[(বাংলার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদের অন্যতম শহীদ তিতুমীর]
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নেতা। ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বারাসত মহকুমার চাঁদপুর/হায়দারপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মা আবিদা রোকেয়া খাতুন। ছোটবেলায় গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের পর তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন।
তিনি ছিলেন বিদ্যানুরাগী ও অত্যান্ত মেধাবী ছাত্র। কোরান ও হাদিস বিষয়ে অল্প বয়সেই তিনি পাণ্ডিত্য লাভ করেন।
কুরআনে হাফেজ হন। বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় হয়ে উঠেন দক্ষ। সেই সাথে আরবি ও ফার্সি সাহিত্যের প্রতি তখন তার গভীর অনুরাগ ফুটে ওঠে।
ইসলামের ইতিহাস, ধর্ম, আইনশাস্ত্র, দর্শন বিষয়ে সুপন্ডিত হয়ে উঠেন।
মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তিতুমীর কুস্তিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নেন এবং পরবর্তীতে একজন দক্ষ কুস্তিগীর হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন।
বহু প্রতিভার অধিকারী তিতুমীরের নেতৃত্ব ণ্ডন ছিল সহজাত, স্বাভাবিক। ১৮২২ সালে হজ পালনের জন্য তিনি মক্কা শরীফ যান এবং সেখানে বিখ্যাত ইসলামি ধর্মসংস্কারক ও বিপ্লবী নেতা সাইয়িদ আহমদ বেরেলীর সান্নিধ্য লাভ করেন। সাইয়িদ আহমদ তাকে বাংলার মুসলমানদের সঠিক ভাবে ইসলামিক রীতিনীতি শিক্ষা ও অনুশীলনের ণ্ডরুত্ব সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করেন। এবং বিদেশি শক্তির পরাধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করার ণ্ডরুত্বও তুলে ধরেন।
মীর নিসার আলী তিতুমীর, সৈয়দ আহমদ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তার কথা, বক্তব্য তিতুমীরকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। ৫ বছর পর- ১৮২৭ সালে মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিতুমীর চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় মুসলমানদের মাঝে প্রচার শুরু করেন।
তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদ শুরু করেন। তিনি তৃণমূলের সাধারণ জনগণ ও গ্রামের কৃষক শ্রেণীকে সংগঠিত করেন। তার কথায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে।
সৈয়দ আহমদ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত মীর নিসার আলী তিতুমীর তার কথা, বক্তব্য গভীর ভাবে প্রভাবিত হন । ১৮২৭ সালে মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিতুমীর চবিবশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় মুসলমানদের মাঝে প্রচার শুরু করেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদ শুরু করেন। তিনি তৃণমূলের সাধারণ জনগণ ও গ্রামের কৃষক শ্রেণীকে সংগঠিত করেন। তার কথায় মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। তিতুমীর ১৮৩১ সালের ২৩ অক্টোবর বারাসতের কাছে নারিকেলবাড়িয়ায় এক বৃহৎ বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। দেশীয় প্রযুক্তি ও কাঁচা মালের সংমিশ্রণে বাঁশ এবং কাঁদা দ্বারা শক্ত গাঁথুনির দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা তিনি তৈরী করেন।
প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা এবং কৃষকদের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে তিতুমীর একই সঙ্গে নিয়মিত এক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তাদের লাঠি ও অপরাপর দেশিয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দান করেন।
মুসলমানদের প্রতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং তাদের উপর অবৈধ কর আরোপের জন্য হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের সঙ্গে তিতুমীরের সংঘর্ষ বাঁধে। কৃষককুলের উপর জমিদারদের অত্যাচার প্রতিরোধ করতে গিয়ে অপরাপর জমিদারদের সঙ্গেও তিতুমীর অচিরেই সংঘর্ষে লিপ্ত হন।
এ অত্যাচারী জমিদাররা ছিল গোবরডাঙার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তারাগোনিয়ার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গৌরীপ্রসাদ চৌধুরী এবং গোবরা-গোবিন্দপুরের দেবনাথ রায়। এসব ইংরেজ পদলেহী জমিদার কুল তিতুমীরের সাথে পেরে না উঠে- বিভিন্ন ভাবে ইংরেজ কে তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে।
তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে জমিদারগণ তার বিরুদ্ধেসম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করে কিন্তু তারা তাদের সমবেত শক্তিতেও তিতুমীরের সামনে টিকতে পারে না। গোবরডাঙার জমিদারের প্ররোচনায় মোল্লাহাটির ইংরেজ কুঠিয়াল ডেভিস তার বাহিনী নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং যুদ্ধে পরাজিত হন। তিতুমীরের সঙ্গে এক সংঘর্ষে গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হন। বারাসতের কালেক্টর আলেকাজান্ডার বশিরহাটের দারোগাকে নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান করে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। এ সময়ে তিতুমীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের নিকট জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি।
অচিরেই তিতুমীরের বাহিনীতে সৈনিক সংখ্যা পাঁচ হাজারে উপনীত হয়। সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে সরাসরি তাকে তখন ব্রিটিশের বিরুদ্ধেই নামতে হয়। তিতুমীর চবিবশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলায় স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই অঞ্চল তখন এক প্রকার স্বাধীন মুক্ত অঞ্চল হিসাবেই গণ্য হয়।
অবশেষে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ স্থানীয় পদাতিক, কামানসহ গোলন্দাজ সৈন্যের এক নিয়মিত বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।
১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনী বাশের কেল্লার উপর আক্রমণ চালায়। কামান ও আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে তিতুমীর তার স্থানীয় অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে বাঁশের কেল্লায় আশ্রয় নেয়। ইংরেজরা কামানে গোলাবর্ষণ করে কেল্লা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। তিতুমীরের বিপুল সংখ্যক সৈনিক প্রাণ হারায়।
কয়েকদিন রক্তক্ষয়ি যুদ্ধের পর ১৯ নভেম্বরে বহুসংখ্যক অনুসারিসহ তিতুমীর শহীদ হন । অধিনায়ক গোলাম মাসুমসহ ৩৫০ জন বিপ্লবী সৈনিক ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। গোলাম মাসুম মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন।
এই যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাবার সব সুযোগ থাকা সত্বে ও তিতুমীর উদাত্ত কণ্ঠে তার অনুসারীদের সামনে বলেছিলেন ”’আজকের এ যুদ্ধ হারা জেতার জন্য নয় – এ যুদ্ধ আগামী প্রজন্মের সামনে এক মিসাল , দৃষ্টান্ত স্থাপনের। ” -দেশের জন্য তিতুমীরের এ জীবন দা ন বৃথা যায় নি। ইতিহাস , দেশ ও জাতি আজও তিতুমীর কে শ্রেষ্ট বীরের মর্যাদায় স্মরণ করে।
তিতুমীর ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বারাসত মহকুমার চাঁদপুর / হায়দারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আর ১৮৩১ সালের – ১৯ নভেম্বরে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে শহীদ হন। বহুসংখ্যক অনুসারিসহ তিতুমীর নিজ হাতে গড়া বাঁশের কেল্লার মাঝেই যুদ্ধ রত অবস্থাতেই তিনি শাহাদৎ বরং করে নেন।
দু’হাজার চার সালের ( ২০০৪’ )- ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বিবিসি বাংলা একটি ‘ – জরিপ’-এর আয়োজন করেন । বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো হয় এই জরিপ। এই জরিপের শীর্ষ ২০ (কুড়িজন ) বাঙালির তালিকায় ১১ তম স্থানে আসেন মীর নিসার আলী তিতুমীর।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।