বিলকিস আগেভাগেই চলে এসেছে। সঙ্গে দুই বাচ্চা। সমস্যা হলো, বাচ্চা দুটো একেবারেই কথা শুনছে না। একটা অন্যটার কান কামড়ে ধরছে, নয়তো পেটে গুঁতা মারছে; আবার কখনও এ ওর পিঠের ওপর দু’পা তুলে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করছে। বিলকিস নিশ্চিত- এসব দেখে কেউ বলবে না এরা ছাগলের বাচ্চা; বরং বলবে বান্দরের বাচ্চা। বিলকিসের মনে হলো, বাচ্চাদের বাঁদরামির কারণ একটাই- এদের এখনও বিচি কাটা হয়নি। বিচি না কাটানোর ফল যে মারাত্মক হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাচ্চাদের হারামিপনা দেখতে দেখতে বিলকিস আপন মনে বলল-মোকাম্মেল হোসেন
: চান্দুরা! যতই পল্টুগিরি করো, খিদা লাগলে মায়ের কাছে আসতে হবে। তখন দুই ঠ্যাংয়ের চিপায় ফেলে এমন টাইট দিব, বাপের নাম ভুলতে দেরি হবে না।
বাচ্চাদের বাপের প্রসঙ্গ উঠতেই বিলকিসের চোখের সামনে একটা গাট্টুগুট্টু পাঁঠার চেহারা ভেসে ওঠল। বছরে মাত্র দু’বার তার সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হওয়ার পর গৎবাঁধা কিছু সংলাপ আওড়ায় সে। ব্যস! এরপর আর কোনো খোঁজ-খবর নেই! এসব কথা ভাবতে ভাবতে বিলকিসের মনে হলো, বাপছাড়া ছাগল-সংসারে বাচ্চাকাচ্চা যে ‘ছাগল’ হয় না; বান্দর হয়- এর প্রমাণ তার মহাত্যান্দর দুই বাচ্চা, যাদের মাথার মধ্যে সারাক্ষণ শুধু ইতরামির চিন্তা। এজন্যই বাচ্চাদের সঙ্গে আনতে চায়নি বিলকিস। পরে মনে হয়েছে- দুধের বাচ্চা, এখনও ঘাস খাওয়া শিখেনি; বাড়িতে রেখে এলে খিদায় ট্যা-ট্যা করবে। তাই সঙ্গে এনেছে। কিন্তু সঙ্গে আনার ফল যে শুভ হয়নি, এর প্রমাণ তারা দিচ্ছে। আদবলেহাজের বেড়া ভেঙ্গে দশজনের সামনে বিটলামিতে মত্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা যে তাদের ছাগমাতাকে লজ্জার সাগরে নিমজ্জিত করছে, এই বোধ-বুদ্ধিও তাদের নেই। অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শুরু হলেই ভালো। সন্ধ্যার আগে অবশ্যই বাড়ি পৌঁছতে হবে। তা না হলে ডাক-খোঁজ শুরু হয়ে যাবে। তাছাড়া রাস্তায় শিয়াল ও তস্করের ভয় আছে। বিলকিস ভেবে দেখল, এই একটা ক্ষেত্রে মানুষ ও ছাগলের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। চলার পথে মানুষের জন্য যেমন নানা আপদবিপদ ওৎ পেতে থাকে, তেমনি ছাগলদের ক্ষেত্রেও।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নানা রঙের, নানা বয়সের ছাগল-খাসি অনুষ্ঠানস্থলে আসতে শুরু করল। অনেকেই আসছে দলবেঁধে, আবার কেউ আসছে একা। মঞ্চে ছোকরা বয়সী এক খাসি ‘ওয়ান-টু মাইক্রোফোন টেস্টিং’ বলে মাইকের আওয়াজ পরীক্ষা করছে আর একটু পরপর তেরছা চোখে তাকিয়ে বিলকিসের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। বিলকিস মুচকি হাসল। মানব সমাজে পরকীয়া জিনিসটার ব্যাপক মাত্রায় বিস্তৃতি লাভের কথা সে শুনেছে। সেই সে াতে গা ভাসাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বিলকিসের। সে ঘুরে দাঁড়াল আর তখনই চোখে পড়ল- ছোটবেলার বান্ধবী মর্জিনা হেলেদুলে তার দিকে এগিয়ে আসছে। দুই বান্ধবী পরস্পরকে দেখে প্রচণ্ড খুশি হলো। আহা! কতদিন পর দেখা! বিলকিস বলল-
: আমি তো ভাবছিলাম, তুমি দূরে কোথাও চইলা গেছ; এই জীবনে তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
মর্জিনা বলল-
: আমি তোমারে লইয়া আরও খারাপ আশঙ্কা করছিলাম। যাক, আল্লাহ মেহেরবান; আমরা দুইজনেই সহি সালামতে বাঁইচ্যা আছি।
এ সময় মাইকে অনুষ্ঠান শুরুর ঘোষণা ভেসে এলো। টাই-স্যুট পরা এক তরুণ খাসি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল-
: সম্মানিত সুধী, ভাই-বোন-বন্ধু; আজকের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাইতেছি। ডেব্বারচরের সুবিশাল খোলা প্রান্তরে শ্রাবণের বৃষ্টিস্নাত স্নিগ্ধ পরিবেশে বরাবরের মতো এইবারও আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হইতেছে ছাগল সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। ছাগল সঙ্গীত পরিবেশন করবে এ সময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড ব্যা-ব্যা।
ব্যা-ব্য্য ব্যান্ডের গায়ক ও বাদক দল মঞ্চে এসে গান ধরল-
: আমরা ছাগল
নই তো পাগল
আমাদেরও আছে মানসম্মান
হো হো হো, দেশের উন্নয়নে আছে বিরাট অবদান…
সঙ্গীত শেষ হতে না হতেই ক্ষুরতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ। এরপর মঞ্চে এলো ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারী আনছাগ। গলা ঝেড়েমুছেু পরিষ্কার করে সে বলল-
: সবাইকে ঈদ-উত্তর শুভেচ্ছা। আপনারা জানেন, প্রতি বছর কোরবানির ঈদের পরে আমরা একটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন কইরা থাকি। আসলে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা মৃত্যুর একটা পরিসংখ্যান তৈরির প্রয়াস চালাই। আমরা বের করার চেষ্টা করি, এইবারের ঈদে কতজনরে আমরা হারাইছি। তাই আজকের অনুষ্ঠানের নামের মধ্যে মিলন শব্দটা থাকলেও আমাদের অন্তরে বিরাজ করতেছে বিরহের চাপা কান্না। তবে একটা ব্যাপারে আমি খুই গর্বিত। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, একেকবছর কোরবানির বাজারে বাংলার রাজা, বাংলার নবাব, বাংলার নওজোয়ান, বাংলার পাঠান ইত্যাদি নামডাকের নিশান উড়ানো হইলেও আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি হওয়ার যে মহিমা ও সম্মান, এককভাবে তার স্বীকৃতি পাইছি কেবল আমরা। আর তাই কোরবানির ঈদের আরেক নাম বকরি ঈদ হইছে। আপনারা কি কখনো শুনেছেন- কেউ এইটারে গরু ঈদ, উট ঈদ বা মহিষ ঈদ বলতেছে? না, এইরকম কথা কেউ বলে না; বরং বলে বকরি ঈদ। আমি মনে করি, এইটা ছাগল জাতির জন্য একটা মহাসম্মানের ব্যাপার।
এরপর বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তৃতা করতে মঞ্চে যে এলো, তাকে দেখে বিলকিস ও মর্জিনা একসঙ্গে ফিক করে হেসে উঠল। আহা রে বেচারা- বয়স হয়েছে; কিন্তু ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, মনে ফূর্তির কোনো ঘাটতি নেই। বুড়া মিয়া পাছা দুলিয়ে শিং হেলিয়ে কিছুক্ষণ নাচল। এরপর ফ্যাসফ্যাসে বলল-
: আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। বন্ধুরা, বর্তমানে আমি আমার লাইফের বোনাস টাইম পার করতেছি। কীভাবে? বিষয়টা তাইলে খুলে বলি। এইবার ঈদে আমার কতল হওয়ার শতভাগ আশঙ্কা ছিল; কিন্তু বাজারে ছাগলের দাম পইড়া যাওয়ায় মালিকপক্ষ শেষ পর্যন্ত আমারে বিক্রির সিদ্ধান্ত রহিত করেছে। নতুন জীবন পাওয়ায় আমি যে খুবই খুশি হইছি, এইটা আপনেরা আমার হাবভাব দেইখাই বুঝতে পারতেছেন। তবে বন্ধুরা, নিজের মূল্যমান হ্রাসে খুশি হইলেও কোরবানি হওয়া বীর ছাগল সম্প্রদায়ের চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টা আমারে ব্যাপক দুঃখ দিছে। বুঝলাম, করোনাকালে আর্থিক সংকটে পড়ায় অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোবরবানি দিতে পারে নাই; তাই ছাগলের দাম বাড়ি খাইছে। কিন্তু চামড়ার কী হইছে? বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম তো গত বছরের চাইতেও চড়া। তাইলে বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা বাংলার কালো ছাগলের চামড়া এক-একটা মাত্র ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হবে কোন যুক্তিতে? এর পশ্চাতে মুনাফাখোর গোষ্ঠীর বড় ধরনের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র আছে, এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। উপস্থিত ভাইবোনেরা, আপনেরা যদি সম্মিলিতভাবে এখনই এই চক্রান্ত প্রতিহত করার উদ্যোগ না নেন, তাইলে দুনিয়ার বুকে ছাগল জাতির ইজ্জত বইলা কোনো জিনিসের অস্তিত্ব থাকবে না, এইটা আমি কইয়া রাখলাম।
অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে ঘোষকের কণ্ঠে যার নাম উচারিত হলো, সে এ এলাকায় সম্পূর্ণ অপরিচিত। অপরিচিত বক্তা বলল-
: আপনেরা আমারে চিনবেন না; কারণ, আমি এই এলাকার বাসিন্দা না। আমার পরিচয়- আমি আলোচিত-সমালোচিত কালাচাঁনের খালাত ভাই। আমি বোরোরচর থেইকা আপনাদের মাঝে হাজির হইছি শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায়। আমার খালাত ভাই কালাচাঁন ছিল খুবই সম্ভাবনাময় এক তরুণ খাসি। সে ছবি আঁকত, গিটার বাজাইত। সবচাইতে বড় কথা, সে ছিল রোমান্টিক গীতিকবি। এই বয়সেই সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে গীত রচনা কইরা সে তার বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেছিল। কিন্তু আফসোস! এরকম একটা প্রতিভার মূল্যায়ন তো হয়ইনি; বরং প্রশাসন তারে জেল-জরিমানার পাশাপাশি নানাভাবে হেনস্থা করছে। প্রশাসন যদি কালাচাঁনের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ ও জরিমানা না করত, তাইলে হয়তো তার মালকিন এইবারের ঈদে তারে বিক্রি করত না এবং এর ফলে তাকে ছুরির নিচে মাথা পাইতা দিতে হইত না। কালাচাঁনের পুরা বিষয়টা মিডিয়ায় আসছে। আপনেরা সবকিছু জানেন, তাই এই বিষয়ে কথা না বাড়াইয়া আজকের সমাবেশে আমি শুধু একটা প্রশ্ন রাখতে চাই- কী অপরাধ ছিল আমার খালাত ভাইয়ের? কেন তাকে এইভাবে অকালমৃত্যুর শিকার হইতে হইল?
সম্প্রতি প্রতিবেশি একটা দেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছে ড. চক্করবক্কর। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সে। চেহারায় ডক্টরেট ডিগ্রির জেল্লা ফুটিয়ে তুলে ড. চক্করবক্কর বলল-
: খুবই দুঃখজনক। হৃদয় বিদারক। মর্মান্তিক। সম্ভাবনার আলো-ঝলমল প্রদীপ নিষ্ঠুর ঝড়ো হাওয়ায় নিইভা গেছে। মহাকাল তার মাংস-অস্থি-মজ্জা গ্রাস করেছে। বন্ধুরা, মানুষের হাত আছে; তাই তারা হাতে ফুল নিতে পারে। ছাগলের হাত নাই, কাজেই কালাচাঁন ফুল মুখে তুইলা নিতে বাধ্য হয়েছিল; আর এইটাই কি তার ভুল ছিল? আমি খোঁজ-খবর কইরা জানতে পারছি, খাওয়ার উদ্দেশ্যে ফুল মুখে তুলে নেয়নি কালাচাঁন। সে তার প্রেমিকার জন্য ফুল সংগ্রহ করতে বাগানে প্রবেশ করার পর এই কাণ্ড করেছিল। অথচ মাথাভারী প্রশাসন প্রেমিক মনের কোনোরকম মূল্যায়ন না কইরা উল্টা মিথ্যা কলংক আরোপ করছে। এর ফল কী হইছে, তা সবার জানা। বন্ধুরা, উঠতি বয়সে মাথায় শিং গজাইতে দেইখা আনন্দে আত্মহারা হইয়া আমরা ছড়া কাটতাম- নয়া নয়া শিং গজাইছে, ফিতা কিইন্যা দে। মাঠ প্রশাসনের অনেক নবীন কর্মকর্তার মধ্যেও একই অবস্থা পরিলক্ষিত হইতেছে। অল্প বয়সে অত্যধিক ক্ষমতা হাতে পাওয়ায় তারা দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হইয়া কাউরে থাপ্পড় মারতেছে, কাউরে ঘুষা মারতেছে; আবার কাউরে উষ্টা মারতেছে। কিছুদিন আগে পূর্বপুরুষদের ছাগলনামা পড়ার সময় দেখলাম, এক জায়গায় লেখা আছে- ব্রিটিশ যুগে এই দেশে স্থানীয় প্রশাসনরে সালাম না দিয়া একটা পাখিও সেইখানকার আকাশ অতিক্রম করতে পারত না। অবস্থা দেইখা মনে হইতেছে, আমরা যেন আবার সেই ব্রিটিশ যুগে ফিইরা গেছি। বন্ধুরা, ব্রিটিশদের কোনো প্রেতাত্মা যাতে নতুন কইরা ছাগল সম্প্রদায়ের কোনো ক্ষতি করতে না পারে, সেইজন্য আমাদের সংগঠিত হওয়া দরকার। আমি আগেও বলছি, আবারও বলতেছি- আমাদের প্রধান সমস্যা হইল, আমরা পরস্পর থেইকা বিচ্ছিন্ন। এই সমস্যার সমাধানকল্পে মানবজাতির ‘ফেসবুক’-এর মতো ‘ছাগলবুক’ চালু করা যায় কিনা, ভাইবা দেখার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাইতেছি।
অত্র এলাকার একমাত্র রামছাগল আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি। সে মামুলি দু-চারটা বাক্য উচ্চারণ শেষে বলল-
: চরের পূর্বদিকে কড়ইগাছ তলায় আপনাদের জন্য ‘বুফে’র ব্যবস্থা করা হইছে। যার যে খাবার ভালো লাগে, পেট ভইরা খাবেন; শরমিন্দা হবেন না। সবাইরে ধন্যবাদ।
মোকাম্মেল হোসেন : সহকারী সম্পাদক, যুগান্তর