মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ আবুল কাসেম ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজসেবক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তমদ্দুন মজলিস, সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা এবং বাঙলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি ১৯২০ সালের ২৮ জুন, চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার ছেবন্দী গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।
এদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গণের এক বিরল ব্যক্তিত্ব হিসাবেই তার আবির্ভাব। ছোট বেলা থেকেই প্রাণবন্ত জীবনের অধিকারী মেধাবী এক মানুষ।
১৯৩৯ সালে তিনটি বিষয়ে লেটার সহ “বরমা ত্রাহি মেনকা উচচ বিদ্যলয়” থেকে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এবং তখন বৃত্তি ও পান। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি, ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এস-সি (অনার্স) এ, দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। এবং ১৯৪৫ সালে এম.এস-সি তে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন আর থিসিসে হন প্রথম। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ সত্যেন বসুর অধিনে তিনি তার থিসিস সম্পাদনা করেন। ইংল্যান্ডের একটি জার্নালে থিসিসটি ওই সময় সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। প্রভাষক হিসাবে তিনিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ক্লাস নেন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ৭ বছর তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন।
তিনি ছিলেন প্রতিভাবান শিক্ষক, লেখক, সংগঠক এবং রাজনীতিবিদ। ইসলাম ও মুসলিম কৃষ্টি, তাহজীব, তমুদ্দুন, রাজনীতি এবং শিক্ষা ও বিজ্ঞানের পাঠ্যবই সহ প্রায় ১০০টি বই রচনা করেন। এর মধ্যে ৪০টি পদার্থবিদ্যার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই।
ভাষা সৈনিক হিসাবেই দেশের মানুষের কাছে, তার সব থেকে বড় পরিচয়। ‘তমদ্দুন মজলিস’ ও বাংলা ভাষা আন্দলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক, ছিলেন তিনি। এই সময় ‘তমদ্দুন মজলিস’ সংগঠন করেন এবং তিনিই ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ২৯ নং আজিমপুরে ‘তমদ্দুন মজলিস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সূচনা কালে আজিমপুর ও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রশীদ বিল্ডিংয়ে ছিল তমদ্দুন মজলিসের অফিস ও বাংলা ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র।
পরবর্তীতে এই আন্দলন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে তীব্র গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি পথ তৈরিতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
OliAhad, in his book “JatiyoRajniti: 1945-75” wrote, “Abul Kashem and Nurul Haque Bhuiyan, professors of the Physics and Chemistry departments of the Dhaka University, formed the Pakistan Tamaddun Majlish on 1 September 1947 in an attempt to transform the simmering dissent among masses into an organised discipline. The newly formed Tamaddun Majlish laid the foundation of the language movement.”
ভাষা গবেষক এম এ বার্ণিক তার ৭৮৩ পৃষ্ঠার, ‘জাতীয় পুনর্জাগরণে তমদ্দুন মজলিস’ গবেষণা গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রিয়া ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, আর তমদ্দুন মজলিসই সেই প্রক্রিয়ার ধারা সূচনা করে ছিল।
১৯৪৭ সনের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির এক মাসের মাথায় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ এ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ আবুল কাসেমের উদ্যোগে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৪৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্র ভাষার দাবীতে আবুল কাসেমের নেতৃত্বে সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয়। যা ১৮ নভেম্বর ১৯৪৭, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় স্বাক্ষরকারীগণের নামসহ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রথম প্রতিবাদ সভা আয়োজন করে ‘তমদ্দুন মজলিস’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১১৪ দিনের মধ্যে এ দাবী তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ততটা সুখকর ছিল না। কারন এই বিষয়টিতে ক্ষমতাসীন মহলের অভ্যন্তরেই মত পার্থক্যের সূচনা করে।
এরপর আন্দলনকে বেগবান করতে এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তা পৌঁছে দিতে তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্র হিসেবে, মোহাম্মদ আবুল কাসেম সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
এই পত্রিকাটি ১৪ নভেম্বর ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এবং ১৫ মার্চ ১৯৪৮ তৎকালীন প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এই বিষয়টির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং রূপকার ছিলেন তিনি।
সে সময় তিনি এবং তমদ্দুন মজলিশের নেতৃস্থানীয় সদস্যরা উপলব্ধি করেন, যে রাষ্ট্রীয় আদর্শের কথা বলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, পাকিস্তান সে আদর্শে পরিচালিত হচ্ছে না। এর ফলে তারা মুসলিম লীগ থেকে সরে যান। তারপর মুসলিম আদর্শ সামনে রেখে তারা ১৯৫২ সালে আবুল হাশেমের নেতৃত্বে তাকে সভাপতি করে গঠিত হয় খিলাফতে রব্বানী পার্টি।
আধুনিক অগ্রসর চিন্তার সাথে ইসলামী কৃষ্টি চিন্তার সংমিশ্রনে প্রোগ্রেসিভ কনজারভেটিভ ধাঁচের নুতন একটি দল। আবুল হাশেম এবং আবুল কাশেম মনে করতেন, এরমাঝেই সমস্যা সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা যুক্ত ফ্রন্টকে সমর্থন করেন।
আবুল কাশেম যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া-বোয়ালখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য হিসাবে, ১৯৫৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর তিনি প্রাদেশিক পরিষদে সর্ব প্রথম সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ও সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলা চালু করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা তখন ওই পরিষদে সর্ব দলীয় ভাবে এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহীত হয়।
ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ আবুল কাশেম ঢাকায় ১৯৬২ সালে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার ফলে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভের দ্বার উন্মুক্ত হয়। তিনি দীর্ঘ উনিশ বছর (১৯৬২-১৯৮১) বাংলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এবং নিছক নাম মাত্র বেতনে তিনি প্রিন্সিপাল হিসাবে তার প্রতিষ্ঠিত কলেজে কাজ করেছেন।
জীবনে বেশ কিছু সম্মাননায় তিনি ভূষিত হয়েছেন তার মধ্যে পাকিস্তান রাইর্টাস গিল্ড পুরস্কার (১৯৬৪), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (১৯৮৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৩), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৮) এবং জাতীয় সংবর্ধনা স্বর্ণপদক (১৯৮৯) উল্লেখ্যযোগ্য।
তার লিখা গ্রন্থ সমূহের মাঝে বিশেষভাবে আলোচিত : পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (১৯৪৭), একমাত্র পথ (১৯৪৯), ঘোষণা (১৯৫২), বিবর্তনবাদ (১৯৫২), ইসলাম কি দিয়েছে এবং কি দিতে পারে (১৯৫২), মুক্তি কোন পথে (১৯৫২), শ্রেণি সংগ্রাম (১৯৫৩), একুশ দফার রূপায়ন (১৯৫৫), দুটি প্রশ্ন (১৯৫৫), শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি (১৯৫৫), সংগঠন (১৯৬৪), আধুনিক চিন্তাধারা (১৯৬৪)
ইসলামী রাষ্ট্রনীতি, কুরআনের অর্থনীতি, বিজ্ঞান সমাজ ও ধর্ম, Islam Science and Modern Theory, বিজ্ঞান বস্তুবাদ ও আল্লাহর অস্তিত্ব, সৃষ্টিত্ত্ব ও আল্লাহর অস্তিত্ব।
Universal Ideology in the light of Modern Thought.
প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ আবুল কাসেম (২৮ জুন ১৯২০ – ১১ মার্চ ১৯৯১) তার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষের মনে থাকবেন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় চিরদিন।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(কনভেনর: উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলন ২০০০, টরন্টো , কানাডা।)