আবু রূশদ, ১৯৮৪ সালের মার্চ মাস। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের বিশেষ দূত হিসাবে ডোনাল্ড রামসফেল্ড ইরাকের বাগদাদ এসে পৌঁছলেন। মাত্র চার মাসের মধ্যে বাগদাদে এটা তার দ্বিতীয় সফর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তখনো ইরাকের কোনো আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ইরাক আমেরিকার সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক আগেই ছিন্ন করেছিল। তবে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পটভূমিতে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ১৯৮৩ সালের ২৬ নভেম্বর একটি গোপন আদেশে স্বাক্ষর করেন মার্কিন প্রশাসনকে এই নির্দেশ দিয়ে যে, ‘ইরাককে ইরানের হাতে পরাস্ত হওয়া থেকে রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন ও আইনত করণীয়’ তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে ইরাকের অবস্থা তখন বেশ খারাপ। ইরানের বিজয় প্রতিহত করা তখন বড় দায় হয়ে দাঁড়ায় মার্কিন প্রশাসনের কাছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেন কোনো প্রকাশ্য ও যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানে একচেটিয়া আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেন। ওই সময় ইরাকের সমরবিদ ও গোয়েন্দারা ধারণা করেছিল যে বিপ্লবীরা ইরানে শাহপন্থী হিসাবে চিহ্নিত করে শত শত সিনিয়র সামরিক অফিসারকে হত্যা করেছে, ইরানের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামী ধাঁচের বিপ্লবের কারণে ইরান তখন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নপ্রায়। তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ইরানি বিপ্লবীদের হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতে সে সময় ইরান শুধু সামরিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পড়েনি, প্রায় সব দেশ ইরানের নতুন সরকারকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। এমনকি ইরান তার শিয়াভিত্তিক রাজনৈতিক প্রভাব ও কথিত ইসলামী বিপ্লব রফতানির লক্ষ্যে পাশর্^বর্তী রাজা শাসিত সুন্নি আরব দেশগুলোয় গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে। সৌদি আরবে হজের সময় ইরানিরা মিছিলসহকারে বিক্ষোভ করলে সৌদি সরকারসহ অন্যান্য গালফ দেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
একই সাথে ইরান সিরিয়ার শিয়া শাসকদের সাথে দ্রুত সম্পর্ক স্থাপন করে লেবাননে তার প্রভাববলয় বিস্তারের উদ্যোগ নেয়। অনেক দেশ ভাবতে শুরু করে যে ইরান নিজ দেশে বিপ্লবের সুফল জনগণের দুয়ারে পৌঁছানোর পরিবর্তে শিয়াভিত্তিক ইসলামী বিপ্লব রফতানি করার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে পৃথিবীতে প্রায় একই সময় আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে আফগানিস্তানে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের বেলুচিস্তান হয়ে আরব সাগরে প্রবেশে শত বছরের আকাক্সক্ষা নিয়ে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আশপাশের এলাকায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন মনে করতে থাকেন যে ইরানকে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করার এটাই সময়। তখন ইরাকের সশস্ত্র বাহিনী ছিল আধুনিক সোভিয়েত সমরাস্ত্রে সজ্জিত। অন্য দিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরানের হাতে থাকা সব ন্যাটো ভার্সন সমরাস্ত্র ব্যাপকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। যেহেতু ইরানের প্রায় সব অস্ত্রই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি তাই স্পেয়ার পার্টস, গোলাবারুদের অভাবে এসবের বেশির ভাগ পরিচালনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সিনিয়র প্রায় তিন শ’ জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার ও কর্নেলের মৃত্যুদণ্ডের পর ইরানের সশস্ত্র বাহিনী হয়ে পড়ে বেশ দুর্বল। কমান্ড চ্যানেল ছিল অপরিপক্ব অফিসারদের হাতে। সাদ্দামের গোয়েন্দারা এমন ধারণা উপস্থাপন করেন যে, যদি আঁটঘাট বেঁধে ওই অবস্থায় তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করা যায় তাহলে ইরানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। গোপনে রাজা শাসিত প্রতিবেশীরাও সাদ্দামকে এগিয়ে যাওয়ার সবুজসঙ্কেত দেন। ইরাক ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশৃঙ্খল ইরানের ওপর। দখল করে নেয় ব্যাপক এলাকা।
কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইরাকের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয় ইরানের সাধারণ সৈনিকেরা ও বিপ্লবী গার্ডবাহিনী। ন্যূনতম সেনা প্রশিক্ষণ নেয়া ইরানি যুবক, এমনকি যুবতীরা অকল্পনীয় বৈরী পরিবেশের সামনে রক সলিড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ইরাকের সুসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীকে হতভম্ব করে দিয়ে তারা সব এলাকা থেকে ইরাকি সেনাদের শুধু হটিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, ইরাকের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি এসে ইরাকের বাহিনী আক্রমণ তো দূরের কথা রক্ষণাত্মক অবস্থানেও নিজেদের সুরক্ষিত মনে করতে স্বস্তি পাচ্ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসন ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তড়িঘড়ি করে সন্ত্রাসে সমর্থনদানকারী দেশের তালিকা থেকে ইরাকের নাম বাদ দেয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ইরাকের সাথে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করে। মার্কিন সম্মতিক্রমে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি ইরাকে সমরাস্ত্র বিক্রি শুরু করে। এর মধ্যে সে সময়ের অত্যাধুনিক মিরাজ জঙ্গিবিমান, এক্সোসেট মিসাইল অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি ১৯৮৩ সালের ১২ জুলাই স্বাক্ষরিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিসিশন ডিরেক্টিভ ৯৯- এ স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান যার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্য উপসাগর এলাকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক তৎপরতা জোরদার করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আমেরিকা অতি গোপনে ইরাককে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইরানের সৈন্য সমাবেশ, চলাচল, অবস্থান সম্পর্কিত তথ্যসহ আনুষঙ্গিক গোয়েন্দা সহায়তা দেয়া শুরু করে। কিন্তু প্রকাশ্যে দুই পক্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা প্রচার করতে থাকে মার্কিন সরকার। তবে তারা এটা ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে ইরাকের পর্যাপ্ত আধুনিক সমরাস্ত্র ইরানের কোনো বড় আক্রমণ থেকে ইরাককে রক্ষা করবে। এই বিশ্লেষণের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার অন্যতম মিত্র সৌদি আরবের কাছে অত্যাধুনিক অ্যাওয়াকস বিমান ও এফ-১৫ জঙ্গি বিমানসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ জোরদার করে।
এদিকে ইরানি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে সাদ্দাম হোসেন বড়ই অপমানিত বোধ করেন। তিনি দেখতে পান যে প্রচলিত যুদ্ধকৌশলে ও প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র যেমন জঙ্গি বিমান, ট্যাংক, কামান ব্যবহার করে ইরানকে পরাস্ত করা যাবে না এবং তিনি ভীত হয়ে পড়েন এই আশঙ্কায় যে ইরানিরা ইরাকের ভূমি দখল করে নিতে পারে। সব স্বৈরশাসক সবসময় যে বিষয়টিকে ভয় পান তা হলো ক্ষমতা হারানো। যেহেতু তারা নির্বাচন বা জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় আসেন না তাই তারা চমক দেখানোর জন্য অবকাঠামো উন্নয়নসহ কথিত আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন শান্তিকালীন সময়ে। পাশাপাশি বিশাল সমরাস্ত্র ভাণ্ডার গড়ে তুলে শুধু ‘বিশ্বস্ত’ দলীয় লোকদের দিয়ে গড়ে তোলেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত বৃহৎ অবকাঠামোর সশস্ত্র বাহিনী। এটা যত না যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয় তার চেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় নিজ জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। গোয়েন্দা বাহিনীর অবস্থাও থাকে একইরূপ। লক্ষ্য সবার এক, বসকে ক্ষমতায় রাখা। তার স্বার্থ রক্ষা করা। দলের জন্য প্রয়োজনে হাজার হাজার, লাখ লাখ বিরোধী মতের মানুষ মেরে ফেলা, গুম করা হয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ আসে তখন বোঝা যায় ওই সেনাবাহিনীর আসল ক্ষমতা। ঘুণে ধরা, বিলাস-ব্যসনে মত্ত, দলীয় ক্যাডারের মতো ওই সেনাবাহিনী তখন সাধারণ অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুর হাতেও পিটুনি খায় খুবই সহজে। সাদ্দামের সশস্ত্র বাহিনীও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ইরানিরা লড়েছিল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে, দেশের সম্মানের জন্য। আর সাদ্দাম বাহিনী লড়েছে একনায়ক সাদ্দামকে রক্ষার জন্য।
এক পর্যায়ে সাদ্দাম বুঝতে পারেন যে তিনি যদি যুদ্ধে কোনোভাবে পরাজিত হন তাহলে তার পরিবারসহ পুরো বাথ পার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে। তিনি তাই বেছে নেন অপ্রচলিত কিন্তু ভয়ঙ্কর পথ। ১৯৮৩ সালের শুরু থেকে ইরানের সেনাবাহিনীসহ সাধারণ জনগণের ওপর শুরু করেন বিষাক্ত গ্যাস রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। অমানবিক এসব গ্যাস আক্রমণে মারা যায় হাজার হাজার ইরানি নারী ও শিশু। এমনকি সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে মার হাত ধরে পথচলা শিশু রাস্তাতেই মরে পড়ে থাকে। ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে মার্কিন আর্মি ইন্টেলিজেন্সের একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিক ফ্রাংকোনা যিনি একসময় বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে নিয়োজিত ছিলেন, ২০০২ সালে ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, ‘ইরাকিরা যুদ্ধের প্রতিটি ধাপে মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করেছে… তারা ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে টাবুন নামের নার্ভ গ্যাস ব্যবহার শুরু করে… এবং ১৯৮৮ সালের মধ্যে সারিন গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম হয়।’ এমনকি ১৯৮৩ সালের ১ নভেম্বর তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলজকে গোয়েন্দা সংস্থা ‘প্রায় প্রতিদিন ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের’ তথ্য প্রদান করে।
ইরানের কয়েকটি বড় শহরে যখন ইরাকি বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করে তখন ১৯৮৩ সালেই ইরান জাতিসঙ্ঘের কাছে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়। কিন্তু তখন প্রায় সব বৃহৎ শক্তির সাথে ইরান কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকায় সেসব অভিযোগ খুব একটা পাত্তা পায়নি। এমনকি ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক মেমোতে উল্লেখ করা হয় যে, সাদ্দাম হোসেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কুর্দিদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছেন। মার্কিনিরা এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে আনমুভড থাকলেও ভিতরে ভিতরে অনেকটা নার্ভাস হয়ে পড়ে এই ভেবে যে ইরাক যদি এভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে, মার্কিনিদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা কিনা তখন আফগানিস্তানে চলমান সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনও হতে পারে যে মুসলিম বিশ^ যারা কিনা প্রায় একচেটিয়াভাবে আফগানিস্তান ইস্যুতে মার্কিনিদের পক্ষাবলম্বন করেছে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে।
এসব বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিদ্ধান্ত নেন ইরাকি কর্তৃপক্ষের সাথে উচ্চপর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার। তখন বেছে নেয়া হয় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ডোনাল্ড রাফসফেল্ডকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে ইরাকে পাঠানোর জন্য। রামসফেল্ডকে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল : ১. সাদ্দাম হোসেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজের সাথে সরাসরি বৈঠক করা, ২. ইরান ও সিরিয়ার প্রতি দুই দেশের একইরূপ নীতিমালায় সমন্বয় সাধন করা, যৌথভাবে পদক্ষেপ নেয়া, ৩. ইরাকের তেল রফতানিতে বিকল্প পথ নিশ্চিত করা, কারণ ইরান পারস্য উপসাগর দিয়ে ইরাকের তেল রফতানিতে বাধা দিয়ে আসছিল, ৪. ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করা। রামসফেল্ড এভাবেই তার ঐতিহাসিক বাগদাদ সফর শুরু করেন ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু পরে ডিক্লাসিফাইড মার্কিন ডকুমেন্ট থেকে দেখা যায়, রামসফেল্ড সাদ্দামের সাথে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে কোনো প্রসঙ্গই উত্থাপন করেননি!
আরো আশঙ্কার কথা যে, ১৯৯৫ সালে রিগ্যান প্রশাসনের ইরাক সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ হাওয়ার্ড তেইচার এক অ্যাফিডেভিটে উল্লেখ করেন যে, তদানীন্তন সিআইএ পরিচালক উইলিয়াম কেসি কার্দোয়েন নামে চিলির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গোপনে ইরাকে ক্লাস্টার বোমা সরবরাহের ব্যবস্থা করেন সেই ১৯৮৩ সালেই। এর আগে ১৯৯৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসের এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্স নিয়ে কয়েকটি আমেরিকান কোম্পানি ইরাকে বিভিন্ন ধরনের অ্যানথ্রাক্সসহ ডজনখানেক জৈব এজেন্ট সরবরাহ করে অতি গোপনে। এসব কিছুই সেসময় মার্কিন আইনপ্রণেতাদের অগোচরে রাখা হয়।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, নানামুখী চাপে হোক বা বিশ্বে নিজের ভাবমূর্তি ঠিক রাখতেই হোক মার্কিন প্রশাসন ১৯৮৪ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখে ইরাকি বাহিনী দ্বারা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এমনি অবস্থায় ওই একই মাসের শেষে রামসফেল্ড যখন বাগদাদে যান আলোচনার জন্য, তখন তিনি ইরাকি নেতৃবৃন্দের মধ্যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখতে পান। তারা মার্কিনিদের ওইভাবে প্রকাশ্যে দেয়া বিবৃতি নিয়ে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেন। কথিত আছে যে, বৈঠককালে সাদ্দাম হোসেন এক পর্যায়ে রামসফেল্ডকে অপমানসূচক কথাও বলেন ও অসৌজন্যমূলকভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। অর্থাৎ এক কথায় রামসফেল্ডকে অপমান করেন সাদ্দাম হোসেন। যদিও ওই বছরের নভেম্বরে ইরাকের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। রামসফেল্ড ব্যক্তিগতভাবে সাদ্দামের সেই অপমানসূচক ব্যবহারের কথা কখনো ভোলেননি। তবে সাদ্দাম ভুলে গিয়েছিলেন রামসফেল্ড কোনো সাধারণ মানের মানুষ ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, চতুর একজন রাজনীতিবিদ- যিনি ছিলেন দুনিয়াখ্যাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। আর মার্কিনিরা কখনো অপমান ভোলে না। শত বছর পরে হলেও প্রতিশোধ নেয়। অনেকটা পাঠানদের মতো।
আমেরিকার অত্যন্ত অভিজাত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুমাত্র এক্সট্রাঅর্ডিনারি মেধাবীরাই এখানে পড়তে পারেন। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়েও যোগ্য নয় এমন কেউ এখানে ভর্তি হতে পারেন না। প্রিন্সটন থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন করে বের হন তাদের বেশির ভাগই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আমেরিকার চালিকাশক্তি হিসাবে পরবর্তী জীবনে আবির্ভূত হন। সদ্য পরলোকগমনকারী সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রাফসফেল্ডও ছিলেন এমনি একজন। প্রিন্সটন থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট রাফসফেল্ড শুধু বুদ্ধিমানই ছিলেন না, তিনি বিশ্ব ইতিহাস পর্যন্ত পাল্টে দিয়ে গেছেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা পৃথিবীর কোনো লাভ হয়েছে কিনা তা বিতর্কের বিষয়। তবে রাফসফেল্ড যেন ঝড়ের গতিতে যুদ্ধের দেবতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই শতকের প্রথম দিকে ও গত শতকের আশির দশকে।
বিশ শতকে পৃথিবী দুটি বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, সমাজতন্ত্রের ক্রুরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু একুশ শতক শুরুই হয়েছে নতুন ধারার ভয়াবহ যুদ্ধ বিগ্রহ, এসিমেট্রিক ওয়ার, আত্মঘাতী বোমা হামলার তাণ্ডব, বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির হৃৎপিণ্ডে নন স্টেট অ্যাক্টর কর্তৃক অকল্পনীয় সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে।
রামসফেল্ড দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন জর্জ বুশের আমলে। নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী ঘটনার প্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে আগ্রাসনে রামসফেল্ড পালন করেন মুখ্য ভূমিকা। এর মাত্র দুই বছরের মাথায় ২০০৩ সালে ইরাকের কাছে উইপন্স অব মাস ডিস্ট্রাকশনস-ডব্লিউএমডি মজুদ আছে এই অভিযোগ তুলে ইরাকে আগ্রাসনের পথ উন্মুক্ত করেন। মার্কিন জেনারেলদের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তিনি ইরাকে আগ্রাসন চালাতে প্রেসিডেন্ট বুশকে রাজি করান। ইরাকে পতন হয় সাদ্দাম হোসেনের। তিনি গ্রেফতার হন মাটির নিচের এক গুহা থেকে। দাড়ি গোঁফ আবৃত, নোংরা কাপড় পরিহিত সাদ্দামকে পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করা হয় গর্তে লুকানো এক ইঁদুরের মতো করে। তার চুল, দাড়ি, দাঁত পরীক্ষার সেই ঐতিহাসিক ছবি দেখানো হয় বিশে^র সব টিভি চ্যানেলে। এক সময় তাকে ঝুলানো হয় ফাঁসিতে। রামসফেল্ড অবশ্যই তার অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
সাদ্দাম হোসেন যেকোনো ভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য, প্রায় দশ লাখ ইরাকিকে হত্যা করেছিলেন নানাভাবে। আরো কয়েক লাখ ইরানি কোনো দোষ না করেও যুদ্ধে ও রাসায়নিক অস্ত্রের আঘাতে মারা যায়। রামসফেল্ড ইরাকে আগ্রাসন চালানোয় ইরাকে নিহত হয় প্রায় চার লাখ মানুষ। এ এক অদ্ভুত পৃথিবী। রামসফেল্ডকে যখন পরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল ইরাকের কথিত মানববিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সত্যতা ও ইরাক আগ্রাসনের যৌক্তিকতা নিয়ে তখন তিনি নির্লিপ্তভাবে তার সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন :
‘আপনার কাছে কোনো কিছুর অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ নেই শুধু এই কারণে আপনি বলতে পারেন না আপনার কাছে প্রমাণ আছে যে তার অস্তিত্ব নেই।’
‘প্রমাণের অনুপস্থিতি অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়।’
আল্লাহ তাই হয়তো বলেছেন, তিনি এক জালেমকে আরেক জালেম দিয়ে ধ্বংস করেন!
লেখক : সাবেক সেনাকর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের প্রধান সম্পাদক