প্রফেসর ড. জসীম উদ্দিন আহমদ
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত জনগনের অবিসংবাদীত নেতা। গত ১৭ নভেম্বর মাওলানা ভাসানীর ৪৫তম মির্তু বার্ষিকী পালিত হলো দেশে বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এর কিছুদিন আগে অক্টোবরে ভাসানীর ঐতিহাসিক চীন সফরের ৫৮ বছর পূর্ন হলো। মাওলানা ভাসানী ১৯৬৩ সালে চীনের ১৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎযাপন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে ১ অক্টোবরের টিয়ানানমান স্কোয়ারের অনুস্ঠানে অংশ গ্রহন করেছিলেন। এই সময় মূল মঞ্চে ভাসানী চেয়ারম্যান মাও এবং প্রধানমন্ত্রী চু এন লাই এর মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বের সূচনা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সূচনা হয়ে দিনদিনই শক্তিশালী হচ্ছে। এতে মাওলানা ভাসানী, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও কাজী জাফর ণ্ডরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাসানীর অবদানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার স্কুল পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক থেকে ভাসানীর জীবনী বাদ দিয়েছে। কিন্ত জনগণের অন্তরে ঠাঁই পাওয়া ভাসানীকে এত সহজে মুছে ফেলা যাবেনা। তাইতো এবার ভাসানীর মির্তু বার্ষিকীতে দেশ বিদেশে ভাসানী স্মরণে বহু অনুষ্ঠান হচ্ছে।
ভাসানী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ভারতে বিশেষ করে আসামে ণ্ডরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ১৯৪৭ সালের ১০ মার্চ আসামে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়। ওই দিন সকালে ভাসানী ব্রিটিশ সরকারের জারিকৃত গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়ানোর জন্য ব্রহ্মপুত্র নদী একটি ছোট নৌকায় পার হয়ে গরুর গাড়িতে করে অনেক পথ অতিক্রম করে তাজপুরের টাউন হল মাঠে পৌঁছেন, যেখানে হাজার হাজার কৃষক সমবেত হয়ে বাংলা ও আসামকে অন্তর্ভূক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করছিল। মুসলিম লীগ এই কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তিনি বক্তৃতায় হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ওপর জোর দেন এবং বলেন এই আন্দোলন বিট্রিশ রাজের বিরুদ্ধে, কোন ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিপক্ষে হয়। তিনি আসামে থাকার সময়ই কৃষকের সংগঠিত করে বেগবান আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। পরে তিনি সিলেট এসে ব্যাপক গন যোগাযোগ করেন যাতে ওই অঞ্চলের জনগন পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দেয়, মূলতঃ তাঁরই প্রচেষ্টায় ওই অঞ্চলে পাকিস্তানের পক্ষে ৯৬% এর বেশী ভোট পরে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই মওলানা ভাসানী উপলব্দি করেন যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বাত্মক সমর্থন গিয়েছিল, তা পুরন হওয়ার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সুধী সমাবেশে ঘোষণা করেন “উর্দ্দু কেবল মাত্র উর্দ্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”। ছাত্র সমাজ রাষ্ট্রভাষা মতিনের নেতৃত্বে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। পরবর্তিতে মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য আন্দোলনরত ছাত্র জনতার উপর পুলিশের ণ্ডলি বর্ষনের ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ অনেকে শাহাদত বরণ করেন। ভাষা আন্দোলন ক্রমে ক্রমে গণ দাবীতে পরিণত হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ভাসানী ১৯৫০ দশকের প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের দাবিতে আন্দোলন করেন। তিনি প্রথম পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীতে ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য রাজনৈতিক দলটির নুতন নামকরণ করেন আওয়ামী লীগ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়। যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় লাভ করে এবং পাকিস্তানেও সরকার গঠনের মত আসনে বিজয়ী হয়। কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দীকে প্রধান মন্ত্রি করে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়।
১৯৫৭ সালের ৬-১০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়। একই ভাবে পাকিস্তানের মার্কিন নেতৃত্বাধীন “সিয়াটো” এবং “সেনটো” সামরিক চুক্তিতে যোগদানের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। এই সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী পাকিস্তানকে হুশিয়ার করে বলেন পূর্ব পাকিস্তানের উপর এই ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ অব্যাহত থাকলে এই অঞ্চলের জনগন অচিরেই পাকিস্তানকে ”আসসালামু আলাইকুম” জানাতে বাধ্য হবে।
মূলতঃ তখন থেকেই ভাসানী এই অঞ্চলের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ বপন করেন।
এর পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মওলানা ভাসানী দেশের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের জন্য ভাসানীকে অনেকেই “স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা” বলে অভিহিত করেন।
১৯৬০ দশকের প্রথম থেকেই যখন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়ে পরি, তখন থেকেই ভাসানীর অনুসারী হয়ে পরি। নরসিংদীর শিবপুরের সন্তান হওয়ায় বিভিন্ন কর্ম কান্ডে ভাসানীকে পর্যবেক্ষণ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
১৯৬৯ দশকের শেষ দিকে ছাত্র রাজনীতির পর আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাবেক মহাসচিব) ভাসানীর নির্দেশে শিবপুর অঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি আমাদের রাজনৈতিক চেতনাকে শাণিত করার পেছনে বেশ ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তারই নেতৃত্বে আসাদ ভাই, তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া, তোফাজ্জল হোসেন খান, আবুল হারিস রিকাবদার (কালা মিঞা), আওলাদ হোসেন খান, ঝিনুক খান, মান্নান খান, আব্দুল আলী মৃধা, সফদারসহ আমরা চিন্তা চেতনা ও বিশ্বাসে দৃঢ় থেকে একই সঙ্গে কাজ করেছি। ১৯৬৫এর আন্দোলন থেকে ৬৯এর ছাত্র-গণ আন্দোলনে আমরা শিবপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সংগঠনকে বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হই।
১৯৬৮এর শেষ দিকে মওলানা ভাসানী আইয়ুব-মোনেম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বেগবান করার আহবান জানান। লাট ভবন ঘেরাও এবং পরদিন ঢাকা শহরে সর্বাত্মক হরতাল থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এর পর ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার সর্বত্র হাট বাজারে হরতালের ডাক দেন। তিনি তহশীল অফিস ঘেরাও ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এই আহ্বানে শিবপুর অঞ্চলে ব্যাপক সাড়া পড়ে। ২৯ ডিসেম্বর শিবপুরের পাশের হাতিররদিয়া বাজারে আসাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে হরতাল পালনের সময় পুলিশ আসাদ ভাই সহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে, জনতা ওদেরকে মুক্ত করে নেওয়ার সময় পুলিশ নির্বিচারে ণ্ডলি বর্ষণ করে। সিদ্দিকুর রহমান ও আরও তিনজন কৃষক শহীদ হন, আসাদ ভাই আহত হন। আহত অবস্থায় আসাদ ভাই পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা আসেন এবং খবরটি তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় পৌঁছে দেন।
হাতিরদিয়া খবরের শিরোনামে চলে আসে, দেশ ব্যাপী বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাতিরদিয়ায় ঘটনার পরই আসাদ ভাইকে প্রধান অভিযুক্ত করে পুলিশ মামলা রুজু করে, তার নামে হুলিয়া জারি হয়। ঐ অঞ্চলের কৃষক সমিতির নেতা কর্মী ও সাধারণ জনগণের ওপর পুলিশি নির্যাতন চলতে থাকে। আসাদ ভাই সকলের সাথেই গোপনে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন, এতে কর্মীদের মনোবল অটুট রাখায় বেশ সহায়তা করে।
হাতিরদিয়ার কৃষক হত্যা ও পরবর্তী পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে হাতিরদিয়া এবং শিবপুরে প্রতিবাদী জনসভার প্রোগ্রাম দেন মওলানা ভাসানী। সভার দিন শিবপুরের সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারী করে স্থানীয় প্রশাসন। সভাস্থলের চারদিকে পুলিশ বেষ্টনী তৈরী করা হয় আর প্রতিবাদী লোকজন যাতে সভায় আসতে না পারে সেই জন্য বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেয়া হয়। মজলুম জননেতা ভাসানী ঢাকা থেকে এসে গাড়ি থেকে নেমে সোজা পুলিশ বেষ্টনী পার হয়ে সভাস্থলে পৌঁছেই মোনাজাতের মাধ্যমে জালিম শাহীর বিরুদ্ধে তাঁর স্বভাবসুলভ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করেন। চার দিকে থেকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত জনস্রোত আসতে থাকে, অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই পুরো মাঠ ভরে যায়। ভাসানী বক্তৃতায় স্বৈরাচার ও জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সব ধরনের দমন নির্যাতন বন্ধ করার জন্য পুলিশকে হুঁশিয়ার করেন।
হুলিয়া মাথায় নিয়েই আসাদ ভাই হঠাৎ করে সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেন এবং সবধরনের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করার জন্য সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
হাতিরদিয়ায় ঘটনায় সারা দেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ হঠাৎ করেই ফেটে পড়তে থাকে।
গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আসাদ ভাই প্রথমে কিছু দিন ঢাকায় আত্মগোপন করে থাকেন। পরে কৌশলগত কারনে পরিচয় গোপন করে নরসিংদীর চরাঞ্চল, বাঞ্ছারামপুরে এক স্কুলে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি নেন।
১৯ জানুয়ারি, ১৯৬৯ আসাদ ভাইকে নিয়ে আমরা সন্ধ্যার প পাবলিক লাইব্রেরি চত্তর থেকে রমনা রেসকোর্স মাঠের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্টেডিয়ামে যাই। পরদিন সকালেই বিশেষ প্রয়োজনে আসাদ ভাইয়ের ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা। স্টেডিয়ামের প্রভিন্সিয়াল রেস্টুরেন্টে চা নাস্তা খাওয়ার সময় আমি আসাদ ভাইকে বললাম ু“আগামী কাল আমরা, ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবো, ঢাকায় এখন আন্দোলনের এত ব্যাপকতা আর এই সময় আপনি ঢাকা ছেড়ে যাবেন?” আসাদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, “যেতেতো মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা, তবুও বিশেষ প্রয়োজনে যেতে হবে, আর পরিবারেরও প্রচন্ড চাপ”।
পরের দিন ২০ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বটতলার সভা শেষে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আমরা মিছিল বের করি। ফুলার রোড ধরে সলিমুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে শহীদ মিনারের রাস্তায় উঠছি। আমি স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছি, এই সময় কাঁধে কারো স্নেহ স্পর্শ। পেছনে ফিরে দেখি আসাদ ভাই। আমি বললাম ু“আসাদ ভাই, আপনি এখানে? আজ সকালেতো আপনার ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা।“তিনি বললেন, “তোমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় মিছিল করবে আর আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাবো তা কেমন করে হয়? মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলনা।“ চির সংগ্রামী আসাদ ভাই এভাবেই সব ভীরুতা আর কাপুরুষতাকে জয় করেছিলো।
এর পর আমরা পরষ্পরের হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে স্লোগান দিতে দিতে মেডিক্যাল কলেজের মোড় পর্যন্ত যাই। ওখানে পুলিশ আকস্মিক ভাবে মিছিলের মাঝখানে আক্রমণ করে। আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই, আমি মিছিলের সামনেরও অংশের সাথে নাজিমুদ্দিন রোড হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যাই, ওখানে মিছিলের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। ওখান থেকে রিক্সায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসি, এসেই দেখি থমথমে নীরবতা। শুনি আমাদের প্রিয় আসাদ ভাই পুলিশের ণ্ডলিতে শহীদ হয়েছেন। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলনা, তবে অল্পক্ষণের মাঝেই সব সন্দেহের অবসান হয়।
আসাদ ভাই ছিলেন এক আপোষহীন সংগ্রামী নেতা। তার জীবনের লক্ষ্য ছিলো এদেশের কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আনয়ন করা। কৃষক সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে একটি শোষণহীন গনতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের স্বপ্ন তিনি জীবনভর লালন করেছেন। তাই কবি শামসুর রাহমান কথায় “আসাদের রক্তে ভেজা শার্ট আমাদের প্রাণের পতাকা”।
আসাদ বাইরের লাশ মেডিকেল কলেজ থেকে পুলিশের চোখ এড়িয়ে পরিবাবের হাতে তুলে দিতে নাজমা শিখা (পরবর্তীতে আমার স্ত্রী) মেডিকেলের ইন্টার্নী ডাক্তার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ড. আশিক ও অন্যান্যরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। আসাদের রক্ত মাখা সার্টটি নাজমা শিখা তার বাগে করে লুকিয়ে হলে নিয়ে আসে, পরদিন হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মিছিলে একটি বাঁশের লাঠির আগায় সার্টটি নিয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দেয়।
আসাদ ভাইয়ের শাহাদতের ৪ দিন পর, ২৪ জানুয়ারি শহীদ হন মতিয়ার রহমান। মওলানা ভাসানী সন্তোষে এক সমাবেশে আহবান করেন এবং সন্তোষের নামকরণ করেন “আসাদ নগর হিসেবে”। ভাসানী শিবপুর শহীদ আসাদ স্মরণে অনুষ্ঠিত জনসভায় ঘোষণা করেন শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া হবেনা, অবশ্যই আয়ুব-মোনেম শাহীর পতন হবে। ঊনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, পতন ঘটে আইয়ুব শাহীর। তাই এ কথা বেশ দৃঢ়তার সাথে বলা যায় যে, শহীদ আসাদের আত্মত্যাগ ব্যতীত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণতা লাভ এত দ্রুত কোন ভাবেই সম্ভব হতোনা। এতে আমরা ণ্ডরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছি বলে গর্বিত।
১৯৭০ সালে জাতীয় জীবনে বেশ কিছু ণ্ডরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ৩ নভেম্বর ভোলাসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডো আঘাত হানে, যাতে ৫ লক্ষের বেশী প্রাণহানি ঘটে। ইতিমধ্যে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান লিগ্যাল ফ্রেইম ওয়ার্ক আদেশের অধীনে ৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন ঘোষণা করেন। জাতীয় নেতাদের ভেতর মওলানা ভাসানী সর্বপ্রথম দুর্গত এলাকা পরিদর্শনে যান, ফিরে এসে পল্টনের এক জনসভায় ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের করুন পরিস্থিতি বর্ণনা করে নির্বাচন পেছানোর দাবি করেন, তা না হলে নির্বাচন বয়কটের হুঁশিয়ারি দেন। শামসুর রহমান ওই সভায় মওলানা ভাসানীর ভাষণকে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে “সফেদ পাঞ্জাবী” নামে একটি কবিতা লিখেন, যা যুগ যুগ ধরে ভাসানী অনুসারীদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
ইয়াহিয়া খান পিন্ডিতে এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। ভাসানী ওই বৈঠক বর্জনের ঘোষণা দেন। শেখ মুজিব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কারারুদ্ধ এবং বিচারের মুখোমুখি। তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে চাইলেন। ভাসানী ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই গোল টেবিল বৈঠকের আগে মুক্তি দিতে হবে। ভাসানীর নেতৃত্বে তীব্র গন আন্দোলনের মুখে ইয়াহিয়া খান আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।
আওয়ামী লীগ ঘোষিত তারিখেই নির্বাচনে অংশগ্রহনের ব্যপারে অনড় থাকে। ভাসানী ন্যাপের অংশগ্রহণ ছাড়াই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে ২ টি ছাড়া বাকি সব আসনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। অনেকের মতে মওলানা ভাসানী ওই নির্বাচন বয়কট করেছিলেন যাতে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সংগ্রামকে পূর্ণতা দিতে পারে।
১৯৭১ সালের প্থম থেকেই ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন। তিনি ফেব্রুয়ারিতে পল্টনের এক জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং নেতা কর্মীদের প্রস্তুতির আহবান জানান। মান্নান ভাইয়ের নেতৃত্বে শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে।
১৯৭১ সালে প্থম জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান করে পরে তা স্থগিত করা হয়। মার্চে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং অন্যদিকে গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকে। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকা সহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। শেখ মুজিব অন্তরীণ হন। ২৭ মার্চ চট্রগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া প্রথমে নিজে এবং পরে শেখ মুজিবের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। সন্তোষের ভাসানীর কুঁড়ে ঘর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। ভাসানী ভারতে পাড়ি জমায়, ভাসানীকে আহবায়ক করে সর্বদলীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়। এ দিকে শিবপুরে মান্নান ভাইয়ের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বামপন্থী নেতা কর্মী ও ভাসানী অনুসারীরা এসে যোগ দিতে থাকে। কাজী জাফর, জামাল হায়দার, হায়দার আনোয়ার খান জুনো, আতিকুর রহমান সালু, কাজী সিরাজ, শাহরিয়ার আক্তার বুলু, মাহবুবা রাশিদা চপল সহ অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে শিবপুরের মান্নান ভূঁইয়ার মুক্তাঞ্চলে থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও অংশ গ্রহনে ণ্ডরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ভাসানী ভারত থেকে ফিরে এসে প্রথমেই ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি তুলেন। পরে স্বাধীনতার অন্যতম প্রত্যাশা কৃষক শ্রমিকদের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার দাবি তুলেন। তিনি ১৯৭২ সালের শেষ দিকে শিবপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্থম দুই দিন ব্যাপী এক কৃষক সম্মেলনের ঘোষণা দেন। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ওই সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় দুই লক্ষাধিক লোক অংশ গ্রহন করে। তিনি প্রতিবেশী দেশের বিভিন্ন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান।
ভাসানী জীবনভর খেটে খাওয়া মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন, আর দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি বাংলাদেশের উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চের আয়োজন করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া ওই লং মার্চে নেপথ্য থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছিলেন। এর পর পর জিয়াউর রহমান জাতিসংঘে ফারাক্কা পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেন, এবং ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে একটি গ্যারান্টি ও আর্বিটেশন ক্লস যুক্ত চুক্তিতে উপনীত হতে বাধ্য হয়।
ভাসানীর মাধম্যে গণচীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল তা ধীরে ধীরে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমান ভু-রাজনৈতিক পরিসি্হতিতে এই সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। চীনই আমাদের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য কর্মকান্ডের বিশ্বত্ব বন্ধু। চীনের পাওয়ার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি তিস্তা বেসিন উন্নয়নে প্রায় ৮০০০ হাজার কোটি টাকার এক মহা পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার মানুষের জীবন যাত্রায় যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে সন্দেহ নেই। তাই জাতীয় স্বার্থে এই প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
বর্তমানে যখন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব প্রতিবেশী দেশের পানি, অর্থনেতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বহুমুখী আগ্রাসনের মুখে, তখন ভাসানীর আদর্শ, “আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখার সংগ্রামে শামিল থাকা”, আমাদের সকলের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে।