নিজ দলের এক নেত্রীর বাসায় ‘চায়ের দাওয়াতে’ গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী পৌরসভার বর্তমান মেয়র ৭৫ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী। সেই বাসায় অতর্কিতে ঢুকে কয়েকজন মিলে তাকে শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে মেঝেতে ফেলে পিটিয়েছে। পেটানোর সময় সেলিমুলকে লক্ষ্য করে তাদের বলতে শোনা গেছে, ‘এমপিকে গালি দিয়েছিস কেন, এমপির বিরোধিতা করেছিস কেন?’ পরে খবর পেয়ে পুলিশ ও স্থানীয়রা গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ নেতা সেলিমুলকে পেটানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর চট্টগ্রামে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) রাত ৮টার দিকে বাঁশখালী পৌরসভার মিয়ার বাজার এলাকায় উপজেলা যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হীরা মণির বাসায় এ ঘটনা ঘটেছে। ‘পরিকল্পিতভাবে’ মারধরের পর আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়, অনৈতিক কাজ করতে যাওয়ায় সেলিমুলকে ধরে জনতা মারধর করেছে।
গত ১৭ জানুয়ারি বাঁশখালী পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে। পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী এবার দলের মনোনয়ন পাননি। দলের মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন অ্যাডভোকেট এস এম তোফায়েল বিন হোসাইন, তিনি চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনের সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নির্বাচনে তোফায়েলকে সমর্থন করেননি বর্তমানে মেয়র পদে থাকা সেলিমুল, নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়ে যার মেয়াদ শেষ হবে।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে জানান, যুব মহিলা লীগের নেত্রী হীরা মণির ভাই পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করে হেরেছেন। সে বিষয়ে কথা বলার জন্য হীরা মণি তার দাদা সম্পর্কের মেয়র সেলিমুলকে তার বাসায় চায়ের দাওয়াত দেন। সেইসঙ্গে নিজের ফুপাতো ভাই পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক মো. হামিদুল্লাহ চৌধুরীকেও দাওয়াত দেন। সেলিমুল সন্ধ্যার দিকে পরাজিত কাউন্সিলর প্রার্থী জামালকে নিয়ে ওই বাসায় যান।
সেলিমুল হক বলেন, ‘বাসায় যাবার ১০ মিনিটের মধ্যে জামালের কাছে একটি ফোন আসে। তখন জামাল বেরিয়ে যায়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে হামিদ বাসায় ঢোকে। আমরা ড্রইংরুমে বসে নাস্তা করছিলাম এবং কথাবার্তা বলছিলাম। কিছুক্ষণ পর বাসার নিচে হইচই শুনি। হঠাৎ দেখি বাইরে থেকে কে বা কারা দরজায় তালা মেরে দিয়েছে। আমি থানায় ফোন করি। পুলিশ আসার আগেই চারজন ভেতরে ঢোকে। আমাকে বলে- তুমি এখন এখান থেকে নেমে যাও। আমি বললাম- কেন নামব? তারা বলে- তুমি এমপির বিরোধিতা করেছ, এমপিকে গালাগালি করেছ, আবার আমাদের নেত্রীর বাসায় এসেছ কেন? আমাদের এমপি সাহেব পাঠিয়েছেন তোমাকে বেইজ্জত করার জন্য।’
এমপির বিরোধিতা করেছিস কেন?— বলেই বীর মুক্তিযোদ্ধা মেয়রকে মারধর
সেলিমুল জানান, এসব বলতে বলতে ইলিয়াছ নামে একজন তার শার্টের কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দেয়। এরপর চারজন মিলে তাকে মারধর করে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এ ঘটনার পর ভবনের নিচে পুলিশ আসে। তখন চারজন বেরিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজনও ভবনের পঞ্চমতলায় ওই বাসায় যান। পুলিশ ও স্থানীয়রা মিলে মেয়রকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেন। চলে যাবার সময় মেয়র ভবনের নিচে হামলাকারী চারজনসহ অন্তত ২০-২৫ জনকে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন।
যুব মহিলা লীগের নেত্রী হীরা মণি সারাবাংলাকে বলেন, ‘তালা খুলে হঠাৎ আমার বাসায় চারজন প্রবেশ করে। তারা দাদার (সেলিমুল) কলার ধরে ফেলে। এ সময় উনি বলেন- বাবা তোমরা তো আমার ছেলের বয়সী, আমার অপরাধটা কী? আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওরা বলল- তুমি এমপির বিরোধিতা কেন করেছ? এমপিকে গালি দিয়েছ কেন? আমি ও হামিদ ভাই উনাকে রক্ষার চেষ্টা করেছি। পুলিশ আসার পর তারা চলে যায়। মেয়র সাহেবকেও পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যায়।’
বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র সাহেবকে যখন অবরুদ্ধ করা হয়, তখনই উনি থানায় ফোন করে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফোর্স পাঠাই। কিন্তু ফোর্স যাওয়ার আগেই স্থানীয় লোকজন উনাকে উদ্ধার করেন। আমরা গিয়ে বাড়িতে দিয়ে আসি।’
হামলাকারী চারজন কারা? জানতে চাইলে সেলিমুল বলেন, ‘এরা একেবারে বখাটে, টোকাই। মাসখানেক আগেও দেখলে আমার পা ধরে সালাম করত। এখন যেহেতু আমি আর মেয়র পদে থাকব না, আমার ওপর হামলা করতেও তারা দ্বিধা করেনি। আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমার বয়স ৭৫ বছর। তারা আমাকে যেভাবে লাঞ্ছিত করেছে, নিশ্চয় তাদের নির্দেশ দাতা কেউ আছে। তারা আমার শার্ট ছিঁড়ে দিয়েছে। আমি ছেঁড়া শার্ট থানায় জমা দিয়েছি।’
এদিকে হীরা মণি বলেন, ‘চারজনকে পৌরসভা এলাকায় মাঝেমধ্যে দেখি। তবে সেভাবে কখনও রাজনীতি করতে দেখিনি। এমপি সাহেবের গ্রুপও করে না। এমপি সাহেবের নাম ভাঙ্গিয়ে হামলা করেছে।’
সেলিমুল হামলার জন্য নবনির্বাচিত পৌর মেয়র এস এম তোফায়েল বিন হোসাইনকে দায়ী করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। উনি আমাদের ধর্ম অনুযায়ী শপথ করে বলেছেন, উনি ওই চারজন ছেলেকে চেনেন না। হামলার সঙ্গে উনার কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেছেন। আমার মনে হচ্ছে, তোফায়েলের নির্দেশে এ হামলা হয়েছে। আমি নির্বাচনে তার পক্ষে ছিলাম না। সেই ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা তার নির্দেশে হয়েছে।’
এ বিষয়ে কথার বলার জন্য বারবার ফোন করেও সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সাড়া পাওয়া যায়নি। এস এম তোফায়েল বিন হোসাইনের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।
হামলার শিকার সেলিমুল হক চৌধুরী বুধবার বিকেলে বাঁশখালী থানায় এজাহার জমা দিয়েছেন। এতে চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়ে ওসি কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এজাহার পেয়েছি। মামলা রেকর্ডের প্রক্রিয়া চলছে।’