পলাতক ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ক্রেতা খুঁজছেন, কেউ সাহস করছেন না

দেশের আলোচিত শিল্পোদ্যোক্তা আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবার বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। বিদেশী ক্রেতার পাশাপাশি স্থানীয় একাধিক বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের কাছেও ব্যবসা বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তালিকাভুক্ত কোম্পানি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বাজারমূল্য অনেক বেশি হওয়ায় কেউ এটি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। এর ওপর ফেরারি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিতর্কিত ইমেজের কারণেও পিছিয়ে যাচ্ছেন অনেক ক্রেতা। ফলে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটাতে চাইলেও বর্তমানে কোনো ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছেন না পলাতক এ ব্যবসায়ী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ক্যাডবেরির মূল কোম্পানি মন্দালেজ ইন্টারন্যাশনালের কাছে অলিম্পিকের শেয়ার বিক্রির আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর স্থানীয় বড় করপোরেটদের দ্বারস্থ হন আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবার। এরই মধ্যে দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপ যাদের কাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ রয়েছে, তাদের কাছে ব্যবসা বিক্রির প্রস্তাব দেন তারা। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাও হয়। তবে অলিম্পিকের বাজারমূল্য অনেক বেশি হওয়ার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকালের দর অনুযায়ী অলিম্পিকের বাজার মূলধন ছিল ৩ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের তালিকাভুক্ত আরেক কোম্পানি এমবি ফার্মাসিউটিক্যালসের বাজার মূলধন ছিল ১০৬ কোটি টাকা। এত বড় অংকের নগদ অর্থ বিনিয়োগ করে স্থানীয় কোনো কোম্পানি আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের ব্যবসা কিনতে চাইছেন না। তার ওপর আজিজ মোহাম্মদ ভাই তার ব্যবসা বিক্রি করে দেশের বাইরে অর্থ নিয়ে যাবেন এ বিষয়টিও অনেক ক্রেতাকে ভাবাচ্ছে। কারণ এতে দেশ থেকে অর্থ বাইরে চলে যাবে এবং সরকার বিষয়টিকে কীভাবে দেখবে সেটি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে দেশ ছাড়া বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বও বজায় রাখতে চাইছেন তারা।

দেশের অন্যতম এক কনগ্লোমারেটের কাছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রির প্রস্তাব এসেছিল। তাদের কাছে বেশকিছু নগদ অর্থও রয়েছে। প্রথমে আগ্রহী হলেও পরবর্তী সময়ে এত অর্থ ব্যয় করতে রাজি হননি গ্রুপটির কর্ণধাররা। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি জানান, অলিম্পিক কেনার জন্য আমাদের কাছে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোম্পানিটির শেয়ারদর অনেক বেশি। এত টাকা দিয়ে কে বিস্কুট কোম্পানি কিনতে যাবে? এর চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয়ে নতুন বিস্কুট কোম্পানি খুলে ফেলা যায়। আগের তুলনায় ব্যবসায়িক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন আর আগের মতো ১৫-২০ বছর ধরে পণ্য বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন হয় না। অর্থ ব্যয় করলে দুই বছরের মধ্যেই দেশব্যাপী বিতরণ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সম্ভব। আমাদের কাছে যখন প্রস্তাব আসে, তখন অলিম্পিকের বাজার মূলধন ছিল ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ টাকা দিয়ে চাইলে আমি দুটি ব্যাংক কিনে নিতে পারতাম। সব মিলিয়ে প্রস্তাবটি আমাদের কাছে লাভজনক মনে হয়নি। তাই বিষয়টি আর বেশিদূর এগোয়নি।

দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদকের কাছেও অলিম্পিক কিনে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কোম্পানিটির বিস্কুটের ব্র্যান্ড ভ্যালুর কারণে তারাও এটি কিনতে বেশ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তাদের কাছেও অলিম্পিকের দাম অনেক বেশি মনে হয়েছে। এত বেশি অর্থ ব্যয় করে নতুন কোম্পানি কেনার চেয়ে নিজেদের বিদ্যমান ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেই বেশি লাভ হবে এ চিন্তা করে তারা প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেন।

মন্দালেজের সঙ্গে আলোচনার পর থেকেই বেশ কয়েক বছর ধরে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রি করে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় পুঁজিবাজারে। সে সময় কিছুদিন এ খবরে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছিল। এমনকি কিছু বিদেশী বিনিয়োগকারীও কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কোনো হালনাগাদ তথ্য না থাকায় অনেকটা পাদপ্রদীপের আড়ালে চলে গিয়েছিল ইস্যুটি। তবে বাজারে কিছু বিনিয়োগকারী রয়েছে, যারা অলিম্পিকের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি নিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। এমনই একজন বিনিয়োগ ব্যাংকারের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবারের বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা জানার পর থেকেই আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর রাখছি। গত কয়েক বছরে দেশী ও বিদেশী কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেয়ার বিক্রির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে আমার মতে, স্থানীয় কোনো গ্রুপ এত টাকা দিয়ে অলিম্পিককে কিনবে না। তাছাড়া এত বড় অংকের নগদ অর্থ বিনিয়োগ করলে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে চলে আসবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে এত টাকা পেলেন কোথায়। অন্যদিকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার পরিবার ব্যবসা বিক্রির অর্থ থাইল্যান্ডে নিয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারও অনুমোদন করবে না। যদি কেউ কেনে, তাহলে সেটি বিদেশী বা বহুজাতিক কোনো কোম্পানি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

অবশ্য শেয়ার বিক্রির বিষয়টিকে গুঞ্জন হিসেবে উল্লেখ করে সম্প্রতি অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মীদের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোবারক আলী। এ বিষয়ে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব নাজিমউদ্দীন বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকক থেকে আমাদের এমডি চিঠির মাধ্যমে শেয়ার বিক্রির গুঞ্জনে কান না দিতে বলেছেন। এসব বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্যও নেই। অন্য সবার মতো আমরাও মানুষের কাছে শেয়ার বিক্রির নানা গুঞ্জন শুনে থাকি।

আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পিতা মোহাম্মদ ভাইসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের গুজরাট থেকে। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর তারা এ দেশে আসেন। এ পরিবারের সদস্যরা ‘ইসমাইলি’ সম্প্রদায়ভুক্ত। পূর্ববাংলায় আসার পর ধনাঢ্য এ পরিবার তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে। ১৯৫৯ সালে দেশের প্রথম স্টিল মিল ‘বেঙ্গল স্টিল ওয়ার্কস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন মোহাম্মদ ভাই। বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পে তাকে পথিকৃৎ ধরা হয়। ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জন্ম হয়। তরুণ বয়সে পারিবারিক ব্যবসার পাশাপাশি নিজেও আলাদা ব্যবসা শুরু করেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে বড় হতে থাকে নিজের ব্যবসাও। ১৯৮২ সালে বাজারে অলিম্পিক ব্যাটারি এনে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। দেশের বিস্কুটের বাজারেও শীর্ষ কোম্পানি হিসেবে এখনো অবস্থান ধরে রেখেছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ। তবে আজিজ মোহাম্মদ ভাই সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবে। তার প্রতিষ্ঠিত এমবি ফিল্মস লিমিটেডের প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল অর্ধশতাধিক সিনেমা।

আজিজ মোহাম্মদ ভাই বর্তমানে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক। তার চাচা মুবারক আলী রয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে। মুবারক আলীর ছেলে মুনীর আলীও অলিম্পিকের পর্ষদ পরিচালক। একই দায়িত্বে রয়েছেন মুবারক আলীর দৌহিত্র তানভীর আলীও। দীর্ঘদিন ধরে দেশে না থাকলেও এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই নিজেই। তার স্ত্রী নওরীন আজিজ মোহাম্মদ ভাই কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া কোম্পানিটির পর্ষদে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ভাইয়ের দুই মেয়ে নুরজাহান হুদা ও সাকিনা মিরালি। এর বাইরে ম্যান্টিকোর ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যান্টিকোর টেকনোলজি, এমকো হোল্ডিং, বেঙ্গল পেট্রোলিয়াম ও অক্সাস এন্টারপ্রাইজের পর্ষদেও তারা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন। মুবারক আলীর দৌহিত্র তানভীর আলী কনস্টেলেশন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির পরিচালক। এ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিতে এ পরিবারের আরেক সদস্য আনিসা আমির আলীও রয়েছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অবর্তমানে তার স্ত্রী নওরীন আজিজ মোহাম্মদ ভাই সব ব্যবসার দেখভাল করেন বলে জানা গিয়েছে।

আজিজ মোহাম্মদ ভাই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্রের ভাষ্যমতে, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে মোহাম্মদ ভাই পরিবারের ব্যবসা রয়েছে। দেশে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হত্যাকাণ্ড, মাদক বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে পরিবারটি। এ অবস্থায় বাংলাদেশে থাকা কোম্পানিসহ অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে এ পরিবারের সদস্যরা থাইল্যান্ডে স্থায়ী নিবাস গড়তে চাইছেন। করোনা সংক্রমণ রোধে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা হয় গত বছরের ২৬ মার্চ। এর একদিন আগে মোহাম্মদ ভাই পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে দেশ ছাড়েন। আজিজ মোহাম্মদ ভাই মামলার কারণে দেশে আসতে পারছেন না। মুবারক আলীর বয়স হয়ে গেছে। আগের মতো কোম্পানিকে সময় দিতে পারছেন না তিনি। কোম্পানিটির মালিকপক্ষের নতুন প্রজন্মের সদস্যদের কেউ কেউ নিজেদের পারিবারিক ব্যবসার বাইরে স্বতন্ত্র নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে কোম্পানিটির মালিকরা উপযুক্ত দাম পেলে এটি বিক্রি করে দেয়াকেই শ্রেয় মনে করছেন।

দেশের শিল্পাঙ্গনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র জগতেও বিপুল আলোচিত এক চরিত্র আজিজ মোহাম্মদ ভাই। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মতো সফল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা হিসেবে যেমন তিনি প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনি চলচ্চিত্র অঙ্গনের নানা ঘটনায় বিতর্কিতও হয়েছেন। চিত্রনায়ক সালমান শাহ ও সোহেল চৌধুরীর মৃত্যুকে ঘিরে এখনো আলোচনায় আসে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম। পাশাপাশি ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারের কেলেঙ্কারিতেও তার নাম জড়িয়েছে।

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ