেক্ষকেরা সরকারের এই ব্যর্থতার সমালোচনা করে আসছেন বহুদিন ধরেই। বিশেষ করে মর্টগেজ ব্রোকার, ঋণ দাতা, গৃহায়ণ বিনিয়োগ তহবিল, রিয়েল এস্টেট মালিক, ডেভেলপার এবং আইনজীবীদের বিধিবদ্ধ নিয়মের মধ্যে আনতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি২০-এর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধী একটি প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থতার কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বরাবরই কানাডাকে সেই সূচকের তলানিতে রাখছে।
সর্বশেষ ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক গ্লোবাল ফিন্যানসিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) মানি লন্ডারিং ইস্যুতে নানা দিক থেকে কানাডার ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেছে। তারা দেখিয়েছে, শুধু ২০১৮ সালেই ৪ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার কানাডায় মানি লন্ডারিং হয়ে প্রবেশ করেছে। কানাডার রিয়েল এস্টেট খাতের মাধ্যমে যে পরিমাণ মানি লন্ডারিং হয় তার অর্ধেকই আসে বাইরের দেশ থেকে। আর রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ মানি লন্ডারিংয়ের অর্ধেকই আসে মাদক কারবার থেকে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিদেশিদের দুই বছর বাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা গৃহায়ণ খাতে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সহায়ক হতে পারে। তবে এ পদক্ষেপ তখনই কার্যকর হবে যদি সরকার লেনদেনের তথ্য গোপন প্রতিহত করে এবং প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যেন তাদের প্রক্সি, ট্রাস্ট এবং বেনামি কোম্পানি বা বৈদেশিক সংস্থার মাধ্যমে তথ্য গোপন করতে না পারে। কানাডা সরকার অবশ্য এ ধরনের সম্পদের একটা হিসাব উন্মুক্ত করার কথা বলেছিল। তবে এখনো তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি।