সবাই দেখতে সুন্দরী। সমাজে পরিচিত মুখ। কেউ মডেল, আবার কেউ অভিনেত্রী, কেউবা নায়িকা। রঙিন জড়তে সবাই তারকা। ছোট-বড় পর্দা কাঁপিয়ে সবার মনও জয় করে নিয়েছেন। কিন্তু হালে টিকে থাকতে পারেননি। নায়িকা, মডেলের তকমা লাগিয়ে হাঁটছেন ভিন্নপথে। নিজের পরিচয়, শারীরিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে বেছে নিয়েছেন অন্ধকার জগতকে। সুন্দর, আকর্ষণীয় চেহারা দেখে তাদের স্বরূপ চেনার উপায় নেই। বুঝার উপায় নেই প্রতারণা থেকে শুরু করে মাদক এমনকি অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়েছেন তারা। ইতিমধ্যে তাদের অনেকেই আটক করেছে পুলিশ।
সর্বশেষ গত বুধবার বিকালে রাজধানীর বনানীতে নায়িকা পরীমণির বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। প্রায় চার ঘণ্টার অভিযান শেষে রাত ৮টার দিকে তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। এ সময় পরীমণির বাসার যাবতীয় আসবাবে থরে থরে বিদেশি মদ পাওয়া যায়।
র্যাব জানায়, বিদেশি ব্র্যান্ডের যত ধরনের মদ আছে প্রায় সবই সেখানে মিলেছে। ফ্রিজভর্তি ছিল নামি-দামি ব্র্যান্ডের মদ। এর পাশাপাশি এই নায়িকার বাসায় মিলেছে সর্বনাশা মাদক ইয়াবাও। এমনকি তার বাসায় ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি-আইসও পাওয়া গেছে। সম্প্রতি এই মাদক কারবারে কয়েকটি চক্র ও উচ্চবিত্ত ঘরের কিছু তরুণ গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের মধ্যেই এ ধরনের মাদক সেবনের প্রবণতা বেশি।
পরীমণির বাসায় অভিযানের বনানীতে চিত্র পরিচালক নজরুল ইসলাম রাজের বাড়িতেও অভিযান চালায় র্যাব। অভিযান শেষে তাকে আটক করে র্যাব সদর দফতরে নেয়া হয়। তিনি রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার। র্যাব জানায়, মিশু নামে একজনকে গ্রেফতারের পর রাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে রাজের বাসায় অভিযান চালানো হয়। র্যাব আরো জানায়, প্রযোজক রাজের বাসার ভেতরে একটি গোপন কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে বিকৃত যৌনাচারে ব্যবহৃত অনেক সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। এই কক্ষটিতে পর্নোগ্রাফি তৈরি করা হতো বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, পরীমণির প্রথম সিনেমা ‘ভালোবাসা সীমাহীন’-এর প্রযোজক ছিলেন এই নজরুল ইসলাম রাজ। তার হাত ধরেই নাটক থেকে সিনেমায় নাম লেখান পরী। নজরুল ইসলাম রাজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম রাজ মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন হাউজ।
পরীমণি ও রাজকে আটক করার আগে গত রবিবার রাতে রাজধানীর গুলশান থানার বারিধারায় ৯ নম্বর রোডের ৩ নম্বর বাসা থেকে মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, অভিযান পরিচালনাকালে ডিবি পিয়াসার ঘরের টেবিল থেকে চার প্যাকেট ইয়াবা জব্দ করে। এছাড়াও পিয়াসার রান্নাঘরের ক্যাবিনেট থেকে ৯ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।
এদিকে পিয়াসাকে আটকের কিছুক্ষন পরই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে আটক করা হয়। পরে তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমান মদ উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও তার বাসায় মদের বার হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, আটক হওয়া দুই মডেল একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা উচ্চবিত্তদের বø্যাকমেইলিং করতেন।
ডিবি উত্তর বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর রশীদ বলেন, তারা দুজন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক বø্যাকমেইলের অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুজনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা পাওয়া গেছে। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল।
তিনি বলেন, আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রানী। তারা দিনের বেলায় ঘুমান এবং রাতে এসব কর্মকাÐ করেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তারা। বাসায় আসলে তারা তাদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরবর্তীতে তারা সেসব ভিডিও ও ছবি ভিক্টিমদের পরিবারকে পাঠাবে বলে বø্যাকমেইল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বাসায় মাদক পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর ও গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক মামলা করা হয়েছে। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বø্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ থাকায় এ সংক্রান্ত মামলাও হয়। এসব মামলায় আমরা তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদেও তারা এসব অভিযোগের দায় স্বীকার করেছে।
শুধু পরীমণি, রাজ, পিয়াসা ও মৌ নয়, তাদের আটকের আগে গত শনিবার দিবাগত রাতে ঢাকাই সিনেমার এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা একাকে আটক করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এ সময় তার বাসা থেকেও ইয়াবা, বিদেশি মদেও বোতল ও গাঁজা উদ্ধার করা হয়। পরে গৃহকর্মী নির্যাতন ও মাদক রাখার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। গত রোববার তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর পুলিশ মামলা দুটির সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে তিনদিন করে ছয়দিনের রিমান্ড আবেদন করে। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মোহাম্মদ জসিম রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এছাড়াও ঢাকার শোবিজ জগতের ডজনখানেক মডেল-অভিনেত্রী নিষিদ্ধ পর্নো ব্যবসায় জড়িত বলে জানিয়েছে র্যাব। এই তালিকায় রয়েছেন চিত্রনায়িকা আঁচল, শিরিন শিলা, বিতর্কিত মডেল নায়লা নাঈম, মডেল অহনা, শুভা, মানসি, পার্শা, মৃদুলা ও মৌরি । র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল খাইরুল ইসলাম জানান, মডেল বা নায়িকাদের পাশাপাশি কয়েকজন চিত্রনায়কও মাদক এবং অবৈধ পর্নোগ্রাফি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা যেকোনো সময় আটক হতে পারেন।
এদিকে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে চলত অনৈতিক কর্মকাÐ। বসানো হতো মাদকের আসর। র্যাবের হাতে দেশি-বিদেশি ৫০ মডেল-অভিনেত্রীর নাম-পরিচয় এসেছে। যাদের অনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হতো। রাজধানী ঢাকার গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ অনেক অনৈতিক কর্মকাÐের তথ্যে নজরদারি বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানান তিনি।
রঙিন জগতের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের এমন অবনতির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুজহাত ইয়াসমিন ইনকিলাবকে বলেন, শিল্পীদের বিষয় আমরা দেখি না। বিষয় শিল্পী সমিতি দেখবাল করে। বিষয়টি সম্পর্কে তারা ভালো বলতে পারবেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ইনকিলাবকে বলেন, সমাজে যত ধরনের অপরাধ হয় প্রতিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ভাগ আছে। তারা জানে না এমন অপরাধ হতেই পারে না। নায়িকা ও মডেলদের গ্রেফতারের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাদের স্বার্থগত কোনো কারণ আছে বলেই তাদের আটক করা হচ্ছে। কারণ তারা তো আগেই এ ধরনের অপরাধ করেছে। তখন তো তাদের কিছুই হয় নাই।
তিনি আরো বলেন, এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে করতে হলে দেশে আইনের শাসন থাকতে হবে। কিন্তু দেশে আইনের শাসন নেই। তবে যারা বলে দেশে আইনের শাসন আছে তারা মিথ্যা কথা বলে বলেও মন্তব্য করেন ওই শিক্ষক।