মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
পরাধীন মুসলিম বাংলার অন্ধকার ঘন কালো আকাশে একদিকে বিদ্যুৎ ঝলকে চমক দেওয়া অন্য দিকে মেঘে ঢাকা তাঁরার মত প্রায় বিসৃত ইতিহাসের উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ। আজ অবধি জাতী তার অবদানের সঠিক মূল্যায়নের অপেক্ষায়। মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বাংলার এক বিপ্লবী বীরের নাম। প্রাণবন্ত, কর্মবীর, চৌকস, অদ্বিতীয় বাগ্মী, প্রেরণা উদ্দীপক, সমাজ সেবী বাংলার এক উজ্জ্বল মুখ। পরিবার, জন্ম স্থান, বাল্যকাল, শৈশব, শিক্ষা, কর্ম, সমাজ কল্যাণ, সমাজ সংস্কার, শিল্প, সাহিত্য, কৃষ্টি কালচার, ধর্ম চিন্তা, বক্তব্য, বক্তৃতা সব কিছুই এই কর্ম বীরের অমর গাঁথা। তাকে জানতে তার পরিবার, তার পরিবেশ, জন্ম এবং জন্ম স্থান সর্ম্পকেও কিছু কথা জেনে নেওয়া ভাল।
তার পিতা এবং মাতার উভয় পরিবারই ছিল অভিজাত, মর্যাদাবান খান্দান, সম্মানী, ধর্ম পরায়ণ, ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পারিবার থেকে আসা।
তৎকালীন কলোনিয়াল শাসন আমলে পরাধীন মুসলিম বাংলায়, বাংলার আর দশটি সচ্ছল, অভিজাত মুসলিম পরিবারের মতোই তাদেরও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এবং দারিদ্রতার সীমানায় পৌছে যাওয়ার সেই একই ইতিকথার ইতিহাস। তাদের পরিবারের উপরও দুর্ভাগ্য হয়েই তা নেমে এসেছিলো।
বেনিয়া ইংরেজ, মুসলমানের হাত থেকে শুধু মাত্র রাজ্ ক্ষমতা ছিনতাই করেই থেমে থাকেনি! তাদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির শিকার হয়ে বাংলার মুসলমানের মান, সম্মান, প্রতিপত্তি, সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তিও তচনচ হয়ে গিয়েছিলো। শত, সহস্র মুসলিম পরিবারকে সেদিন অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ে হত দারিদ্রতার মাঝে খাব্বি খেতে হয়েছে। সে আর এক নিষ্ঠুর ইতিহাস। আজকের দিনে সে পরিস্থিতি বুঝে উঠাটাও তত সহজ নয়। ঝোড়ো কাল বৈশাখীর সে হাওয়া মুন্সি পরিবারের উপর দিয়েও বয়ে গিয়েছিলো। দারিদ্রতা নিয়ে কথা বলতে অনেকেই ভুলে যাই পর্দার অন্তরালের সে দুর্ভাগা কাহিনী।
মুন্সি মুহাম্মাদ মেহেরুল্লাহ জন্ম ১৮৬১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর- অবিভক্ত যশোর জেলার ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থানার মোবারকগঞ্জ এর- বারোবাজারে নানা বাড়িতে। দাদা বাড়ি যশোর শহর থেকে চার মাইল দূরে ছাতিয়ানতলা। পিতা মুন্সী মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তাদের পূর্ব পুরুষরাই ছিলেন ছাতিয়ানতলা গ্রামের আদি বাসিন্দা। জন্ম স্থান এবং পরিবার পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব সবার জীবনেই কিছু থাকে।
যশোর উপমহাদেশের একটি পুরাতন জেলা। আর বাংলাদেশের প্রথম জেলা শহর। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার যশোরকে জেলা হিসেবে ঘোষণা দেন। (Tilman Henckell (1781-1789) was the first District Magistrate of Jessore.) এক সময় যশোর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। তখন যশোরের নাম ছিল যশোর রাজ্য বা যশোরাদ দেশ। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোরই বাংলাদেশের প্রথম মুক্ত জেলা। দা ব্রিজ অন দা রিভার কাওয়াই এর মত (The Bridge on the River Kwai the epic war film directed by David Lean)। যশোরের স্মৃতি বিজড়িত, স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন সময় এলেন গিন্সবার্গ এর ‘সেপ্টেম্বর অন যশোহর রোড’- কবিতাটিও বিশ্ব জনমনে ব্যাপক সাড়া তুলেছিল। (“September on Jessore Road”: By ALLEN GINSBERG.)। এক সময় এই যশোহরের প্রবেশ পথে লিখা থাকত।
খজ্জুর বীথি, নারকেল তরু,
পথ ঘাট মনহর।
কীর্তি মহান – সীমান্ত জেলা,
আমাদের যশোহর।”
দেশের পুরাতন সেনা ছাউনি, এয়ার বেস, এয়ারপোর্ট, শিক্ষা বোর্ড। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা শহরও এই যশোর।
অপর দিকে মায়ের বাড়ী ঝিনাইদহে কালীগঞ্জ উপজেলার মোবারকগঞ্জ এর বারবাজার। এই বারবাজারও একটি প্রসিদ্ধ স্থান। একসময় এটি ছিল সমতট এবং গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজধানী বারবাজার থেকেই প্রখ্যাত গাজী কালু মোহাম্মদ বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। (Gazi Mohammad Kalu , was the son of Shah Sekandar Ali. He emerged in the seventh century as ‘Gazi Pir’, a Muslim holy man. Gazi Pir actively encouraged religious harmony in Bangladesh.)
গাজী-কালু-চম্পাবতী স্মৃতি বিজড়িত বারোবাজারে এখনো স্মৃতি’র নিদর্শনস্বরূপ অনেক কিছুই আছে। (এখানে এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলা, ইংরেজ আমলেই ব্যপক ভাবে মুসলিম নাম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বলার রেওয়াজ শুরু করা হয়।) হযরত খানজাহান আলী রহমাতুল্লাহ আলাইহেও এই বার বাজার থেকেই ইসলাম প্রচার এর শুভ সূচনা করেন। এবং পরবর্তীতে তিনি বাগেরহাট যেয়ে খলিফাবাদ নামে সেখানে একটি ইসলামী হুকুমাত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেন ।
ঐতিহ্যশীল বারবাজার গ্রামটিই তার জন্ম স্থান, বাল্যকাল, শৈশবের অনেক ণ্ডলি দিন এখানেই কেটেছে। দুঃখ জনক হল! মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ তার পিতাকে হারান। পিতার মৃত্যুর পর শিক্ষিত, বিদুষী, তেজস্বীনি মাতা, বি আম্মা বেগমের মতই, মেহেরুল্লার শিক্ষা, দীক্ষার দায় ভার দায়িত্ব কর্তব্য, সমস্ত কিছু নিজ হাতে তুলে নেন। পিতার মৃত্যুর কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিছুটা বিঘ্নিত হলেও মায়ের অনুপ্রেরণায় সাফল্যের সাথেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন।
প্রাইমারি স্কুল শেষে তিনি মৌলানা মোহাম্মদ মোস্হাব উদ্দীন এবং মৌলানা মোহাম্মদ ইসমাইলের নিকট একটানা কঠোর পরিশ্রমের সাথে তিন বছর আরবি, ফার্সি এবং উর্দু শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্ররিশ্রমী, মেধাবি মেহেরুল্লাহ এই তিনটি ভাষা দক্ষতার সাথে রপ্ত করেন।
এই সময় কবি শেখ সাদীর পান্দেনামা, বুস্তা ও ণ্ডলিস্থা তিনি প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছিলেন। তিনি ইংরেজিও সুন্দরভাবে বলতে ও লিখতে পারতেন তবে এটি কি ভাবে, কার থেকে শিখেছিলেন তা জানা যায়নি। শিক্ষা জীবন থেকেই তিনি নিয়মিত বিভিন্ন উর্দু ও ইংরেজি পুস্তক, সাময়িক পত্র-পত্রিকাদি পড়াশোনা করতেন। তার মাঝে ছিল প্রচন্ড জানার আগ্রহ ও জ্ঞান পিপাস। আর ছিল মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণা।
শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দূরদর্শী মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ একটি কাপড়ের দোকানে সেলাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। এরপর ‘সাহেব বাড়ীর দর্জি’ জন মির্জা বকস্ থেকে উন্নত মানের ইউরো স্টাইলের কোর্ট প্যান্ট বানানও শিখে ফেলেন। সব কাজ দ্রুততায় শিখে ফেলার গড গিফটেড মেধা নিয়েই তিনি জন্মে ছিলেন। এত ণ্ডলি কাজ একই সঙ্গে এই বয়সে কি ভাবে ম্যানেজ করতেন তা ছিল অনেকের কাছেই এক বিস্ময়।
অনেক অল্প বয়সেই যশোর কালেক্টর অফিসে জব নেন তিনি। ইন্টারভিউ তে তাকে অমননিত হয়েছেন বলা হলে তিনি জানতে চান কেন তিনি বাদ পড়ছেন? ডি সি (কালেক্টর /মেজিস্ট্রেট) সাহেব বলেন, কারন তার এই জবের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। মেহেরুল্লাহ বলেন স্যার আপনি যখন জীবনের প্রথম জবে যান তখন কি আপনার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল ?
পরিশেষে চাকুরিটি তিনি পেয়ে যান। প্রায় দু বছর দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখিয়েই তিনি চাকুরী করেন। ইস্তফা পত্র দিলে ডিসি সাহেব মেহেরুল্লাহ কে ডেকে জানতে চান, মেহেরুল্লাহ চাকরিটি ছাড়তে কেন চাও? জবাবে মেহেরুল্লাহ বলেন স্যার এবার আমি আমার কিছু পূর্ব অভিজ্ঞতা পরখ করতে চাই।
যশোর শহরের কেন্দ্র স্থল দড়াটানা রোডে তিনি তখন একটি কাপড়ের দোকান দেন। অতি দ্রুতই ব্যাবসায়িক সফলতা পান। আর্থিক সফলতার পাশা পাশি তিনি সামাজিক সফলতাও অর্জন করেন। দোকানটি হয়ে উঠে শহরের নাগরিক মিলন কেন্দ্র। একমাত্র স্থান যেখানে বসে দেশি, গোরা সবাই গল্প, আড্ডায় মেতে উঠতে পারত। আর পারত, আদার বেপারীও জাহাজের খবর নিতে। ডিসি সাহেব ও তার দোকানের শুভাকাঙ্খী এবং খরিদ্দার ছিলেন। পরবর্তীতে ডিসি সাহেব যখন দার্জিলিং বদলি হয়ে যান তার উৎসাহে মুন্সি মেহেরুল্লাহও সেখানে যান এবং আরও একটি কাপড়ের দোকান খুলেন।
এখানেও তিনি সফল হন। কাজ কর্ম, ব্যবসার মাঝেও কখোনোও তিনি পড়াশুনা, জ্ঞান অন্নেষণ, থেকে বিরত থাকেননি। তদ্রুপ সমাজ ও দেশ চিন্তা থেকেও থাকেননি দূরে। তার জীবন দর্শন এবং চিন্তা ভাবনার মাঝেই এই ছোয়া পাওয়া যায় তার লিখা এই কবিতাটিতে ও।
ভাব মন দমে দম, রাহা দূর বেলা কম
ভুখ বেশী অতি কম খানা।
ছামনে দেখিতে পাই পানি তোর তরে নাই
কিন্তু রে পিয়াসা ষোল আনা !
দেখিয়া পরের বাড়ী জামা জুতা ঘোড়া গাড়ি
ঘড়ি ঘড়ি কত সাধ মনে,
ভুলেছ কালের তালি, ভুলেছ বাঁশের চালি,
ভুলিয়াছ কবর সামনে।
সংসারের ধন-জন বংশ মর্যাদাও কবরে একদিন বিলীন হবে এই ভাবনাটিই এই কবিতায় সুন্দর করে প্রস্ফূটিত করে তুলেছেন তিনি। পরিশেষে সবদিক বিবেচনা করে তিনি আবার দার্জিলিং থেকে যশোরে ফিরে এলেন। সিদ্ধান্তটি নেবার আগে তাকে ভাবতে হয়েছে। সম্পদ অর্জন না সামাজ সেবার সাথে ধর্মীয় প্রচার কর্ম। মূলত এ দুটি চয়েস এর থেকে একটি পিক করবার প্রশ্ন তার সামনে এসেছে। তিনি নির্দ্বিধায় অর্থ প্রাচুর্যের অপশন রেখে কঠিন পথটিই সেদিন বেছে নিয়েছিলেন। জাতীয় স্বার্থে।
মুনশী মেহের উল্লাহ সময় পেয়েছিলেন খুব কম। মাত্র ৪৬ বছর। তিনি অল্প সময় পেলেও তার প্রখর সময় চেতনাকে কাজে লাগিয়ে অসাধারণভাবে অজস্র কর্মধারার মাঝে সেই অল্প সময়কে পরিপূর্ন ভাবে কাজে লাগিয়ে ছিলেন।
অসাধারণ প্রজ্ঞা ও প্রতিভার বলে কম্পরেটিভ রিলিজিওন-এ ব্যাপক ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন, নিখিল ভারত ইসলাম প্রচার সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হতে পেরেছিলেন। ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠনে যে ক’জনের ভূমিকা স্মরণযোগ্য তিনি তাদের মধ্যেও একজন ছিলেন। ইংরেজ শাসনামলে খ্রিস্টান মিশনারিণ্ডলোর দৌরাত্ম্য রুখে দিতে নিজেই উদ্যোগী হয়েছিলেন। ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতেন, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে। স্বপ্ন পুরীর দ্বার প্রান্তে এসেও পরিনত বয়সে ইউটার্ন নিয়েছিলেন শুধু মাত্র দেশ, জাতি ও ধর্মের কারণেই। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন, শেখ ফজলল করিম- এঁদের পৃষ্ঠপোষক এবং প্রেরণাদাতা ছিলেন মুনশী মেহের উল্লাহ। মুসলমানদের মধ্যে বিরাজিত মতানৈক্য এবং বিরোধ নিরসন এবং পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির উর্ধ্বে ওঠে ঐক্যের পতাকাতলে সবাইকে সমবেত করতে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।
মুনশী মেহের উল্লাহ হাজারো কাজের মাঝে থেকেও সময় বের করে, সুচিন্তা ও মেধা ভিত্তিক ১২টি গ্রন্থ রচনা করেন। আর তা হল ১. জীবন ও কর্ম, ২. খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মের অসারতা, ৩. রদ্দে খ্রীষ্টিয়ান ও দলিলে এছলাম, ৫. মেহেরুল এছলাম, ৬. সাহেব মুসলমান (অনুবাদ), ৭. পান্দেনামা (অনুবাদ), ৮. খ্রীষ্টান মুসলমান তর্কযুদ্ধ, ৯. জাওয়াবোন্নাছারা, ১০. বাবু ঈশানচন্দ্র মণ্ডল ও চার্লস ফ্রেন্সের এছলাম গ্রহণ, ১১. ঈসাই বা খ্রীস্টানী ধোঁকা ভঞ্জন ১২. মানবজীবনের কর্ত্তব্য। (মুন্সী মেহেরউল্লা ). তার মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে তৎকালীন সরকার তাঁর বিধবা গঞ্জনা ও হিন্দু ধর্ম রহস্য বই দুটি বাজেয়াপ্ত করে।
তখন খ্রিস্টান পাদ্রীরা গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে খ্রিস্ট ধর্ম প্রচার করত এবং অনেক সময় ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারও চালাত। প্রথমে তিনি পাদ্রীদের এসব কথার বিপরীতে প্রশ্ন ও প্রতিবাদ করতেন, পরবর্তী সময়ে পাদ্রীদের মতো গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে ঘুরে ঘুরে অপপ্রচারের উত্তর দিতেন এবং ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতেন। কথার যুক্তি, বক্তৃতার ধার ও অতুলনীয় বাগ্মিতার কারণে অচিরেই তিনি বাঙালি মুসলমানের নয়নমণি হয়ে উঠলেন। এ কাজে ফুরফুরার পীর আবু বকর সিদ্দিকসহ অসংখ্য মনীষী দোয়া করে ছিলেন। ধর্মীয় আন্দোলনে মুন্সী মেহেরউল্লার কাজ অনেকটা সংস্কারধর্মী ছিল। ড. আনিসুজ্জামানের মতে, ‘মেহেরুল্লাহ্ ইসলামকে কেবল খৃস্ট ধর্মাবলবম্বীদের থেকে রক্ষা করতে চাননি, প্রচলিত কুসংস্কার থেকেও। সৈয়দ আহমদ বেরিলভীর সংস্কার আন্দোলন তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছিল। পরবর্তী ২০/২২ বছরে আসাম ও যুক্ত বাংলার বিভিন্ন শহর , গ্রাম, গঞ্জে প্রায় ৭/৮ শ বক্তব্য , এবং বাহাসে অংশ নেন।
মুন্সী জমির উদ্দিন নামের এক মুসলমান, পাদ্রিদের প্ররোচনায় পড়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এলাহাবাদের ডিভিনিটি কলেজের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তিনি রেভারেন্ড জন জমির উদ্দিন নাম ধারণ করেন। পাদ্রি জমির উদ্দিন ইসলাম ও কোরআনের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। মুনশী মেহের উল্লাহর সাহিত্যকর্মের মধ্যে ১৮৯২ সালে খ্রিস্টান জন জমির উদ্দিন লিখিত ‘আসল কুরআন কোথায়’ এর জবাবে সুধাকর পত্রিকায় ‘খ্রিস্টানি ধোঁকাভঞ্জন’ শীর্ষক সুদীর্ঘ গবেষণামূলক প্রবন্ধ তৎকালীন সময়ে বিশেষভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। এরপরও তিনি ‘আসল কুরআন সর্বত্র’ শীর্ষক আর একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ সুধাকর ও মিহির পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
এই প্রবন্ধ প্রকাশের পর খ্রিস্টানেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে আর কিছু লেখার ও বলার ভাষা যেন হারিয়ে ফেলে। তখন স্বয়ং জন জমির উদ্দিন মুনশী মেহেরুল্লাহ সাথে এক বিতর্কে পরাজিত হয়ে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাকি জীবন ইসলামের খেদমতে কাটিয়ে দেন।
‘মুসলিম জাগরণের বিপ্লবী পথিকৃৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার উল্লেখ করেছেন, মেহের উল্লাহর শাব্দিক অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহ। প্রকৃত অর্থেই তিনি পথহারা বাংলার মুসলমানদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ ছিলেন। মাদরাসায় পড়া খেতাবধারী আলেম না হয়েও আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য নানারূপ প্রতিকুলতার মধ্যে থেকেও অবিরাম সংগ্রাম, সাধনা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, কষ্ট, পরিশ্রম ও নিস্বার্থ আন্দোলন করে গেছেন।
তার সম্পর্কে- মুস্তফা নূরউল ইসলামের লিখিত ‘মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ’ শীর্ষক বইটি একটি তথ্যসমৃদ্ধ জীবনী গ্রন্থ। এটি কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়। শেখ হাবিবুর রহমান রচিত কর্মবীর মুনশী মেহেরুল্লাহ গ্রন্থটিও অসামান্য। বর্তমানে এই বই ণ্ডলি দুষ্প্রাপ্য। তার কর্ম তৎপরতা সমাজ সস্কার, সংগঠন, ধর্ম চিন্তা, সাহিত্য, বক্তৃতা, বক্তব্য, বিবৃতি নিয়ে মূল্যবান বেশ কিছু প্রবন্ধ ও আছে। তার মাঝে উল্লেখ যোগ্য, ড. আনিসুজ্জামান সাহেবের ‘মেহেরুল্লাহ ও জমিরুদ্দিন’। ড. মাহমুদ শাহ কোরেশীর, মুনশী মেহেরুল্লাহ এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব: সাবেক মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি। ডঃ মোহাম্মদ আব্দুল হাই ও ডঃ সৈয়দ আলী আহসানের লিখা বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত বইতেও মুনশী মেহেরুল্লাহ সন্পর্কে মূল্যবান তথ্য আছে।
সৈয়দ আলী আহসান তার প্রবন্ধ ‘মুনশী মেহেরুল্লাহ্ এবং সে সময়কার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, তার একটি বিশেষ সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। সাধারণ সমর্থকগোষ্ঠীর পাশে এরা ছিলেন চিন্তাশীল, গবেষক ণ্ডষ্টি এরা ‘সুধাকর দল’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই ‘সুধাকর দল’টি ‘বাংলায় মুসলিম জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির নেশায় প্রাণঢালা সাধনা করেছিলেন, তারা ছিলেন সত্যিকার ডেডিকেটেড। এঁদের আগে তেমন আর কাউকে দেখা যায় না। এ দলটিই বাঙলার বুকে মুসলমানদের সতন্ত্র জাতীয় সাহিত্যের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। তাদের হাতে তৈরী মানুষের পথ ধরে আজ বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য বিকশিত হয়েছে।’ (সৈয়দ আলী আহসান, প্রবন্ধ : মুনশী মেহেরুল্লাহ্ এবং সে সময়কার পরিপ্রেক্ষিত) সম্প্রতি বিশিষ্ঠ লেখক, চিন্তাবিদ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান সাহেবের ‘ঊনিশ শতকের বাঙালি মুসলিম সমাজ ও মুনশী মেহের উল্লাহ’- এই লিখাটিও মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লার উপর লিখিত একটি মূল্যবান লিখা।
মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ’ কে কলকাতার সুশীল সমাজের একটি বড় অংশ শ্রদ্ধার সাথে বাঙালী মুসলমানের রাম মোহন উপাধিতে ডাকতেন। কলকাতার পাদ্রীরা তাকে সুর তাল সংগীতের একক বাদশা। ওয়ান ম্যান ব্যান্ড। আর ওয়ান ম্যান ব্রিগেড। একাই এক শ’ নামে ডাকতেন। প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন, বাংলা, বিহার, উড়িস্যা, আসামের মুসলিম সমাজের লাখো মে এক।
১৯০৭ সালে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সংবাদ শুনে তাঁরই হাতে গড়া সুযোগ্য শব্দশিল্পী কবি ইসমাঈল হোসেন সিরাজী লিখেছিলেন। কি বিশাল শূন্যতা মুসলমানদের উপর জেঁকে বসলো আজ! তাঁকে হারিয়ে কবি যে শোকগাঁথা রচনা করেছিলেন, তাতেই বোঝা যায় বাংলার মুসলমানের জন্য কি অমূল্য রত্ন ছিলেন মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ’ !
“একি অকস্মাৎ হল বজ্রপাত। কি আর লিখিবে কবি।
বঙ্গের ভাস্কর প্রতিভা আকর অকালে লুকাল ছবি।
কি আর লিখিব কি আর বলিব, আঁধার যে হেরি ধরা।
আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল খসিয়া কক্ষচ্যুত গ্রহ তারা।
‘ইসমাঈল হোসেন সিরাজী।’
একথা নিশ্চিত বাংলাদেশের জনগণের সরকার আর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রিয় মানুষ অচিরেই এদেশের বুকে তার স্মৃতির স্মরণে মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেই। ইনশা আল্লাহ।
বাংলার বীর’ -বিপ্লবী তরুণ তুর্ক, মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ, হাজার ছালাম।
মুনশী মোহাম্মদ মেহের উল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭) মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলায় মুসলিম নব জাগরণের অগ্রদূত। চিন্তা চেতনার সাধক, খ্যাতিমান বাগ্মী, সমাজসেবক সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক ও ইসলাম প্রচারক। বাংলার জাগরনে তিনি রেখেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ব এবং উদ্দমী তৎপরতায় বাংলার মুসলমান সমাজ তৎকালে একটি বড় ধরনের বিধর্মী প্রচার প্রচারণার সামনে নিজেদের কে সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত রাখতে পেরেছিলেন। ওই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এটি ছিল একটি অনেক অনেক বড় কাজ। সময় এসেছে তার এই অবদানকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ণ্ডরুত্বের সাথে যথাযথ ভাবে মূল্যায়ন করার।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, সাবেক সভাপতি :বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ টরন্টো।
কনভেনর ফোবানা ২০০০- টরন্টো , কানাডা।