নেসারুল হক খোকন , সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে নিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক। এরশাদের ১০৫ মিলিয়ন ডলার থেকে ৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার এবং ৪ লাখ ৮৮ হাজার পাউন্ড বিদিশার অ্যাকাউন্টে পাচার করা হয়।
বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪৩ কোটি টাকা। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও সৌদি আরব থেকে লন্ডনে নিজের তিনটি অ্যাকাউন্টে এই অর্থ সরিয়ে নেন তিনি। ২০০১ সালের ২২ মে থেকে ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ দফায় এই টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বিদিশার অর্থ পাচার নিয়ে চাঞ্চল্যকর সব তথ্যপ্রমাণের নথিপত্র প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
এদিকে এ ঘটনায় অর্থ পাচারের মামলা হলেও তা প্রমাণ করতে পারেনি তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। অবৈধভাবে অর্জিত দেশি-বিদেশি ২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ গোপন করার অপরাধে ২০০৫ সালের ১৬ জুন মামলাও হয় বিদিশার বিরুদ্ধে। কিন্তু এক যুগ পার হয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে এ মামলার আর কোনো অগ্রগতি পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে সোমবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা মামলাটির অগ্রগতির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, গুলশান থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী নূরে আলম ২০০৫ সালের ১৬ জুন গুলশান থানায় বিদিশার বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৪০(৬)২০০৫। মামলায় ২১ কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য গোপন করার অভিযোগ আনা হয়। সংশ্লিষ্ট অভিযোগের দালিলিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে ওই সময় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিও নেওয়া হয়।
২০০৫ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপপরিচালক বিমল চন্দ্র ব্যানার্জি পুলিশকে বিদিশার বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে অনুমতিপত্র দেন। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপারকে (ঢাকা মেট্রো) উদ্দেশ করে লেখা ওই পত্রে বলা হয়, ‘মামলা তদন্ত করার অনুমতি প্রসঙ্গে সিআইডি অফিসের স্মারক নং ৭৪, তারিখ ১১ জুন ২০০৫ আসামি বিদিশা এরশাদ ওরফে মিসেস বিদিশা সিদ্দিক হুইসনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে মামলা তদন্ত করার জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০০২-এর ৫(১) ও ৮(২) ধারার আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপনাদের বরাবর ক্ষমতা অর্পণ করা হলো।’
জানা যায়, এই মামলার তদন্ত পুলিশের এখতিয়ারবহির্ভূত হওয়ায় ২০০৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনকে তদন্তের নির্দেশ দেন ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। ২০০৯ সালের ২৮ জুলাই এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে বিচারক আদেশে বলেন, ‘নথি পর্যালোচনা করা হলো। বিজ্ঞ মহানগর দায়রা জজ মহোদয় ঢাকার ফৌজদারি বিশেষ মামলা নম্বর ১১০/০৯, তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০০৯-এর আদেশনামা দেখিলাম।’ তিনি তার আদেশনামায় উল্লেখ করেন, ‘অত্র মামলার অপরাধের ধারাসমূহ দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় দুদকের অফিসার কর্তৃক তদন্তযোগ্য। সেহেতু গুলশান থানা কর্তৃক দাখিলকৃত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। মামলাটি প্রয়োজনীয় তদন্তপূর্বক রিপোর্ট দাখিলের জন্য মহাপরিচালক (তদন্ত) দুদক বরাবরে প্রেরণ করা হলো।’ ১২৯নং স্মারকে ২০০৯ সালের ২৯ জুলাই আদেশের অনুলিপি দুদকে পাঠানো হয়। এরপর থেকে মামলাটির তদন্তের অগ্রগতি আর পাওয়া যায়নি।
যেভাবে অর্থ যায় বিদিশার অ্যাকাউন্টে : ১৯৯৭ সালে এরশাদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিদিশার। এরপর তার চোখ যায় এরশাদের সুইস ব্যাংকের টাকায়। একের পর এক দুরভিসন্ধি আঁটতে থাকেন তিনি। আর সেটি সফল হয় ২০০১ সালের ২২ মে। তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা যায়, ওইদিনই (২০০১ সালের ২২ মে) সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সুইস ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ইউনিয়ন ন্যাশনাল ব্যাংক আবুধাবি শাখায় নিজের অ্যাকাউন্টে (নম্বর ৬৫০২০০২০৪৬) ৩৭ লাখ ৩০ হাজার ৪৬৭ মার্কিন ডলার স্থানান্তর করেন। এরপর সেখান থেকে লন্ডনের ন্যাশনাল ওয়েস্টমিনস্টার ব্যাংকে বিদিশার অ্যাকাউন্টে (নম্বর ৯৮৩৬৩৮৬৭) এই ডলার স্থানান্তর করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০১ সালের ২২ মে ১৬ লাখ মার্কিন ডলার, ২৩ মে ১ লাখ ডলার, ২ আগস্ট ৫ লাখ ডলার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২ লাখ ডলার, ১৭ অক্টোবর ১ লাখ ডলার, ১২ নভেম্বর ৩ লাখ ৯৫ হাজার ডলার, ২৪ নভেম্বর ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, ২০ ডিসেম্বর ৪ লাখ ৭০ হাজারসহ মোট ৩৭ লাখ ১৫ হাজার মার্কিন ডলার এরশাদের আবুধাবির অ্যাকাউন্ট থেকে বিদিশার লন্ডনের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়াও আবুধাবির ন্যাশনাল ব্যাংকে এরশাদের অ্যাকাউন্ট থেকে (নম্বর ৪০৫০১৬১৯৮২) ২০০২ সালের ২২ ডিসেম্বর বিদিশা তার লন্ডনের বার্কলেস ব্যাংকে (অ্যাকাউন্ট নম্বর ৯০২৩৯২১৬) ১০ লাখ মার্কিন ডলার সরিয়ে নেন। ২০০১ সালের ২২ মে সৌদি আরবের আল রাজি কমার্স মানি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে (স্থানান্তর আইডি নম্বর আইপিবিবিএম ০১০৫২২০২২১৯) লন্ডনে নেটওয়েস্ট ব্যাংকে খোলা বিদিশা হুইসন নামের অ্যাকাউন্টে (নম্বর ৯৮৩৬৩৮৬৭) জমা করা হয় ৪ লাখ ৮৮ হাজার ১২১ দশমিক ৫০ সেন্ট। যার শর্ট কোড নম্বর ৬০-০৪-২৭।
উৎস ফাঁকি দিতে জালিয়াতি : হঠাৎ করে এই বিপুল অঙ্কের টাকা লন্ডনে নেটওয়েস্ট ব্যাংকে জমা হওয়ার পর ব্যাংকটির কেন্টবেরি সিটি সেন্টার শাখা বিদিশার কাছে টাকার উৎস জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। ২০০৩ সালের ১৫ জানুয়ারি সেই চিঠির জবাব দেন বিদিশা। অথচ জমা হওয়া এই টাকার উৎস অবহিত করতে ভয়াবহ জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি। নেটওয়েস্ট ব্যাংককে লেখা জবাবে বিদিশা উল্লেখ করেন, ‘উল্লিখিত সম্পদের মালিক ছিলেন কেরামত আলী। তার মৃত্যুর পর তিন পুত্র হাবিবুর রহমান, মাহবুবুর রহমান ও মজিবুর রহমান ওই সম্পদের মালিক হন। তাদের দেওয়া আমমোক্তারনামার বলে এই সম্পদের মালিক হন বিদিশা। পরবর্তী সময়ে এই সম্পদ এক ব্যক্তির কাছে বিক্রির চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী তিন কিস্তিতে মোট ১৮ কোটি টাকা পান বিদিশা। সেই টাকাই তিনি নেটওয়েস্ট ব্যাংকে জমা করেন।’
তার এই চিঠির সূত্র ধরে তথ্যানুসন্ধান করে পাওয়া যায় আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জায়গার মালিক কেরামত আলী ছিলেন আইয়ুব খান আমলের মন্ত্রিসভার সদস্য। এখানে জমির পরিমাণ ২ বিঘা ১০ কাঠা ৮ ছটাক। এর অবস্থান গুলশান ২-এর ৭২নং সড়কে এন ই(এ)১-৩ প্লটে। জমিটি ১৯৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি আইয়ুব খান নামমাত্র মূল্যে কেরামত আলীকে এই প্লটটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। বাড়িটি আদৌ বিক্রি হয়নি। এখনো বাড়িটিতে তার ছেলেরা বসবাস করছেন। সোমবার সরেজমিন বাড়িটিতে গেলে জানা যায়, কেরামত আলীর তিন ছেলে বেঁচে নেই। জীর্ণশীর্ণ দোতলা বাড়িটিতে বর্তমানে ছোট ছেলে মজিবুর রহমানের স্ত্রীসহ সন্তানরা বসবাস করেন। এ সময় মজিবুর রহমানের স্ত্রী জলি রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘বিদিশা সিদ্দিকের আমমোক্তারনামা বানানোর পুরো বিষয়টি ভুয়া। এর মধ্যে তিল পরিমাণ কোনো সত্যতা নেই।’ তিনি বলেন, ‘তাকে কখনো সরাসরি দেখেনি। তবে একসময় শুনেছিলাম, তিনি এরকম ফলস কিছু পেপার তৈরি করেছিলেন।’
এদিকে বিদিশার এ ধরনের প্রতারণার বিষয় জানতে পেরে ২০০৩ সালে কেরামত আলী পরিবারের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। জানা যায়, এই কেরামত আলীর গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ এলাকায়।
তথ্যানুসন্ধানে বিদিশার করা আমমোক্তারনামা দলিলটির কোনো অস্তিত্ব ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসে পাওয়া যায়নি। রাজউকের অনুমতি ব্যতিরেকে এবং রেজিস্ট্রি দলিল ছাড়াই এটি ঢাকা নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সৃজন করা হয়েছে। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে একটি বিক্রয় দলিলও সৃজন করেন বিদিশা। ২০০০ সালের ২৬ মার্চ নোটারিটি নিজে বানিয়েছেন। যার নম্বর ১০।
লন্ডনে বিদিশার বাড়ি : প্রতারণার মাধ্যমে এরশাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে লন্ডনে আলিশান বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন বিদিশা। অ্যাপার্টমেন্টটি ১১৬ কর্নওয়েল রোডের ৬৬০ পয়েন্ট ওয়েস্ট লন্ডনে অবস্থিত। যার কোড নম্বর এসডব্লিউ ৭, ৪ এক্সএফ। অ্যাপার্টমেন্টটির ক্রয়মূল্য ১০ লাখ পাউন্ড (১৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা)। আর ২৯ এডিসন কোর্ট হোপ স্ট্রিটে কেনেন বিলাসবহুল আরেকটি বাড়ি। যার কোড নম্বর এস-ই ১০ ওডিআর। বাড়িটির ক্রয়মূল্য ৬ লাখ পাউন্ড (৮ কোটি ১০ লাখ টাকা)।
নথিপত্রে বিদিশার সম্পদের আরও তথ্য মিলেছে। ২০০০ সালের ৩ অক্টোবর এরশাদের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট পার্কের ২বি২ নম্বর অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করেন বিদিশা (সাব-কবলা দলিল নম্বর ১১৪২)। যার আয়তন ৩ হাজার ৩২১ দশমিক ২৬ বর্গফুট। দলিলমূল্য উল্লেখ করা হয় ৩২ লাখ টাকা। দলিল করে নেওয়ার ছয় বছরের মাথায় অ্যাপার্টমেন্টটি ৮ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ১৩ মে আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে নিকেতনের ১৩২ নম্বর বাড়ির ৫-এ নম্বর ফ্ল্যাটটিও ক্রয় করেন বিদিশা। যার দলিলমূল্য দেখানো হয় ২৫ লাখ ২৩ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ তার আয়কর নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০০১-২০০২ অর্থবছরে প্রথম আয়কর ফাইল খোলেন বিদিশা। মিসেস বিদিশা এরশাদ নামে খোলা ফাইলের টিআইএন নম্বর ২৪৭১০১৬৮৭৬। প্রথম বছরে তিনি আয়কর দেন মাত্র ১ হাজার টাকা। আয়কর ফাইলে তিনি তার এসব সম্পদের তথ্যও গোপন করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিদিশা সিদ্দিক বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে কেউ কি কোনো অভিযোগ করেছে? অভিযোগ করলে আমি দুদকের সঙ্গে কথা বলব। আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।’ এরপর তিনি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।