মুফতি শাব্বীর আহমদ , জমজম। আল্লাহর অপার কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। জান্নাতি ঝরণাধারাসমূহের একটি। হজরত ইবরাহিমের (আ.) দোয়ার ফসল।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পানি।
হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি হাজির তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা মিটিয়ে আসছে। তারা নিজেরা পান করছেন এবং বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর দূর-দূরান্তের জনপদে। ফলে মক্কায় না গিয়েও সারা বিশ্বের মুসলিম এ পানির বরকত ও কল্যাণ লাভে ধন্য হচ্ছে।এর বৈশিষ্ট্য ও ফজিলতের অন্ত নেই।
এ কূপটি আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি হয়েছিলো। পবিত্র কাবা থেকে মাত্র ২০মিটার দূরে অবস্থিত ৩০মিটার গভীরের এ কূপটির ইতিহাস অনেকেরই অজানা নয়। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই কৌতূহল নিয়ে যতই জানছে ততই হতবাক হচ্ছে।
আল্লাহতায়ালার হুকুমে হজরত ইবরাহীম (রা.) স্বীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.) ও স্ত্রী হাজেরা (রা.)-কে জনমানবহীন মক্কায় রেখে রওয়ানা হলেন। ইবরাহীম (আ.) যখন সেখান থেকে চলে আসতে লাগলেন, তখন হাজেরা (রা.) তাকে বারবার বলতে লাগলেন- এমন জনমানবহীন মরু প্রান্তরে আমাদের একাকী রেখে আপনি চলে যাচ্ছেন?! কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না।
অবশেষে হাজেরা (রা.) বললেন, আল্লাহই কী আপনাকে আমাদের এখানে রেখে যেতে বলেছেন? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। হাজেরা (রা.) তখন (ঈমানদীপ্ত কণ্ঠে বললেন,) তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।
চারিদিকে ধূ-ধূ মরুভূমি। নির্জন প্রান্তর। কোনো লোকজন নেই। দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত শুধু বালুর ঢেউ। তবুও তিনি সন্তুষ্টিত্তে বরণ করে নিয়েছেন সবকিছু। সমর্পিত হয়েছেন আল্লাহর হুকুমের সামনে।
ইবরাহীম (আ.) চলে গেলেন। স্ত্রী-পূত্রকে আল্লাহর হাওয়ালা করে ফরিয়াদ করলেন; হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরের কতককে বসবাস করালাম ফসলহীন অনুর্বর উপত্যকায় তোমার পবিত্র ঘরের নিকটে!… (সূরা ইবরাহীম-৩৭)
হযরত ইবরাহিম আ. রেখে যাওয়া সামান্য খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল আ. তৃষ্ণায় ছটফট করছিলেন। পানির সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে দৌড়াতে থাকেন মা হাজেরা।সাফা-মারওয়ায় বারংবার দৌড়াদৌড়ি ক অস্থির হয়ে পড়েন।
পানির কোনো সন্ধান নেই। কোনো উপায় নেই। এখন আল্লাহর রহমতই এখন একমাত্র ভরসা। ঠিক তখনই যমযম রূপে নেমে আসে আল্লাহর রহমত। আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতার পাখার আঘাতে সৃষ্টি হয় এক অলৌকিক কূপ। বের হয়ে আসতে লাগলো সুপেয় পানির ফোয়ারা। সেই থেকেই শুরু চিরপ্রবাহমান জমজম।
জমজমের পানির ফজিলত
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, জমজম ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। (আলমুজামুল কাবীর- ১১১৬৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ-৫৭১২)
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে উদ্দেশ্যে জমজম পান করা হবে তা পূরণ হয়। যদি তুমি রোগমুক্তির জন্য তা পান কর আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দেবেন। (মুসতাদরাকে হাকেম- ১৭৩৯)
যুগে যুগে অসংখ্য আল্লাহর বান্দা শুধু জমজম পান করেই দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। কারন এতে রয়েছে খাদ্যশক্তি।
ইমাম ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, আমি এমন মানুষও দেখেছি, যিনি অর্ধ মাস কিংবা তারও বেশি সময় শুধু জমজম পান করেই কাটিয়েছেন। কখনো ক্ষুধা অনুভব করেননি। অন্যান্যদের সাথে খুব স্বাভাবিকভাবেই তাওয়াফ করতেন। তিনি আমায় বলেছেন, একবার তো শুধু জমজম পান করেই চল্লিশ দিন কাটিয়েছেন। (যাদুল মাআদ ৪/৩৯৩)
হজরত আবু যর গিফারী (রা.) ইসলাম গ্রহণ করে যখন মক্কায় এসেছিলেন, তখন তিনি শুধু জমজমের পানি পান করে ৩০ দিন কাটিয়েছেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোগীদের উপর জমজমের পানি ছিটাতেন এবং তাদেরকে তা পান করতে দিতেন।
সালাফে সালেহীন থেকে রোগমুক্তির জন্য যমযম পান করার অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। রোগাক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসা হিসেবে জমজম পান করতেন এবং সুস্থ হয়ে যেতেন।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ছেলে নিজ পিতার ব্যাপারে বলেন, আমি বাবাকে রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য জমজম পান করতে দেখেছি। সেইসাথে তিনি পানি দিয়ে হাত ও মুখ মাসাহ করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১১/২১২)
ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, রোগমুক্তির জন্য জমজম ব্যবহার করে আমি অনেক রোগ থেকে মুক্ত হয়েছি। (যাদুল মাআদ ৪/৩৯৩)
জমজমের পানি যে যে উদ্দেশ্যে পান করবে আল্লাহ তার সে নিয়ত পুরা করেন।
রাসূলুল্লাহ সা.বলেছেন, ‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্য নিয়ে পান করবে তা পূরণ হবে। (ইবনে মাজাহ: ৩০৬২)
একারণে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, বরেণ্য ওলামায়ে কেরাম ও আল্লাহভীরু মুমিনগণ জমজম পানের সময় বিভিন্ন নিয়ত করতেন, যা পূরণ হওয়ার অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসের পাতায় বিদ্যমান।
হযরত ওমর রা. হাশরের ময়দানে পিপাসিত না হওয়ার নিয়তে জমজমের পানি পান করতেন।
আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ.বলেন, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি জমজমের পানি পান করেছিলাম স্মৃতিশক্তিতে হাফিজ শামসুদ্দিন জাহাবি রহ. এর স্তরে পৌঁছার নিয়তে। সুয়ুতি বলেন, ইবনে হাজার ওই স্তরে পৌঁছেছিলেন; বরং তার স্মৃতিশক্তি আরও অধিক প্রখর হয়েছিল। (তাবাকাতুল হুফফাজ : ১/৫২২)।
পানি পান করার আদব
ফকিহগণ জমজমের পানি পানের কিছু আদব উল্লেখ করেছেন।এগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। যেমন-কিবলামুখী হয়ে পান করা।তিন শ্বাসে পান করা।প্রত্যেকবার বিসমিল্লাহ পড়া।প্রতি শ্বাসের পর আলহামদু লিল্লাহ বলা।ডান হাতে পান করা।পান করার সময় দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের দুয়া করা।পেট ভরে পরিতৃপ্ত হয়ে বেশি বেশি পান করা (মক্কায় অবস্থানরত হাজিদের জন্য বিশেষ লক্ষনীয়)।
জমজম আমাদেরকে ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর হুকুম পালনার্থে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ-সুখ এবং নিজের ইচ্ছা ও চাহিদাকে কুরবান করে আল্লাহর জন্য পুরোপুরি সমর্পিত হওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে। আল্লাহ পাক আমদের মধ্যে ইবরাহীমি চেতনাবোধ দান করুন।আমিন।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক