একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওই ভিডিও ফাঁস হওয়ার পর সিনে পাড়ার বিতর্কিত নায়িকা পরীমনি ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েন এখন আলোচনায়। উত্তরার বোট ক্লাবের ঘটনায় মামলার প্রধান তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েন। ভিডিওটিতে দেখা গেছে, রাজারবাগ অফিসার্স মেসে সাকলায়েন তার ফ্ল্যাটে পরীমনিকে নিয়ে গেছেন। ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী একসঙ্গে কাটিয়েছেন ১৮ ঘণ্টা। পরীমনিকে বিয়ে করা, গাড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ও তার বাসায় অবস্থান নিয়ে এখন চলছে সর্বত্র নানা আলোচনা। গোলাম সাকলায়েনের রাজারবাগ অফিসার্স কলোনির মধুমতি ভবনের ৯/সি নম্বরে রয়েছে তার সরকারি ফ্ল্যাট। পরীমনির তার বাসায় দীর্ঘ সময় অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে পুলিশ ও সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।ঘটনার পর ওই কর্মকর্তাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। গতকাল এ বিষয়টি নিয়ে ডিএমপিসহ পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা কথা বলতে বিব্রতবোধ করছিলেন।
তবে যাকে নিয়ে আলোচনা সেই গোলাম সাকলায়েন সাংবাদিকদের জানান, পরীমনির করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে তাকে পরীমনি ফোন করেছিলেন। তার বাসায় পরীমনির যাতায়াত ছিল না এবং তার সঙ্গে সম্পর্কও নেই। ঘটনায় ডিএমপি কমিশনারের এক আদেশে তাকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পশ্চিম) বা দাঙ্গা দমন বিভাগে বদলি করা হয়।
বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপি’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের ডিসি মো. ফারুক হোসেন মানবজমিনকে জানান, বদলির আদেশের আগে সাকলায়েনকে ডিবি’র সব ধরনের দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়।
সিআইডি’র অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ওমর ফারুক বলেন, ডিবি কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন শিথিলের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি খতিয়ে দেখছে সিআইডি।
এদিকে, সাকলায়েনের কী শাস্তি হতে পারে এ বিষয়ে কোনো পুলিশের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তা মন্তব্য করতে চাননি। তারা শুধু বলেছেন যে, ঘটনাটি জানাজানির এবং একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তারা বিষয়টি অবগত হয়েছেন। ডিএমপি’র যে প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ রয়েছে সেখানে দুই সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছেন।
সূত্র জানায়, মামলার প্রয়োজনে তদন্ত কর্মকর্তা একজন বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করাসহ তার সঙ্গে দেখা হতে পারে। কিন্তু, কোন কাজের প্রেক্ষিতে পরীমনি গোলাম সাকলায়েনের বাসায় গেলেন তা তারা খতিয়ে দেখছেন। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের ডিএমপি কমিশনারের নিকট প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পরীমনি গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাসায় প্রবেশ করছেন। এ নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একজন তদন্ত কর্মকর্তা দায়ের করা মামলার বাদীকে এভাবে বাসায় নিয়ে যাওয়া বা সম্পর্ক স্থাপন নীতি-নৈতিকতা বর্জিত এবং পেশাদারিত্বমূলক কাজ নয় বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারাও। জানা গেছে, পহেলা আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে পরীমনির সাদা রঙের হ্যারিয়ার গাড়ি ঢাকা মেট্রো-ঘ (১৫-৯৬৫৩) প্রবেশ করে পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি আবাসিক ভবনের সামনে। সেই গাড়ি থেকে লাল রঙের টি-শার্ট পরিহিত আলোচিত সেই গোয়েন্দা কর্মকর্তা নামেন। এরপর সাদা রঙের স্ল্লিপিং গাউন পরিহিত অবস্থায় নামেন পরীমনি। পুলিশ কর্মকর্তাদের বাসভবনের নিচে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে বাসার চাবি নেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর দু’জন লিফটে করে ওই কর্মকর্তার বাসায় যান। এরপর পরীমনির গাড়ি থেকে একটি ট্রলি ব্যাগও ওই কর্মকর্তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাত দেড়টায় ওই ভবনের সামনে আবার আসে পরীমনির গাড়ি। পুলিশের সন্দেহ হলে পরীমনির চালকের কাছে তার পরিচয় জানতে চান। চালক তখন ওই নিরাপত্তাকর্মীকে বলেন, পরীমনির সঙ্গে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার বিয়ে হয়েছে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, রাত সোয়া দুইটার দিকে পরীমনি তার কুকুর কুটু এবং ওই পুলিশ কর্মকর্তা ও সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ট্রলি ব্যাগসহ বহুতল সেই ভবন থেকে নেমে আসেন। সকালের সাদা পোশাকের পরিবর্তে এ সময় পরীমনির পরনে ছিল কালো রঙের পোশাক আর পুলিশ কর্মকর্তার পরনে সাদা রঙের টি-শার্ট। এ বিষয়ে পরীমনির গাড়িচালক মো. নাজির হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার দিন সকাল ৭টার দিকে পরীমনির বাসা থেকে একসঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও পরীমনি হ্যারিয়ার গাড়িতে করে পুলিশ কর্মকর্তার সরকারি বাসভবনে নামিয়ে চলে যান। আবার রাতে ফোন পেয়ে সেই ভবনের সামনে যান।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ জানান, কোনো মামলার তদন্ত কর্মকর্তার বাদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে মামলাটি প্রভাবিত হতে পারে। এর সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার বিষয় সম্পর্কিত। এটা ঠিক পেশাদারিত্বমূলক কাজ নয়। তবে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের আগেই যেন মিডিয়া ট্রায়াল না হয়ে যায় সে বিষয়েও তিনি সচেতন থাকার পরামর্শ দেন। তিনি আরও বলেন, গত ক’দিন যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তার পেছনে কারা তা খুঁজে বের করা জরুরি। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি সূত্রে জানা গেছে, উত্তরার বোট ক্লাবের ঘটনায় পরীমনির যে মামলাটি হয় ওই মামলার প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন ডিবি ডিসি গুলশান মো. মশিউর রহমান। তিনি টিমের ব্যস্ততার কারণে মামলাটি সাকলায়েনকে দেন। পরে সাকলায়েন মামলাটি তদারকি করতে থাকেন। মামলার প্রয়োজনে তিনি পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তার বনানীর বাসায় একাধিকবার গিয়েছিলেন।
সূত্র জানায়, আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বিষয়টি ডিবি অফিসের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জেনেও কেউ মুখ খোলেননি। কারণ গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ঊর্র্ধ্বতন প্রভাবশালী কর্মকর্তার সম্পর্ক রয়েছে। তবে বাসায় নিয়ে যাওয়ার ভিডিওটি ফাঁস হওয়ার পর চারদিকে বিষয়টি চাউর হয়ে ওঠে।
সূত্র জানায়, ঈদের আগে মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য গোলাম সাকলায়েন পরীমনির বনানীর বাসায় যান। পরীমনির বাসায় যাওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এরপর থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়। তারা দুইজন হাতিরঝিল এলাকায় একটি গাড়িতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গুজব রয়েছে যে, তারা বিয়ে করেছেন। কিন্তু, বিয়ের ব্যাপারে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। গোলাম সাকলায়েন পরীমনির সঙ্গে তার বিয়ের বিষয়টিও স্বীকার করেননি। তবে পরীমনির গাড়িচালক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, পরীমনি এবং ওই কর্মকর্তা দুইজন মিলে বিয়ে করেছেন।
সূত্র জানায়, ডিএমপি’র প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড বিভাগ মূলত খতিয়ে দেখছে যে, পরীমনি ও সাকলায়েন কতোদিন ধরে চলাফেরা করছে। তারা কী মাত্রা সম্পর্কে জড়িয়েছেন তা তদন্ত করছেন। সূত্র জানায়, এছাড়াও পরীমনির সঙ্গে ডিএমপি’র আর কোনো কর্মকর্তার লিয়াজোঁ আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিবি’র একটি জোনের এক এডিসি আলোচনায় উঠে এসেছেন। ওই এডিসিও নজরদারিতে আছেন। প্রয়োজনে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।