প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৬৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯৫৭ সালের ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইলের সন্তোষের কাগমারীতে মওলানা ভাসানী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ওই সম্মেলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই সম্মেলনের প্রেক্ষাপট ও জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব নিয়ে আলোচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নুতন প্রজম্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভাসানীর ভূমিকা, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলকে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত করার জন্য তাঁর অসামান্য অবদানের কথা প্রায় সকলেরই জানা, ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর আচরণ তাঁকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে তুলে। স্বাধীনতা লাভের কিছু দিন পর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। কার্জন হলের এক সুধী সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন, “ উর্দু, কেবল মাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা”। তরুণ সমাজ, রাষ্ট্রভাষা মতিনের নেতৃত্বে “নো নো” বলে তখনই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। শুরু হলো ভাষার জন্য আন্দোলন। সর্ব দলীয় “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি” গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী কমিটির আহ্বায়ক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের নির্মম গুলি বর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ অনেকে শহীদ হন। আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
মওলানা ভাসানী সবসময়ই খেটে খাওয়া মানুষের বিশেষ করে কৃষক শ্রমিকের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনীতি করেছেন। এই জন্য তাঁকে “আফ্রো- এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত জনগণের নেতা – মজলুম জননেতা” হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই কৃষকদের ওপর নির্যাতন, জুলুম অব্যাহত ছিল। তিনি সারা পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকটি কৃষক সমাবেশ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবের টোবা টেক সিং এর লাখো লোকের এক কৃষক সমাবেশে তিনি, মহা কবি ইকবালের কবিতার চরণ উল্লেখ করে বলেছিলেন “যে ক্ষেতের ফসল কৃষকের উপকারে আসেনা, সেই ক্ষেতের ফসল পুড়িয়ে দাও।“ এর মাধ্যমে তিনি কৃষকদের জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হওয়ার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানে প্ৰথম বিরোধী দল, পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠা কালীন সভাপতি মনোনীত হয়। পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালনের জন্য সংগঠনটি থেকে ”মুসলিম” শব্দ বাদ দিয়ে “পাকিস্তান আওয়ামী লীগ” করা হয়।
১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানীকে নিয়ে “যুক্ত ফ্রন্ট” গঠিত হয়। এই নিবার্চনে পূর্ব বাংলার যুক্ত ফ্রন্ট বিপুলভাবে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ের পেছনে হক-ভাসানীর জনপ্রিয়তা এবং তৃণমূল পর্যায়ে পরিচিত মূলত কাজ করেছিল। আমার বয়স তখন ৭ এর মত। এখনো মনে আছে আমরা স্লোগান দিতাম “ হক-ভাসানী জিন্দাবাদ, নৌকায় ভোট দিন”। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ব শাসন। নির্বাচন উপলক্ষে যুক্ত ফ্রন্ট “২১ দফা” কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল।
১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের বিজয়ের পর এই বিবৃতি দেয়া হয়েছিল –
“মুসলিমলীগের গণ বিরোধী শাসক চক্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী এক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়াছে। এই দাসত্ব চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম লীগ শাসক চক্র আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ গোষ্ঠীর নিকট আমাদের স্বাধীনতা বন্ধক দিতে যাইতেছে। এই অবস্থায় আমার আহ্বান, আপনারা জাগিয়া উঠুন, জাতিকে রক্ষা করুন”।
ওই সময় পাকিস্তান সরকার মার্কিন সরকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়। এ জন্য প্ৰথম সিয়াটো (CEATO) এবং এর বছর খানেকের মধ্যেই সেনটো (CENTO) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
১৯৫৫ সালের ২৬ নভেম্বর ভাসানী কাগমারীতে পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন আহবান করেন। কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই ওই সভা শেষ হয়।
সম্মেলন উপলক্ষে ২৪ দফা সম্বলিত একটি প্রচার পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। প্রচার পত্রের শুরুতেই বলা হয়, “বর্তমান সরকার ২১ দফা পালন করিতে ধর্মত ও আইনগত বাধ্য। বিশ্বাসঘাকতা করিলে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়িয়া গণ আন্দোলনের ঝড় বহিয়া যাইবে।“
প্রচার পত্রের প্ৰথম দফা, “কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু সামরিক বিভাগ, (নৌ বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে থাকিবে), মুদ্রা প্রস্তুত, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য পূর্ব পাকিস্তানে থাকিবে), এই তিনটি ছাড়া সমস্ত ক্ষমতা এবং যুক্ত নির্বাচন আদায়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট দাবি করিয়া প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ হইতে পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের আসন্ন বৈঠকে প্রস্তাব পাশ করাইতে হবে।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর এক নিবন্ধে বলেন, “১১ বছর পর আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভাসানীর ঐ দাবীরই পন
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের ঘটনা প্রবাহেও আওয়ামী লীগের ডানপন্থী অংশের সঙ্গে ভাসানীর মত পার্থক্য তীব্র হতে থাকে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল নিযে মিশর ও বিট্রেনের মধ্যকার বিরোধের সময় ভাসানী মিশরকে সমর্থন করেন, অন্য দিকে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন দেন। সিয়াটো, সেনটো নিয়েতো তীব্র মত পার্থক্য প্ৰথম থেকেই ছিল।
১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোষ করে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের, কোয়ালিশন সরকারের প্রধান মন্ত্রী নিয়োজিত হন। এর সপ্তাহ অনেক আগে আতাউর রহমান খান পূর্ব বাংলায় যুক্ত ফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্ৰধান মন্ত্রী নিয়োজিত হওয়ার পর থেকেই হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ব শাসন বিরোধী অবস্থান নেন, যা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থী।
এই অবস্থায় মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৫৭ সালের ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলন আহবান করেন। প্ৰথম দিন ৮ ফেব্রুয়ারী কাউন্সিল অধিবেশন এবং পরের দুই দিন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন।
আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলন ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। উপমহাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, রাজনৈতিক নেতা এবং সামাজিক নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশ্ব পরিমন্ডলে ভাসানীর পরিচিতি ও যোগাযোগ ছিল প্রণিধানযোগ্য। বিপুল সাড়া পেয়েছিলেন তিনি।
কাউন্সিল অধিবেশনে কেন্দীয় সরকারের প্রধান মন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, প্রাদেশিক সরকারের মুখ্য মন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষন নিপিড়নের কথা উল্লেখ করে বলেন স্বায়ত্ব শাসনের দাবির কোন অগ্রগতি হয়নি। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে এই অঞ্চলের জনগন অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে “আসসালামু আলাইকুম” জানাতে বাধ্য হবে। ভাসানীর ওই উক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেছিল, এই জন্যই মওলানা ভাসানীকে “স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্রষ্টা” হিসেবে অভিহিত করা হয়। ওই সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে এই ভাবে হুঁশিয়ার করে ভবিষ্যতে আলাদা হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ার সাহস ভাসানী ছাড়া আর কোন নেতার ছিলোনা।
কাগমারী সম্মেলনের কাউন্সিল অধিবেশনে সুবিধা না করতে পেরে সোহরাওয়ার্দী ঢাকা ফিরে আসেন। তাঁরই নির্দেশে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের লনে এক ছাত্র-জন সভার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় সোহরাওয়ার্দী বলেন “ইতিমধ্যেই পূর্ব বাংলাকে ৯৮% স্বায়ত্বশাসন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও সিয়াটো, সেনটো সহ ইঙ্গ-মার্কিন জোটে যোগদান এবং জোট নিরপেক্ষ ব্লক সম্পর্কে তিনি বলেন “ Zero plus Zero is a big Zero” অর্থাৎ শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ করলে যোগফল শূন্যই হয়। এর মাধ্যমে তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে কোন দুর্বল রাষ্ট্রও যদি কোন শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গড়ে তা হলে দুর্বলও শক্তিশালী হয়ে উঠে, অন্য দিকে বেশ কয়েকটি দুর্বল রাষ্ট্রের জোট দুর্বলই থেকে যায়। এই উক্তির জন্য সোহরাওয়ার্দী বেশ নিন্দিত হয়েছিল।
৯ ফেব্রুয়ারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন শুরু হয় প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কাজী মোতাহারের সভাপতিত্বে। সম্মেলন উপলক্ষে দেশি বিদেশী মনীষীদের নামে ১০০এর বেশি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। প্ৰথম তোরনটি ছিল পাকিস্তানের জাতীয় পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নার নামে। তোরণ নির্মিত হয়েছিল এরিস্টটল, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইমাম গাজ্জালী, হজরত শাহজালাল, আবুজর গিফারি, কবি আলাওল, কবি নজরুল, কবি রবীন্দ্রনাথ, কবি আলাওল, ইংরেজ কবি শেক্সপিয়র, মিল্টন ও শেলী, জার্মান দার্শনিক হ্যাগেল, কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলস, মহা কবি মিলার, গ্যাটে, তলস্টয়, দস্টয়ভক্সি, ম্যাক্সিম গোর্কি, লেলিন, স্ট্যালিন, পারস্যের কবি সাদি, হাফিজ, রুমি, ফেরদৌসী ও ওমর খৈয়াম, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, চীনের মহান নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই , ভারতের স্বামী বিবেকানন্দ, স্যার সৈয়দ আহমদ, রাম মোহন রায়, বিজ্ঞানী সি ভি রমন, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, চিত্ত রঞ্জন দাশ, ক্ষুদিরাম, হাসমত সোহানি, আজাদ সোহবানি, মির্জা গালিব, আলতাফ হোসেইন হালি, মোহাম্মদ আলী, শওকত আলী, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, কবি মধুসূদন, শরৎ চন্দ্ৰ, সিন্ধি মরম কবি আব্দুল লতিফ ভীট, আল্লামা ইকবাল, পাঞ্জাবী মরমী কবি বুলাহ শাহ, সৈয়দ আমির আলী, নবাব আব্দুল লতিফ, নবাব সলিমুল্লাহ, বেগম রোকেয়া, লালন শাহ, কৃষক বিদ্রোহের নেতা মজনু শাহ, তিতুমীর, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, সূর্য সেন প্রমুখ মনীষীদের নামে। তোরণগুলো বিশ্বের দেশে বিদেশের মনীষীদের নামে নির্মাণ থেকেই মওলানা ভাসানীর আন্তর্জাতিক পরিসরে বিচরণের সুষ্পষ্ট আভাষ পাওয়া যায়।
সম্মেলনে অংশ গ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিছিলেন। অনেকে যোগ দিয়েছিলেন, কেউ কেউ ওই সময় অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকায় অপারগতা জানান। আবার বেশ কয়েকজন সম্মেলনের সফলতা কামনা করে বানী পাঠিয়েছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও লেখক হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল আসে। মিশরের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. হাসান হাশবি। ব্রিটেন থেকে এসেছিলেন এইচ এম কসন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সি ডেভিড পার্থ, কানাডা থেকে চার্লস জে এডামন্স। পশ্চিম বঙ্গ থেকে তারা শংকর রায় সহ অনেক কবি সাহিত্যিক। পূর্ব বাংলা থেকে শীর্ষ স্থানীয় কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, গবেষকদের অনেকেই অংশ গ্রহন করেছিলেন।
প্রায় সকলের আহার বাসস্থানের আয়োজন সন্তোষেই করা হয়েছিল। ভাসানীর মুরিদরা সবাই সাধ্যমত চাল, দল, হাঁস, মুরগি, ছাগল, গরু, মাছ দিয়ে সহায়তা করেছিল। হুজুর ভাসানীর তত্ত্বাবধানে একসাথেই রান্নাবান্না এবং খাদ্য বিতরণ করা হয়েছিল। সবই ছিল খুবই সুন্দর ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। প্রখ্যাত চলচিত্রকার জহির রায়হান সার্বক্ষনিক সহযোগিতা করেছেন।
সম্মেলনের এক ফাঁকে হাঁটার সময় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক তারা শংকর রায়কে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন “১২ বছরের মধ্যেই পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। উনি পরে অন্নদা শংকর রায়ের কাছে ভাসানীর ওই উক্তি উল্লেখ করে নিরাপত্তার স্বার্থে এটি অন্যদেরকে না জানানোর অনুরোধ করেছিলেন।
কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসানী গবেষক ড. লাইলী উদ্দিন তাঁর “Mao_Lana Bhashani of Assam/Bengal/Pakistan/Bangladesh” নিবন্ধে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা অজয় ঘোষের একটি বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, যাতে তিনি বলেন, “জিন্নার পর নপাকিস্তানে পাকিস্তান ভিত্তিক নেতা মওলানা ভাসানী”।
একই নিবন্ধে ড. লাইলী উল্লেখ করেন ভাসানী বিশ্বাস করতেন সমাজতন্ত্র ও ইসলাম অবিচ্ছেদ্য। তিনি কোন কোন সভায় মোনাজাতের সময় “আল্লাহ আমাদের কমিউনিস্টদের হেফাজত করুন” বলতেন। ভাসানী রাষ্ট্রীয় সফরে চীন ভ্রমনের সময় চেয়ারম্যান মাওকে বলেছিলেন, “আপনাদের সবই ভালো, শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহের উপর বিশ্বাস ছাড়া।“
কাগমারী সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের ডানপন্থীদের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ইত্তেফাক পত্রিকায় (যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভাসানী) সম্পাদক মানিক মিয়ার নেতৃত্বে প্রায় প্রতিদিনই তীব্র ভাষায় ভাসানী ও ৰামপন্থীদেরকে আক্রমন করতে থাকে। ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে এক কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ন্যাপ গঠন করা হয়, মওলানা ভাসানী ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন।
কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে আসসালামু আলাইকুম বলেই ভাসানী চুপ করে বসে থাকেননি। তিনি পূর্ব বাংলা, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন।
১৯৬৯ ছাত্র গণ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মওলানা ভাসানী। ১৯৬৮ সালের ৬ নভেম্বর ঢাকার পল্টনের জন সভা, পরে লাট ভবন ঘেরাও, পরদিন ৭ নভেম্বর ঢাকা শহরে হরতালের মাধ্যমে তিনি স্বৈরাচারী আইয়ুব-মোনেম শাহীর বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের সূচনা করেন। ২৯ নভেম্বর, বাংলাদেশের সর্বত্র হাট বাজার হরতালের ঘোষণা দেন। ওই দিন নরসিংদীর শিবপুরের কাছের হাতিরদিয়া বাজারে হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলিতে সিদ্দীক, মিয়াঁচান সহ ৪ জন কৃষক শহীদ হন এবং ছাত্র-কৃষক নেতা আসাদুজ্জামান আহত হয়। এর পর ওই অঞ্চলের কৃষক ও ছাত্র কর্মীদের উপর সরকারী নির্যাতন চলতে থাকে, মওলানা ভাসানী প্রতিবাদ স্বরূপ হাতিরদিয়ার ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও শিবপুরে এক জনসভার ঘোষণা দেন। সভার দিন শিবপুরের সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, পুলিশ চতুর্দিকে ব্যারিকেড দেয়। ভাসানী পুলিশ বেষ্টনী ভেঙে সভাস্থলে এসে জালিম শাহীর পতনের জন্য মোনাজাত শুরু করেন, আশেপাশে লুকিয়ে থাকা জনগণ স্রোতের মত সভা স্থলে পৌঁছতে থাকে, অল্প কিচুক্ষনের মধ্যেই লক্ষাধিক লোক উপস্থিত হয়। মওলানা ভাসানী তাঁর স্বভাবসুলভ জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জালিম শাহীর পতনের জন্য সারা দেশে আন্দোলন বেগমান করার আহ্বান জানান। ওই সময় হুলিয়া মাথায় থাকা স্বত্বেও আসাদ ভাই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসে বক্তব্য রাখেন।
এর কয়েকদিনের মধ্যেই ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাজপথে মিছিলে থাকার সময় পুলিশের গুলিতে শাহাদত বরণ করেন আসাদ ভাই। পরদিন ঢাকায় গায়েবি জানাজায় ইমামতি করেন মাওলানা ভাসানী। ২৪ জানুয়ারি শহীদ হন স্কুল ছাত্র মতিউর। ১৯৬৯এর ছাত্র আন্দোলন গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। আইয়ুব শাহীর পতন ঘটে। আসাদের শাহাদতের কয়েকদিন পর আবার মওলানা ভাসানী শিবপুরে গিয়ে এক বিরাট কৃষক-ছাত্র-জনতার সভায় ভাষণ দেন।
তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছিলো। শেখ মুজিবুর রহমান সহ অনেকেই কারাগারে। ভাসানী গণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সবাইকে কারা মুক্ত করে আনেন। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সাময়িক শাসন জারি করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তিনি লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের অধীনে নির্বাচন ঘোষণা করেন। ভাসানী ওই নির্বাচন বর্জন করেন।
১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ভোলা ও আশেপাশের অঞ্চলে শতাব্দীর ভয়াবহতম সাইক্লোন ও ঘূর্ণি ঝড় আঘাত হানে। ভাসানী তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ডাক্তারদের নির্দেশ অমান্য করে তিনি উপদ্রুত অঞ্চল সফরে যান। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর কেউই উপদ্রুত অঞ্চল দেখতে আসেননি। তিনি পল্টনের জনসভায় “ওরা কেউ আসেনি” বলে উপদ্রুত অঞ্চলের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন এবং নির্বাচন পেছানোর দাবি করেন। কবি শামসুর রাহমান পল্টনের ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন, আবেগ আপ্লুত হয়ে “সফেদ পাঞ্জাবী” নামে একটি অমর কবিতা লিখেন।
১৯৭০ সালের ২৫ নভেম্বর পল্টনের সভায় পাকিস্তানীদেরকে চূড়ান্ত ভাবে আসসালামু আলাইকুম বলে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন। এর পর ২৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় আবারও তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানান।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছু দিনের ভেতরই সামরিক জান্তারা সন্তোষের তাঁর কুঁড়ে ঘর পুড়িয়ে দেয় এবং তাঁকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। তিনি পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তিনি “সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদের” চেয়াম্যান মনোনীত হন। ওই সময় তিনি চীনের এবং বিশ্বের অনেক দেশের নেতৃবৃন্দের নিকট বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে সহায়তা করার আহ্বান জানান।
নয় মাসের মরণপণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে স্বাধীনতার যে বীজ বপন করেছিলেন, তা সত্যে পরিণত হলো, মজলুম জন নেতার সপ্ন ও সাধনা সার্থক হলো।
তাই এ কথা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলা যায়, ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দ্রষ্টা ভাসানী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। যুগ যুগ ধরে দেশ প্রেমিক জনগণের হৃদয়ে অনুরণিত হবে এই মহান নেতা, মওলানা ভাসানীর নাম।