টার্গেটকৃত ফোনে গোপনে নজরদারি করতে ইসরায়েলের নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বাংলাদেশের পুলিশ। পাঁচ বছর ধরে এই প্রযুক্তি পুলিশ ব্যবহার করছে।ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার পরও ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি স্বয়ং প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে ঐ দেশটির তৈরি নজরদারি প্রযুক্তির উদ্বোধন করেন। ইসরায়েলের গোয়ন্দা নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হয় ‘এনহেন্সিং দ্য সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ক্যাপাবিলিটি অফ বাংলাদেশ পুলিশ’ শিরোনামের একটি প্রজেক্টের অধীনে।
বুধবার ইংরেজি দ্য নিউ এইজ’র এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এর আগে কাতার-ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা ইংলিশ-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর ইসরায়েলি নজরদারি প্রযুক্তি ক্রয়ের বিষয়টি জনসম্মুখে নিয়ে আসলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার শুরু হয়।
ইসরায়েলের মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবি ইতাই ম্যাক বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে নজরদারি প্রযুক্তি লেনদেনের এই বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে সিঙ্গাপুরে একটি প্রক্সি অফিস খুলে বসেছে সেলেব্রাইট কোম্পানি।
জাস্ট নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটির অনুবাদ তুলে ধরা হল:
ইসরায়েলি কোম্পানির প্রস্তুতকৃত উচ্চ প্রযুক্তির নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করছে বাংলাদেশ পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট। ব্যবহারকারীর ইলেকট্রনিকস ডিভাইস থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং তা তদন্ত কাজে ব্যবহার করতে এই নজরদারি প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে পুলিশ। ২০১৯-২০২০ সালের মধ্যে দায়েকৃত আটটি মামলার ফরেনসিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে দেখেছে দ্য নিউ এইজ। আর তাতে তদন্ত কাজে ইসরায়েলের সেলেব্রাইট (Cellebrite) কোম্পানির ইউনিভার্সেল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন ডিভাইস (Universal Forensic Extraction Device) প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা গেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাদের কাছে নিজেদের ‘ডিজিটাল ফরেনসিক’ সলিউশন বিক্রি করে ইসরায়েল।কোম্পানিটির দেয়া বরাত অনুসারে, তাদের তৈরিকৃত ‘ইউনিভার্সেল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন ডিভাইস’ প্রযুক্তি যেকোন বন্ধ মোবাইল ফোন থেকে যেকোন ধরনের তথ্য চুরি করতে পারে, জানাতে পারবে সেটা ঠিক কোথায় অবস্থান করছে। আর বিষয়টি ফোনের ব্যবহারকারি মোটেও টের পাবেনা।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার দায়ে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানায় শ্রীনগর কলেজ ছাত্রদল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম শুভ’র, ২৫, বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাটি দায়ের করেন র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর ইন্সপেক্টর মোস্তাফিজুর রহমান। আশরাফুল অপরাধ ছিলো প্রধানমন্ত্রী জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছেন না- সেটা নিয়ে সমালোচনা করা। ঐ মামলার তদন্তে সিআইডি ইসরায়েলের সেলেব্রাইট কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করে আশরাফুলের মোবাইল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কারা হেফাজতে লেখক মুশতাকের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের সমালোচনা করার দায়ে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিনকে, ৩৫, গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় খুলনা মহানগরীর গোয়েন্দা পুলিশ। তার নামেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়। সিআইডি ফরেনসিক ল্যাব একই প্রযুক্তিতে তার মোবাইল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা যাচাই-বাছাই করে।
ফেসবুকে আলদাভাবে দেয়া কয়েকটি পোস্টে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মো: নুরুজ্জামান, ৩৫। একিসঙ্গে মন্ত্রীরা করােনা মহামারিতে সামাজিক দূরত্ব না মেনে চলার বিষয়েও সমালোচনা করেন তিনি। এই সমালোচনা করার দায়ে র্যাব-৬ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে বসে। ২০২০ সালে ১লা মে বাঘারপারা থানায় এই মামলাটি দায়ের করা হয়।
২০২০ সালের ২০ জুন প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করার দায়ে ১৫ বছর বয়সি কিশোর মো: ইমনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ময়মনসিংহের ভালুকা থানায় মামলাটি দায়ের করেন হাবিরবারি আওয়ামী লীগ শাখার সেক্রেটারি হানিফ মোহাম্মদ নিপুন। এই মামলার তথ্য যাচাই করে দেখা গেছে সিআইডি ল্যাব এই তদন্তেও একই গোয়েন্দা প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের ১১ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য নিউ এইজ। এর মধ্যে চারজন নিশ্চিত করেছেন যে- ইসরায়েলে সেলেব্রাইট কোম্পানির প্রযুক্তি ব্যবহার করছে পুলিশ। সংগঠিত ঘটনার তদন্ত কাজে এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তারা উল্লেখ করেন।
সেলেব্রাইটের নজরদারি যন্ত্রগুলো ‘এনহেন্সিং দ্য সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ক্যাপাবিলিটি অফ বাংলাদেশ পুলিশ’ (Enhancing the Cyber Crime Investigation Capability of Bangladesh Police) প্রজেক্টের আওতায় আনা হয়েছে। আর এতে অর্থায়ন করেছে কোরিয়ান সাইবার বিশেষজ্ঞদের কোম্পানি ‘কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’। বাংলাদেশ পুলিশের ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব ওয়েবসাইটের দেয়া তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই প্রজেক্টের উদ্বোধন করেন। ইসরায়েলের সঙ্গে কোন কূটনৈতিক যোগাযোগ না থাকার পরও দেশটি থেকে নজরদারি প্রযুক্তি কিনেছে বাংলাদেশ।
সাবেক সিআইডি প্রধান মোখলেসুর রহমান বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার মান উন্নয়নে একটি প্রজেক্টের অধীনে ‘কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি’ এই নজরদারি প্রযুক্ত কিনেছে।
সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবের ইনচার্জ এবং স্পেশাল সুপারইনটেনডেন্ট অফ পুলিশ রোমানা আক্তার বলেন, “সরকারের তরফ থেকে এই প্রযুক্তি (ইউনিভার্সেল ফরেনসিক এক্সট্রাকশন ডিভাইস) ব্যবহারে কোনাে ধরনের বাধা নেই তাই আমরা ব্যবহার করছি।”
সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আরেক কর্মকর্তা বলেন, “ইসরায়েলি যন্ত্র আনার শুরুর দিকে আইটি ফরেনসিক টেকনোলজি এবং সফটওয়ার নিয়ে কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত ধারণা ছিলোনা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় এই প্রযুক্তির আর কোনাে বদল হয়নি। যারা এখন ফরেনসিক তদন্ত করেন তারা এখন এই প্রযুক্তিতে (ইসরায়েলি) অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।”
তিনি আরও জানান, “৫-৬ বছর আগে এই প্রযুক্তি ক্রয় করা হয়েছিল। আমাদের তদন্ত কর্মকর্তারা আগে এই যন্ত্রটি ব্যবহারের ট্রেনিংয়ে অংশ নেন এবং ২০১৭ সালে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আদালতও তাদের বিচারকাজে সিআইডি ফরেনসিক ল্যাব থেকে সরবরাহ করা রিপোর্ট গ্রহণ করছেন।”
সিআইডি ছাড়া পুলিশের অন্য কোন শাখা ইসরায়েলের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে কী না জানতে চাইলে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তেমন কোন সাড়া মেলেনি। তবে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর চীফ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “ফরেনসিক ল্যাবে ইসরায়েল থেকে কেনা কিংবা তৈরি করা কোনো যন্ত্র এবং সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়না।”
২০২০ সালের আগস্টে ইসরায়েলি পত্রিকা হ্যারেৎজ-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের একটি বিশেষ বাহিনী সাধারণ নাগরিক এবং সাংবাদিকদের বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড, নির্যাতন এবং গুম করতে ইসরায়েলের সেলেব্রাইট কোম্পানির প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে। আর তাই বাংলাদেশে নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেলেব্রাইট।”
নজরদারি প্রযুক্তিকে ২০২০ সালে জনসম্মুখে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা সেলেব্রাইট করেছিল উপরোক্ত সিদ্ধান্তটি তাতে একটা প্রভাব বিস্তার করে বলে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়।
ইউএস সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে আগস্ট মাসে জমা হওয়া নথি অনুসারে- সেলেব্রাইট কোম্পানির বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা ভবিষ্যতে প্রযুক্তি বিক্রির ক্ষেত্রে নৈতিক মান বজায় রাখান বিষয়টিকে গুরুত্ব দিবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নথি অনুসারে দেখা যায় ইসরায়েলি কোম্পানি সেলেব্রাইটের তালিকায় পশ্চিমা দেশগুলোর পুলিশবাহিনীসহ যে কয়টি প্রধান ক্রেতা রয়েছে তার মধ্যে এখনও রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন তদন্তকারি সংস্থাগুলোকে সাইবার অপরাধ এবং ডিজিটাল তথ্যসংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা দিয়ে থাকে ফরেনসিক ল্যাব। পাশাপাশি বিচারকাজে আদালতে কোন বিষয় উপস্থাপন করা হলে তাতে ফরেনসিক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান করা হয়। ২০১৮ সালে প্রায় ১০০০ মামলায় ৪,০০০ এর বেশি ডিজিটাল তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছে ফরেনসিক ল্যাব।
একটি মামলার তদন্তের সময় যেসকল ডিজিটাল ডিভাইস– যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ট্যাব, হার্ডডিস্ক, পেন ড্রাইভ, সিডি, ডিভিডি, রেকর্ডিং ডিভাইস, ডিজিটাল ক্যামেরা, ভিওআইপি সরঞ্জাম, ড্রোন, সিমকার্ড, মেমোরি স্টিক, নেটওয়ার্ক ডিভাইস, সিসিটিভি এবং অন্যান্য জিনিস– জব্দ করা হয় সেগুলো ল্যাবে যাচাই-বাছাই করেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।
সেলেব্রাইট কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের ব্যবসায়িক লেনদেনের বিষয়টি আড়াল করতে সিঙ্গাপুরে একটি প্রক্সি অফিস খুলে বসেছে। ইসরায়েলের মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবি ইতাই ম্যাক ২০২০ সালে মার্চ মাসে দেশটির সুপ্রিমকোর্টে দায়ের করা নথি-পত্রে এই দাবি করেন।উৎসঃ জাস্টনিউজ