প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
আজ থেকে ৬০ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে ঢাকার রাজপথে শাহাদাত বরণ করেছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো করেকজন। তাঁদের আত্মাহুতি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষে উপনীত করেছিল। মাতৃভাষাকে যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করা, রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদার আদায়ের জন্য সংগ্রামে আত্মাহুতির ইতিহাস, শহীদ হওয়ার ইতিহাস এর আগে বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ জন্যই একুশ আমাদের গর্ব, একুশ আমাদের অহংকার। একুশ আমাদের চেতনার পরতে পরতে সংগ্রামের অনুরণন জাগায়।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, এক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এর তিন বছর পর ২০০২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৫৬/২৬২ সিদ্ধান্তে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তকে অনুসমর্থন করে। এখন বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতা এবং বহু ভাষার সম্মিলন দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পেছনে রয়েছে কানাডার একটি সংগঠনের ণ্ডরুত্বপূর্ণ অবদান। “ঞযব গড়ঃযবৎ খধহমঁধমব খড়াবৎং ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ” প্রতিষ্ঠাতা কানাডা প্রবাসী বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের নিকট ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা প্রদানের জন্য আবেদন জানান। তাঁদের প্রচেষ্টায় এবং বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউনেস্কো বাংলাদেশসহ ২৭ টি দেশের সমর্থন নিয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ১৬০তম সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারিকে সর্ব সম্মত ভাবে “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে।
জাতিসংঘ কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং গবেষণার জন্য “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৫ মার্চ ২০০১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইন্সটিউটটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ওই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান উপস্থিত ছিলেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের ছিল প্রায় ২০০০ কিলোমিটার দূরত্বের ২টি অংশ। এই দুই অঞ্চলের মধ্যে ভৌগলিক ছাড়াও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়ে অনেকণ্ডলো মৌলিক পার্থক্য ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় ৫৪% সেই সময় বাংলাভাষী, তাই এই ঘোষনা স্বভাবতই পূর্ব বাংলার জনগণকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়া কমিটির আহবায়ক মনোনীত হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আমার শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্য শামসুল হককে কমিটির আহবায়ক করা হয়।
পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক সংসদে বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। খাজা নাজিম উদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক”। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে পাকিস্তানের লক্ষ কোটি মানুষের প্রানের ভাষা উল্লেখ করে এক বক্তৃতায় বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবল মাত্র উর্দুই হতে পারে”। অনেক বিতর্কের পর প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
স্বাধীনতা লাভের কিছু দিন পর ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন।
তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স (বর্তমানের সোহারওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানের এক গণ সম্বর্ধনায় এবং পরে ২৪ মার্চ কার্জন হলের এক সুধী সমাবেশে ঘোষণা করেন, “উর্দু, কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা”। তরুণ সমাজ, রাষ্ট্রভাষা মতিনের নেতৃত্বে “নো নো” বলে তখনই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শুরু হলো ভাষার জন্য আন্দোলন।
ওই সময় আন্দোলনের ব্যপকতা বাড়তে থাকে। ১১ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন বিকেলে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে আয়োজিত এক সভা থেকে সামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম সহ বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করে, সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন নইমুদ্দিন আহমদ।
২৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রতিবাদ সভা এবং এর পর ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশ ব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫২ সনের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘটের পর ছাত্র সমাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউস (বর্তমানের বাংলা একাডেমি ভবন) এর দিকে অগ্রসর হয়।
৩১ জানুয়ারি বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্য বিশিষ্ট “সর্ব দলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ” গঠিত হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার এক নির্দেশ জারি করে ঢাকায় একমাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে।
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নওয়াবপুর রোডস্থ আওয়ামী লীগ অফিসে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ১১-৩ ভোটে ১৪৪ ধারা না ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই দিন রাতে এস এম হল, ফজলুল হক হলসহ বিভিন্ন হলের সভায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে, ওই সময় পুলিশের নির্মম ণ্ডলি বর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ অনেকে শহীদ হন। আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ জনগণ পূর্ন হরতাল পালন করে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে ছাত্ররা রাতারাতি এক অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে, ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ মতিউর রহমানের পিতা এই অস্থায়ী শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন, পরে মওলানা ভাসানী শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন ক্রমে ক্রমে গণ আন্দোলনে পরিনত হয়। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণ পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের ২য় জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয় এবং সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদ এই ভাবে পুন:লিখিত হয়- “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু ও বাংলা”। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে বাংলা।
আমি জীবনে বহুবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক দেওয়ার জন্য গিয়েছি। ছাত্র থাকার সময়, পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং উপাচার্য হিসেবে কয়েক বার। একটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হলো রাষ্ট্রভাষা মতিন ভাইকে নিয়ে ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন। ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি “ভাসানী অনুসারী পরিষদ” গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আব্দুল মতিন চেয়ারম্যান, আমি কো-চেয়ারম্যান এবং শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু মহাসচিব। আমরা সিদ্ধান্ত নেই মতিন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ২১ ফেব্রয়ারী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাবো। উনি সিদ্ধান্তে খুব খুশি, বললেন “আমিতো এমনি হাঁটা চলা করতে পারিনা, কি ভাবে যাবো?” আমরা ওনার জন্য একটি হুইলচেয়ার কিনি। আমরা ওনাকে হুইলচেয়ারে নিয়ে ওইবার শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম। শহীদ মিনারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সবাই খুব সহযোগিতা
করেছিল। প্রায় অধিকাংশ ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদটি বেশ ণ্ডরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে। একুশের প্রথম প্রহর, রাত ১২:০১ মিনিট থেকেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং আজিমপুর কবরস্থানে (যেখানে ভাষা শহীদরা অন্তিম শয়নে শায়িত আছে) সেখানে আবাল-বৃদ্ধ-জনতা শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসতে থাকে। শ্রদ্ধা নিবেদনের এই ভাবগম্ভীর পরিবেশও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিতেও কয়েকবার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।
১৯৬০ দশকে যখন একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হতোনা, তখনও আমাদের শানিত চেতনার সম্মিলিত প্রয়াসে খুবই ভাবগম্ভীর পরিবেশে একুশ উদযাপিত হতো। কোন বাঁধা বিপত্তিই সে সময় একুশের প্রথম প্রহরের প্রভাত ফেরি ও অন্যান্য কর্মসূচিতে কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারতোনা।
এ প্রসঙ্গে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকার সময়ের ১৯৬৫ সালের একটি কর্মসূচির উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। ঢাকা কলেজে সে সময় ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলো। তবে ছাত্র সংসদের কার্যক্রম চলতো। প্রথমে শ্রেণী প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো, পরে শ্রেণী প্রতিনিধিদের ভোটে সংসদ নির্বাচিত হতো। শ্রেণী প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রার্থী বা ছাত্র-সংসদের কোন পদের প্রার্থী দেশে তখন বিদ্যমান কোন ছাত্র সংগঠন যথা- ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্র শক্তি, এণ্ডলোর কোনটির সঙ্গেই জড়িত থাকার কথা প্রকাশ করতে পারতোনা।
১৯৬৪ সালে ২য় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে আমি বিজ্ঞান বিভাগের “গ” শাখা থেকে প্রথমে শ্রেণী প্রতিনিধি নির্বাচিত হই, পরে ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষা বর্ষের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হই।
ঢাকা কলেজে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় ঘটনা ১৯৬৫ সালের শহীদ দিবসের কর্মসূচী পালন। প্রিন্সিপাল জালাল উদ্দিন আহমদ কলেজে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কোন ধরনের কর্মসূচি পালন করতে দিতেননা, যদিও কলেজ প্রাঙ্গনে একটি শহীদ মিনার ছিলো। কোন আন্দোলন ও সংগ্রামে জড়িত ছাত্র নেতৃবৃন্দকে “বহিস্কার বা কলেজ পরিবর্তন সার্টিফিকেট” দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতি বছরই তিনি নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জন নিন্দিত গভর্নর মোনায়েম খানের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্কের জন্য সবাই তাকে বেশ সমীহ করে চলতো।
আমরা ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ছাত্র সংসদের সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের কর্মসূচি হাতে নেই। সকাল ৬ টায় কলেজ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের কবর জিয়ারত এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন।
খবরটি বেশ কিছুক্ষনের ভেতরই চরের মাধ্যমে প্রিন্সিপাল স্যারের কানে পৌঁছে যায়। তিনি ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দকে তলব করলেন। তাঁর অফিস কক্ষে ছাত্র সংসদের জরুরি সভা বসে, প্রিন্সিপাল পদাধিকার বলে সংসদের সভাপতি, তাই তাঁরই সভাপতিত্বে সভা অনুষ্টিত হয়। ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা প্রফেসর নোমানকেও সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রথমেই সভাপতি শহীদ দিবস উপলক্ষে আমাদের কর্মসূচির কথা জানতে চায়। আমরা বিনীত ভাবে আমাদের ঐ দিনের কর্মসূচী অবহিত করি। আমাদের বক্তব্য শুনে তিনি কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকেন- পরে বললেন, “২১ ফেব্রুয়ারি প্রিন্সিপালের বিশেষ ক্ষমতাবলে কলেজ ছুটি থাকবে, এমনকি কলেজের মেইন গেইটও বন্ধ থাকবে। তবে আমরা কয়েকজন কলেজ শহীদ মিনারে ফুল দিতে পারবো, এর পর ইচ্ছে হলে পেছনের কোন ছোট গেইট দিয়ে বের হয়ে আজিমপুর কবরস্থানে যেতে পারবো।” আমরা অনুরোধ জানালাম ছাত্র সংসদের সভাপতি হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে কলেজ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক প্রদানের সময় আমাদের সাথে উপস্থিত থাকার জন্য। জবাবে তাঁর রক্ত চক্ষুর নীরব তাড়া খেয়ে আমরা সভাস্থল ত্যাগ করি।
২০ ফেব্রুয়ারি আমরা ছাত্র সংসদ অফিসে আলোচনায় বসি। সহ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দু’জনই ক্যাম্পাসের বাইরে থাকে বলে অত সকালে আসতে পারবেননা বলে জানান। ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাসে থাকি বলে আমার উপরই কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পরে। আমিও গর্বিত চিত্তে রাজি হই।
২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্রাবাসের ৮/৯ জন ছাত্রসহ কলেজ শহীদ মিনারে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে যাই। যাওয়া মাত্রই প্রিন্সিপাল স্যারের প্রিয় খাস পিওন জানালো, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা আছে। আমি বললাম, ছাত্র সংসদের সভায় প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সভাপতিত্বে ফুল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই আমরা ফুল দেবই। কথা কাটাকাটির মাঝে প্রিন্সিপাল স্যার লুঙ্গি পরে, গায়ে চাদর জড়িয়ে এসে হাজির। এসেই বললেন- “কারা ফুল দিতে চাও, সামনে আসো।” আমি সামনে গিয়ে বলি- স্যার, আপনার সভাপতিত্বের মিটিংয়েইতো ফুল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি “তোমাদের যা ইচ্ছা কর” বলে চলে গেলেন।
আমরা যথারীতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করার পর আজিমপুর কবরস্থানে যাওয়ার জন্য পেছনে গিয়ে দেখি ছোট বড় সব গেটণ্ডলো তালাবদ্ধ। আমরা দেয়াল ডিঙ্গিয়ে বের হয়ে প্রথমে আজিমপুর কবরস্থান এবং পরে কেন্ত্রীয় শহীদ মিনারে যাই। আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত ও বিশ্বাসে অটল ছিলাম বলেই ঐ দিনের কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন সক্ষম হয়েছিলাম।
এর ২/৩ দিনের মধ্যেই আমাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে কলেজ ডিসিপ্লিন ভঙ্গের অভিযোগে শো-কজ নোটিশ জারি করা হয়। নোমান স্যারের সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ চাই। তিনি উপদেশ দেন কোন প্রখ্যাত আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী শো-কজের জবাব দিতে। বন্ধু রুহুল আমিনও ছাত্র সংসদের সদস্য। ওকে সহ মেনন ভাই, মান্নান ভাই ও অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত অবহিত করি। তাদের সহযোগিতায় আমরা তৎকালীন বরেণ্য আইনজীবি মির্জা হাফিজের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং তাঁরই নির্দেশনা অনুযায়ী শো-কজের জবাব দেই। শো-কজের যথাযথ উত্তর পাওয়ার পর প্রিন্সিপাল জালাল আহমদ নোমান স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করেন। নোমান স্যার বলেন “শো-কজের উত্তর দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবি মির্জা হাফিজের পরামর্শ নিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনি ওদেরকে সতর্ক করে ব্যপারটি মিটিয়ে ফেলুন, যদি অন্য কোন শাস্তি দেন, তবে ওরা আদালতে যাবে। আমি কিন্ত তখন ঐ দিন আপনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদের সভার সিদ্ধান্তের কথা আদালতকে অবহিত করবো। ওরাতো ওই দিন সভার সিদ্ধান্তের বাইরে কোন কাজ করেনি।” প্রফেসর নোমান বলিষ্ঠ ভূমিকা নেওয়ায় আমরা বহিস্কার কিম্বা কলেজ ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের খড়গ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। সম্ভবত আমি ও আমার সাথের কয়েকজন বন্ধুই জালাল আহমদের শো-কজের পরও ঢাকা কলেজের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে পেরেছিলাম।
ঐ সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রিন্সিপাল জালাল আহমদের ন্যায় আরও অনেকেই আইয়ুব-মোনায়েমের নেক নজরে পড়ে “তগমায়ে ইমতিয়াজ বা খিদমত” উপাধি লাভের জন্য বহু প্রতিভাবান ছাত্রের শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি বা বিঘ্ন ঘটিয়েছিলো।
পরে জানতে পারি প্রিন্সিপাল স্যার ডেকে গোপনে হুমকি দেওয়ায় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি, সাধারন সম্পাদক ও অন্য কোন নেতাই কলেজের ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেনি। তাই আমি না জেনে ঐ দিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলাম।
আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি ঢাকা কলেজে আমার শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করতে পেরেছিলাম। তা না হলে আমার জীবন হয়তোবা অন্যদিকে মোড় নিতে পারতো!
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একুশের মূল চেতনা “মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর” প্রত্যয়ে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালে একুশের শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য জাতীয় পদক, “একুশে পদক” প্রবর্তন করেন। তিন তোলা ওজনের ১৮ ক্যারাটের এই স্বর্ন পদকটির নকশা অংকন করেছিলেন শিল্পী নিতাই কুন্ডু। পদকের সাথে একটি সম্মাননা পত্র ও নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। প্রথম দিকে অর্থের পরিমাণ ২৫,০০০ টাকা ছিল, বর্তমানে ১ লক্ষ টাকা। এই পদকটি সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য প্রতি বছর কয়েক জন বিশিষ্ট নাগরিককে প্রদান করা হয়।
একুশের শহীদদের স্মরণে আর একটি ণ্ডরুত্ব পূর্ণ অবদান হচ্ছে বাংলা একাডেমি কর্তৃক মাসব্যাপী একুশে বই মেলা। বাংলা একাডেমি ১৯৭৮ সাল থেকে বই মেলা আয়োজন করলেও ১৯৮৪ সাল থেকে “অমর একুশে বই মেলা” নামে অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রথম দিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলা অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কিছু অংশও বই মেলার জন্য ব্যবহৃত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১ লা ফেব্রুয়ারি এই বই মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। তবে গত তিন বছর বিশ্বমহামারী করোনার কারনে বই মেলার উদ্বোধন অন-লাইনে হচ্ছে। অমর একুশ বই মেলাটি বাংলাদেশের মননশীল প্রকাশনা, লেখক ও পাঠক তৈরিতে খুবই ণ্ডরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
একুশের পথ ধরে বাংলাদেশের পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তি ও সাহস এসেছে। ’৬৯ এর ছাত্র-গণ আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ ছিলো একুশের চেতনার অনুরণন। ১৯৬৯ এর ২০ জানুয়ারী ঢাকার রাজপথ বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে শহীদ হয়েছিলেন আমাদের রাজনৈতিক সহকর্মী আসাদ ভাই। এর ৪ দিন পর শহীদ হন স্কুল ছাত্র মতিউর রহমান। ছাত্র-গণ আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পতন ঘটে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের। তখন ২১ ফেব্রয়ারী উপলক্ষে বেশ কিছু স্মরণিকা প্রকাশিত হতো। ১৯৭০ সালে আমার সম্পাদনায় মুহসিন হল ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রূপ) কর্তৃক “প্রত্যয়” নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। ওই সংকলনে কবি শামসুর রাহমানের কালজয়ী কবিতা “ আসাদের শার্ট আমাদের প্রানের পতাকা” প্রথম ছাপা হয়েছিল, আরও ছাপা হয়েছিল শহীদ আসাদের ডাইরির দুই পাতা ব্লক করে। সংকলনটি সারা দেশে খুব সাড়া জাগিয়েছিল। আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে এক ণ্ডরুত্বপূর্ণ অনুঘটক।
বাংলাদেশে এখন কি একুশের চেতনা “মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর” চেতনা লালিত হচ্ছে? বুকের রক্ত দিয়ে শহীদরা যে অধিকার আদায় করেছিল, তা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা আরও বেশি করে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, পানি আগ্রাসন এবং আরো বহু ধরনের আগ্রাসনের শিকার হচ্ছি। এক কথায় দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। একুশের চেতনা, মওলানা ভাসানীর আদর্শ এবং শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার সংগ্রামে যুগ যুগ ধরে আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ