মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
১৭৫৭ সনের ২৩ শে’ জুন, দিনটি ছিল বাংলার ইতিহাসে ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাস ঘাতকতায় পূর্ণ একটি দিন। এই দিনে পলাশীর আম্রকাননে একটি পাতানো এবং সাজানো যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনচেতা, প্রচণ্ড সাহসী, দেশপ্রেমিক শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের দিন।
একই সঙ্গে এদেশের স্বাধীনতা হারানোর বিপর্যয়ের দিন। তারপর দীর্ঘ ১৯০ বছর। অগাস্ট ১৯৪৭’ পর্যন্ত বাংলার বুকে চলে ইংরেজ বেনিয়া কোম্পানির দীর্ঘ শাসন ও শোষণ।
দীর্ঘ এই সময়কালে এ দেশ থেকে ব্রিটিশ রাজ উৎখাতের আন্দোলন-সংগ্রাম কখনই থেমে থাকেনি।
হাজী মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহর: ফরায়েজী আন্দোলন সেই ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামেরই একটি অংশ।
এটি এদেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়, বর্ণিল আখ্যান। দীর্ঘ ইতিহাসের এই ঘটনাণ্ডলি নতুন প্রজন্মের সামনে পর্যায়ক্রমে সত্যিকার ণ্ডরুত্ব সহকারে তুলে ধরা প্রয়োজন। জাতীয় ইতিহাসের শক্ত বুনিয়াদ এবং সংহত ভিত্তি তৈরির স্বার্থে এবং স্বাধীনতা রক্ষায় জাতিকে জাগ্রত ও সদাপ্রস্তুত রাখবার প্রয়োজনেও এটি দরকার।
আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের অংশ হিসেবেই ফরায়েজী আন্দোলন এবং তার প্রতিষ্ঠাতা হাজী মোহাম্মদ শরীয়তউল্লাহর ঐতিহাসিক অবদান এখানে তুলে ধরা, স্মরণ করা ।
” হাজী মোহাম্মদ শরিয়তুল্লাহ্ “
হাজী মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার শামায়েল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মোঃ আব্দুল জলিল তালুকদার, তিনি অল্প বয়সেই তার পিতাকে হারান অতঃপর তার চাচা হন তার অভিভাবক, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন চৌকস দুরন্ত মেধাবী এবং সমবয়সী অন্যদের থেকে কিছুটা ভিন্ন, শৈশবেই লোকমুখে কলকাতা সম্পর্কে অনেক গল্পই তিনি শুনেছিলেন, তারপর একদিন কল্পকাহিনীর ঝলমলে কলকাতার হাতছানিতে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে আসেন, সেখানে খুঁজে পান তাঁর ওস্তাদ মাওলানা বাশারত আলীকে। এই সাক্ষাৎ তার জীবনের মোড় পরিবর্তনে ণ্ডরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। ওস্তাদ মাওলানা সাহেবের চিন্তা-ধারা শিক্ষাদিক্ষা তার জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ওস্তাদ, শিক্ষক মওলানা বাশারত আলী সহ তিনি পবিত্র হজের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন। আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় শিক্ষা সহ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে, হজ শেষে তিনি মক্কাতে থেকে যান এবং প্রবাস জীবনে নিজেকে শিক্ষা-দীক্ষার মাঝে পরিপূর্ণভাবে মননিবেশ করেন। অতি অল্প সময়েই তিনি আরবি ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও আইনে পান্ডিত্য অর্জন করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই সময় কালে তিনি সময় ও সুযোগ করে জ্ঞান অন্বেষ ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় উপলক্ষে আরো কয়েকটি আরব দেশ ভ্রমন করেন। অবশেষে উনিশ বছর পর ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে দেশের মানুষের এবং চারিদিকের অবস্থা দেখে, বিশেষ করে মুসলিমদের দুর্দশা দেখে তিনি ভীষণভাবে মর্মাহত হন। মক্কায় অবস্থান কালে তিনি বিশিষ্ট চিন্তাবিদ দার্শনিক বিপ্লবী শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভী’র শিক্ষা এবং চিন্তা ধারায় সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সেখানেই তিনি ইংরেজের সঙ্গে লড়াই ও তাদের মদতপুষ্ট পদলেহী বংশবদ জমিদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইকে এক ও অভিন্ন মনে করতে শেখেন। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশে ফিরে দেশের শোষিত, অত্যাচারিত কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমার অনুন্নত ও দরিদ্র শ্রেণীর জন্য সত্যিকার ভাবে কিছু করবেন। এই চিন্তা থেকেই তিনি একটি সংগঠন গড়ে তুলবার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং প্রেরণা পান। দেশে ফিরে কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেন নতুন সংগঠন ও আন্দোলন । ইসলামের মূল করনীয় কাজ বা প্রধান করণীয় কাজ ণ্ডলিকে ‘ফরজ’ বলা হয়। তিনি বাংলার মুসলমানকে সব ধরনের কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সহজ সরলভাবে ইসলামের মূল আদর্শকে বা ফরজ কাজ ণ্ডলিকে অনুসরণ করবার ডাক দেন। তখন থেকেই তার এই আন্দোলনের নাম হয়ে যায় ফরায়েজী আন্দোলন। একই সঙ্গে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাদের সচেতন করে তোলা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক সংস্কারকে ফরায়েজী আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।
এবং তিনি তার সংগঠনের মাধ্যমে তৃণমূল মানুষের কাছে, সংস্কারের ণ্ডরুত্ব অনুধাবন করে সংগঠিত হবার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান এবং এই পথে সাধারণ মানুষ কৃষক-শ্রমিক কে সর্বাত্মক ভাবে উৎসাহী করেন।
স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক সংস্কার, ভেদাভেদ মুক্ত, সাম্য ও শান্তির সমাজ গঠনের ণ্ডরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি মনে করতেন সমাজে পরিবর্তন আনতে প্রয়োজন, ঈমান আকিদাপূর্ণ নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশ্বাসী একদল মানুষের। তিনি আরো উপলব্ধি করেন সাম্প্রদায়িকতা সমাজ কে খন্ডিত করেছে এবং এটি শাসকদের উদ্দেশ্যপূর্ণ কুট চাল- খন্ডিত সমাজ কখনোই একত্রিত হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী একতাবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। এবং সম্ভব হবে না দেশে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন। তার কাছে এ বিষয়ণ্ডলি ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার স্পষ্ট। তিনি সাম্প্রদায়িকতাকে বাংলার বুকে ইংরেজ সৃষ্ট এক দুস্ট ক্ষত মনে করতেন। সঠিকভাবে নিজ ধর্ম পালন করা এবং শক্তভাবে ঈমান-আকিদা কে ধারণ করা কে তিনি সাম্প্রদায়িকতা বলে মনে করতেন না। এবং মনে করতেন না একজন ঈমানদার মুসলমান বিদ্বেষপূর্ণ এবং সাম্প্রদায়িক হতে পারে। তিনি মনে করতেন “অন্যদের ধর্ম ও বর্ণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাটাই হল প্রকৃত অর্থে সাম্প্রদায়িকতা”। ওই সময় কালে এই চিন্তা চেতনা ছিল অভূতপূর্ব।
কালক্রমে এই আন্দোলন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা সহ আশেপাশের জেলাণ্ডলিতে এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি তার পূর্বসূরি বিপ্লবী বাংলার, জনযুদ্ধের জনক মজনু শাহ বুরহান এবং বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের অন্যতম শহীদ সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের সংগ্রাম ও নেতৃত্ব ণ্ডন এবং তাদের উভয়ের কর্ম পদ্ধতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে অবগত ছিলেন। বাংলার এই দুই বিপ্লবী নেতা কে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
হাজী মোহাম্মদ শরিয়তউল্লাহ অনুভব করেন। বাংলার বুকে জেঁকে বসা বেনিয়া শাসন। ছিনিয়ে নিয়েছে, বাংলার মানুষের স্বাধীনতা। এবং রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সৃষ্টিশীলতা। ইংরেজ শাসন পূর্ব মুসলিম বাংলায়, বাংলার কৃষকের ছিল মাঠ ভরা ফসল, গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, পালা পর্বন উৎসাহ-উদ্দীপনা, কৃষ্টি কালচার ধর্মীয় মূল্যবোধ নীতি-নৈতিকতা। মুক্ত হাওয়া খোলা বাতাস নির্মল প্রকৃতি আর নিরাপদ সুখ ও শান্তির জীবন। দেশের সাধারণ মানুষের মাথার উপর ছিল ঘরের ছাদ, খোলা আসমানে চাঁদ তারা। ছিল নিজস্ব মৃৎশিল্প, কামার কুমার জেলে তাঁতি স্বর্ণকার আর অলংকার শিল্পী। সোনার বাংলায় তৈরি জামদানি ছিল সারা ভারতের সেরা। আর মসলিন কাপড়ের ছিল বিশ্বজোড়া নাম।
এর সঙ্গে ছড়িয়ে ছিল দুনিয়াব্যাপী বাংলার সুনাম। বাংলার তৈরি কাঠের রণতরী পঙ্খিরাজ হাঁসের মতো ভাসতো সাত সাগর দুনিয়াময়। সেদিনের মুসলিম বাংলা ছিল সারা ভারতের স্বর্ণ ভান্ডার। অর্থনীতি ছিল সুশৃংখল মজবুত কাঠামো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। ছিল শান্তিসুখের নিত্যদিন। সর্বোপরি ছিল নিরাপদ জীবন এবং জীবনের নিরাপত্তা- প্রবাদ ছিল সে আমলে বাঘে এবং ছাগলে এক ঘাটে পানি খেতে ছিলনা কোন অসুবিধা- এদেশের বুকে সাম্প্রদায়িকতার কোনো চিহ্ন ই তখন ছিল না- এটি এদেশে আমদানি হয়েছে ইংরেজের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি থেকে, সাম্প্রদায়িকতা দেশের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং সামাজিক ভারসাম্য কে করে তুলেছিল বিপর্যস্ত। আমদানি করা সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সারা বাংলায় ।
ক্ষমতায় এসেই ইংরেজ উদ্দেশ্য মূলকভাবে, নিয়েছিল মুসলিম স্বার্থ বিরোধী নীতি। আর বিপরীত দিকে অল্প কিছু সংখ্যক বর্ণহিন্দু কে সামান্য কিছু এঙ্ট্রা সুবিধা দিয়ে তাদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিল হিন্দু-মুসলিম মাঝে সাম্প্রদায়িক বিভক্তি ছাড়ানোর অপকর্মে। ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে মুসলিম হাত থেকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ইংরেজ তৎকালীন বাংলার সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত, বুনিয়াদি সচ্ছল মুসলিম সমাজকে এবং পরিবারণ্ডলিকে পরিকল্পিতভাবে নিঃস্ব হতদরিদ্রতার মাঝে নিক্ষিপ্ত করেছিল- এই কাজে নিয়েছিল সব ধরনের কৌশল। শুরু থেকেই তারা তাদের শাসনের জন্য মুসলমানদেরকেই সম্ভাব্য হুমকি হিসাবে মনে করতে থাকে। তাই বাংলার মুসলমানদেরকে, তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক ভিত্তি এবং মান সম্মানের অবস্থান থেকে ছিঁটকে ফেলে দিতে তারা উঠেপড়ে লাগে।
সাম্রাজ্যবাদী বিভেদ পূর্ণ সাম্প্রদায়িক ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির শিকার হয়েছিলেন, হাজী মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহর মার্জিত উচ্চশিক্ষিত, ধার্মিক বিত্তবান সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত পরিবারটিও। সমাজে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতে তখন বিভিন্ন সেক্টরে পরিকল্পিতভাবে গোরা এবং দেশি লরেন্স অফ বেঙ্গল জাসুস দেরকে নিয়োগ করা হয়েছিল। এবং এই একই উদ্দেশ্যে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছিল মধ্যস্বত্ব ভোগি, চরম সুবিধাবাদী, চাটুকার দালাল, পদলেহী একটা নব্য ধনী এবং নব্য জমিদার শ্রেণী। নূতন করে গজিয়ে ওঠা ইংরেজ পদলেহী এই শ্রেণী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে সব ধরনের অপচেষ্টায় চালাতেন। রাজ্য হারা, সামাজিক ভিত্তি হারা মুসলমানদেরকে তখন টার্গেট করা হয়েছিল।
মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৃষ্টি-কালচার নিয়ে অপমান অপদস্ত করবার কোন সুযোগই তারা হাত ছাড়া করত না। নব্য এই বেঙ্গল লরেন্সরা সর্বদা অপপ্রচার করতেন এবং চারিদিকে বলে বেড়াতেন ইসলাম মরুর ধর্ম, ইসলাম আরবের ধর্ম, মুসলমান বহিরাগত ইত্যাদি। অপপ্রচার ণ্ডলি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, সাম্প্রদায়িক এবং বিদ্বেষপ্রসূত- উত্যক্ত কর পরিকল্পিত অপপ্রচার, মুসলমানকে ছোট করে দেখানোই ছিল তাদের কাজ।
আফ্রিকা থেকে ৭০ হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে যখন দ্রাবিড়রা আসে তখন তারা এদেশে স্থানীয় উন্নত অহিংস, সভ্য ভদ্র মানব গোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পায়, এই প্রাগৈতিহাসিক মানব গোষ্ঠী ছিলেন সাবিয়ান। বর্তমান মুসলমানদের পূর্বসূরী, এক আল্লাহ তে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী। আদি মানব হযরত আদম (সঃ) এবং মা হাওয়ার বংশধর। তারা ছিলেন বর্তমান ইতিহাস থেকে বিলুপ্ত নবী পয়গম্বরদের অনুসারী সাবিয়ান। দ্রাবিড়রা সাবিয়ান দের থেকে অপেক্ষাকৃত বর্বর শ্রেণীভূক্ত ছিল। দ্রাবিড় আগমনের পর সাবিয়ানরা আরো ভিতরের দিকে ছড়িয়ে যায়, সরে যায়। আর্যরা এদেশে আসে আরো অনেক অনেক পরে আজ থেকে সাত হাজার বছর পূর্বে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় ভারতের হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম এবং স্থানীয় লোকজ সংস্কৃতি এবং ধর্মচর্চার মানুষেরা এক আল্লাহ-এক ঈশ্বর, এক ভগবানে বিশ্বাসী সাবিয়ানদের থেকে অনেক অনেক পরের মানুষ। শোনা যায় শ্রীলংকার মানুষের বিশ্বাস তাদের দেশের পাহাড়ের উপর আছে আদম পদচিহ্ন।
আদি মানব এবং প্রথম নবী বাবা আদম (আ:) এবং মা হাওয়ার থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পর্যন্ত সকল নবী পয়গম্বরদের সৃষ্টিকর্তা এবং ইসলামে বিশ্বাসী মুসলিমদের সৃষ্টিকর্তা এক ও অভিন্ন। সেই সূত্রে এদেশের আদি জনগোষ্ঠী ইতিহাস থেকে বিস্মৃতপ্রায়, সাবিয়ানরা আর মুসলিমরা এক ও অভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী জনগোষ্ঠী।
অর্থাৎ এক আল্লাহ পাক এ বিশ্বাসী। সেই অর্থে এ দেশ, এ উপমহাদেশ এবং বিশ্বে মুসলিমরা ত’ নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবি করতেই পারে। মুসলিম বিশ্বাসমতে সমস্ত মানুষ আদম ও ইভের অর্থাৎ আদম ও হাওয়ার সন্তান, এই সূত্রে সকল মানুষই একে অপরের ভাই ভাই। ক্রিশ্চিয়ান ও ইহুদিরা এই সূত্রে বর্ণনা অনুসারে, মুসলমানদের ফাস্ট কাজিন। অন্যান্য সব ধর্মের যারা ঈশ্বর ভগবান বা অন্য কোন নামে বিশ্বাসী অন্য কোন ধর্মে বিশ্বাসী তারা সেকেন্ড কাজিন। এবং যারা এই বিশ্বে কোন প্রকার ধর্মতে বিশ্বাসী নয় এমন অবিশ্বাসীরাও হিসাব মতে থার্ড কাজিন।
এটি মুসলিম অমুসলিম সবাই একদিন জানবেন এবং বুঝবেন। অতএব এদেশে মুসলমানরা বহিরাগত এই বক্তব্য সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং সত্যের বিপরীত, জলজ্যান্ত মিথ্যা। আদি কালে মুসলিম পূর্বসূরিরা বিভিন্ন কারণে দিক ভ্রান্ত হয়েছেন। যারা ভিন্নমত অবলম্বন করেছেন তারা ভ্রম, বা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন এটিই সত্য। পরবর্তীতে, যখন সত্য উপলব্ধি শেষে তারা আবার তার পুরাতন ধর্ম মত বা ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে আসেন তখন তাদেরকে রিভার্ট মুসলিম বা রিভার্টেড মুসলিম বলা হয়। কারণ তারা তাদের নিজ গৃহে আবার ফিরে এসেছেন। পরিশেষে মূলকথা মুসলমানরা কখনোই এদেশে বহিরাগত নয়।
এই ধরনের অপবাদ কে তারা সময়ই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ইংরেজ মদদপুষ্ট নব্য বেঙ্গল লরেন্স দের অপপ্রচার সমগ্র মুসলিম সমাজের মাঝে স্বাভাবিকভাবেই তাই ক্ষোভ সৃষ্টি হবার অন্যতম কারণ। এমত অবস্থায় রাগ দুঃখ ক্ষোভ ও শোককে শক্তি রূপে ধারণ করে ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত দীর্ঘ এই ১৯০ বছর বাংলার বীর সন্তানেরা বাংলার বুক থেকে চিরতরে ব্রিটিশ তাড়ানর, হার না মানা ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ও স্বাধীনতার আন্দোলন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছেন।
দীর্ঘ সংগ্রামের এই পথে ফরায়েজী আন্দোলন ছিল একটি ণ্ডরুত্বপূর্ণ ধাপ। নিজ জীবদ্দশায় এই আন্দোলনকে হাজী মোহাম্মদ শরিয়তউল্লাহ একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। নিরস্ত্র ফরায়েজী আন্দোলনের অনুসারীদের বজ্রকঠিন একতা এবং তাদের সাংগঠনিক শক্তি কে তৎকালীন নীলকুঠির কুঠিয়াল, অন্ধ ইংরেজ ভক্ত পদলেহী জমিদার ও তাদের কর্মচারীরা সমীহ করে চলত। এর ফলে সাধারণ কৃষক গ্রামের দিনমজুর বিভিন্ন পেশা শ্রেণীর মানুষ তাদের অত্যাচার উৎপীড়ন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পায় – ফরায়েজী আন্দোলন এইভাবে দেশের তৃণমূল মানুষের আস্থার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের সংগঠন হয়ে ওঠে। বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার সংগ্রামে হাজী মোহাম্মদ শরিয়তউল্লাহর অবদান অতুলনীয়, অনস্বীকার্য, এবং চিরস্মরণীয়। ইতিহাসের সোনালী পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে এ নামটি। ফরায়েজী আন্দোলনের স্রষ্টা, প্রতিষ্ঠাতা, হাজী মোহাম্মদ শরিয়তুল্লাহ্ ও তার পরিবারের অবদান এদেশের মানুষ কখনোই ভুলতে পারেনা, পারবেনা।
১৮৪০ সালে ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, মহান কর্মবীর হাজী মোহাম্মদ শরিয়তউল্লাহ ইন্তেকাল করেন তার মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র হাজী মোহাম্মদ মহসিন উদ্দিন দুদুমিয়া মাত্র ২১ বছর বয়সে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন।
মুহসিনুদ্দীন দুদুমিয়া ১৮১৯ সালে মাদারীপুর মহকুমার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি তার সুযোগ্য পিতার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সহ আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় বাস্তব জীবন শিক্ষা অর্জন করেন। এবং ১৮৩১ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে পিতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ তাকে পবিত্র হজ করতে এবং উচ্চতর ইসলামী ও বাস্তব জীবনমুখী শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে মক্কা পাঠান- মক্কা যাওয়ার প্রাক্কালে নিজ পুত্রকে তিনি বসিরহাট বারাসাত এ অবস্থানকারী, বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের সঙ্গে দেখা করে তার থেকে দোয়া ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণের উপদেশ দেন। মহসিন উদ্দিন দুদুমিয়া পিতার নির্দেশ ক্রমে বারাসাতে জান এবং মাসাধিককাল সেখানে অবস্থান শেষে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পবিত্র হজ শেষে তিনি পিতার ইচ্ছানুসারে মক্কাতে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। তিনিও তার পিতার মত মেধাবী প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মক্কা থেকে বাংলাদেশ ফিরে আসেন। তিন বছর পর ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে পিতাহারা হন।
১৮৫৭ সালে (আঠারোশো সাতান্ন সালে) গোটা উপমহাদেশে, শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ইংরেজ হঠাও স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। এদেশের সিপাহী-জনতা বিদ্রোহী হয় এবং ইংরেজ বিরোধী অবস্থান নেয়। ১৮৫৭ স্বাধীনতা সংগ্রামে ২০০০ ইংরেজ অফিসার ও সৈনিক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতে নিহত হন।
তখনকার এই টালমাটাল অবস্থায় শিখ সম্প্রদায়, নেপালি গোর্খা, এবং কলকাতাকেন্দ্রিক সুশীলদের একটি বৃহৎ অংশই ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করে। অনুগত জমিদারদের কুপ্ররোচনায় এবং উস্কানিতে ইংরেজ ১৮৫৭ সালে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে দুদুমিয়া কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। হাজী শরীয়তুল্লাহ পুত্র দুদুমিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে পারে এই ভয়ে ইংরেজ শঙ্কিত ছিল। প্রথমবার তাকে কলকাতা আলিপুর জেল থেকে তাকে মুক্তি দেবার পর। সালে পুনরায় তাকে বন্দী করা হয় ১৮৬০ সালে ণ্ডরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেন কারাগারে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে অনেকে আশঙ্কা করেন তাকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। অসুস্থ অবস্থায় তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ১৮৬২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর ঢাকাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পুরনো ঢাকার ১৩৭ নং বংশাল রোড এ তাকে কবর দেয়া হয়। হাজী মুহাম্মদ মহসিন উদ্দিন দুদুমিয়ার মৃত্যুর পর পর তার পুত্র গিয়াসুদ্দিন হায়দার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ফরাজি আন্দোলন পরিচালনা করেন।
এইভাবে মোহাম্মদ শরিয়তউল্লাহ ও তার পরিবার তাদের সর্বস্ব উজাড় করেছেন দেশের মানুষের জন্য। জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য- মনে করে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছিলেন।
বেনিয়া ইংরেজ শাসনের ১৯০ বছর পর্যায়ক্রমে- সশস্ত্র সংগ্রাম, জনযুদ্ধ, বিপ্লবী আন্দোলন, সামাজিক সংস্কার আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের নিয়মতান্ত্রিক সাংগঠনিক আন্দোলনসহ সব ধরনের আন্দোলন সব ধারাতেই বিকশিত হয়েছিল। আর এটি সম্ভব হয়েছিল হাজী মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহদের মত নির্ভিক, সাহসী, যোগ্য, দক্ষ দূরদর্শী, নির্লোভ মানুষদের, সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসায়। তখনকার দিনে এই কাজণ্ডলি, তত সহজ না হলেও তা তখন সম্ভব হয়েছিল। দেশের মানুষের দেশ প্রেম আর বিপ্লবী প্রেরণায়।
পরবর্তীতে ফরায়েজী আন্দোলনের একটি বড় অংশ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন হবার পর তারা ওই সংগঠনে যোগ দেন – আরেকটি অংশ সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের কাজে ফরাজি আন্দোলন চালিয়ে যান।
১৯০ বছরের সুদীর্ঘ আন্দোলনের প্রথম ধাপের সমাপ্তি ঘটে আগস্ট ১৯৪৭ সালে, এটি ছিল এদেশের বাঙালি মুসলিম আন্দোলনের সাফল্যের প্রথম ধাপ এবং প্রথম পরিণতি।
পলাশী থেকে পল্টন আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত ধাপটি পরিশেষে এসেছে ১৯৭১’ এ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। আন্দোলন-সংগ্রাম এবং শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে।
বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ সংগ্রামকে ঐতিহাসিকেরা কয়েকটি ধাপে, ভাগ করে দেখেন :
প্রথম ধাপটি : বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌলার পলাশীর প্রান্তর থেকে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ।
এবং বিদ্রোহী বীর কাসেম আলী মীরের (মীর মোহাম্মদ কাশেম আলী খান) এর মুর্শিদাবাদ থেকে বঙ্ার পর্যন্ত ছোট বড় পাঁচটি সশস্ত্র যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত।
দ্বিতীয় ধাপটি শুরু হয়: ইতিহাসের ছাত্র, বঙ্ার যুদ্ধের সৈনিক, বাংলার জনযুদ্ধের জনক, মজনু শাহ বোরহান এবং বাংলার বুকে বাঁশের কেল্লায় নিশান তোলা ঝান্ডা ওড়ানো বিপ্লবী বীর সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের সশস্ত্র জন যুদ্ধ।
এবং ১৮৫৭ র শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতার স্বাধীনতা যুদ্ধের মহাবিদ্রোহ পর্যন্ত।
তৃতীয় ধাপ শুরু হয়: – স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার আন্দোলনে শতাব্দী শ্রেষ্ঠ সংগঠক ফরায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে। এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, স্রষ্টা- হাজী মোহাম্মদ শরীয়তুল্লাহ ও তার পুত্র মুহাম্মদ মুহসীন উদ্দীন (দুদু মিয়া), বাংলার ওয়ান ম্যান ব্যান্ড, ওয়ান ম্যান ব্রিগেড খ্যাত, একাই একশ – বিপ্লবী মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমুখ ফরায়েজী আন্দোলন ছিল বাংলার বুকে আধুনিক ইউরোপিয়ান মডেলের সংগঠন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা পূর্ব এবং স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সশস্ত্র যুদ্ধ ও জন যুদ্ধ পরবর্তী – নিজস্ব চিন্তা চেতনায় দেশি মডেলে গড়ে ওঠা ইউনিক গণসংগঠন – যার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ছিলেন অগণিত দেশ প্রেমিক বাংলার মানুষ। বাংলার ইতিহাসে হাজী মোহাম্মদ শরীয়ত উল্লাহ এবং তার প্রতিষ্ঠিত ফরায়েজী আন্দোলন সুস্পষ্টভাবে রেখে গেছে একটি বলিষ্ঠ ছাপ স্থায়ী একটি মেসেজ। সপরিবারে দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ স্বীকার তিনি করেছেন তাই দেশের মানুষ ও ভালবেসে একটি জেলার নাম তার স্মরণে তার সম্মানে রেখেছেন শরীয়তপুর।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো