ওয়েছ খছরু ও একেএম মহিম, স্বপ্ন বুনেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সাবেক রেলমন্ত্রী। হাওরের বুক চিড়ে ট্রেন যাবে সুনামগঞ্জে। সেটির প্রস্তাব সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আমলেই করা ছিল। এখন সুনামগঞ্জের উন্নয়নের চাবিকাঠি পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের হাতে। উন্নয়ন করছেন তিনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট সবই করছেন মন্ত্রী। এ যেন সুনামগঞ্জবাসীর জন্য; মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।কিন্তু
একেক সময় একেক উন্নয়ন নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি সব করতে চেয়েছিলেন প্রস্তাবিত শান্তিগঞ্জ উপজেলাকেন্দ্রিক। এই উপজেলার বর্তমান নাম দক্ষিণ সুনামগঞ্জ। মন্ত্রীই নাম পরিবর্তন করে শান্তিগঞ্জ করতে চাচ্ছেন। মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নিয়ে বিরোধ বাধে। মন্ত্রী চেয়েছিলেন শান্তিগঞ্জ হোক। তবে এমপিরা এক হওয়ায় শান্তিগঞ্জের কাছাকাছি সুনামগঞ্জ সদরে হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। সুনামগঞ্জের ৫ এমপি চাইছেন ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন। সিলেট থেকে ছাতক পর্যন্ত রেললাইন বৃটিশ আমল থেকে রয়েছে। আর পরিকল্পনামন্ত্রীর ইশারা ছাতকের আগের স্টেশন গোবিন্দগঞ্জ থেকে শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ রেললাইন। এই দুই প্রস্তাব নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের মুখোমুখি সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ-২ আসনের এমপি ড. জয়া সেনগুপ্ত, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের এমপি পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি শামীমা আক্তার খানম। গত ৬ই জুন ওই ৫ এমপি রেলমন্ত্রীর কাছে একসঙ্গে ডিও দিয়েছেন। সংসদ সদস্যরা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন- নতুন অ্যালাইনমেন্টে রেললাইন স্থাপন করা হলে এর দূরত্ব এবং অর্থ ব্যয় হবে কয়েকগুণ বেশি। পূর্বে করা অ্যালাইনমেন্ট অনুযায়ী স্থাপিত হলে ছাতক-সুনামগঞ্জ রেললাইনের দূরত্ব হবে মাত্র ২২ কিলোমিটার। এই দূরত্বের মধ্যে দু’একটি খাল ছাড়া আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না এবং সুরমা নদী থেকে রেললাইনের দূরত্ব হবে ৩-৪ কিলোমিটার দূরে। যা দেখার হাওরের উত্তর পাশ দিয়ে সুনামগঞ্জে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া রেললাইন স্থাপনে জীববৈচিত্র্যের কোনো অনিষ্ট ও নদী ভাঙনে রেললাইনের কোনো ক্ষতি হবে না। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ উপকৃত হবে বলে মন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমপিরা এ ব্যাপারে ডিও দিলেও পরিকল্পনামন্ত্রীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো কিছু জানা হয়নি। তবে সুনামগঞ্জের সব মহলেই চাউর হয়েছে মন্ত্রীর ইশারায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর গোবিন্দগঞ্জ থেকে শান্তিগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা চালাচ্ছে। এ কারণে এমপিরা সরকারি খরচ কমানো এবং অপর দুই উপজেলাকে সম্পৃক্ত করতে তারা ডিও দিয়েছেন। সম্প্রতি সুনামগঞ্জ সফরকালে নিজ এলাকায় পরিকল্পনামন্ত্রী রেললাইন নির্মাণের অগ্রগতি সম্পর্কে জানান- ‘আমরা সুনামগঞ্জকে রেলের সঙ্গে যুক্ত করবো, এ ব্যাপারে আপনাদের মনে যেন সন্দেহ না থাকে। আমরা এটিকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে যাবো। আমি না পারলে পরের জন পারবে, তার পরের জন পারবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ৫ বছরের মধ্যে এটি সম্ভব। তবে কোন্ দিকে যাবে না যাবে সেটি আমার মতো অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে ঠিক করা সম্ভব নয়। এটা করবেন ইঞ্জিনিয়াররা। এদিকে এই অবস্থায় সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি ড. একে আব্দুল মোমেন সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ রেলপথ নির্মাণকাজ দ্রুত করতে রেলমন্ত্রীর কাছে ডিও দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই ডিওর পর পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দূরত্বের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছিল। পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে তার কোনো দূরত্ব নেই জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরবর্তীতে ১৪ই জুন মিডিয়ায় প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পাঠান। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন- ‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে-দুঃখে সব সময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকবো বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে, সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে! কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করছেন জানি না, তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। যে বা যারা এটি প্রচার করছেন, তারা হয়তোবা কোনো বিশেষ বা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করছেন। ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না, তবে একটি বিশেষ কারণে দিচ্ছি আর তা হলো আমার এবং মান্নানের স্থানীয় অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন আর তাদের মধ্যে যাতে কোনো বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বিষয়টি হালকা করে দিলেও পরিকল্পনামন্ত্রীর দপ্তর থেকে ফেসবুকে পাল্টা স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ডিও লেটারে বিস্মিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। পরিকল্পনা দপ্তরের ফেসবুক পেইজে মন্ত্রী উল্লেখ করেছেন- ‘এটা সত্য যে, ড. মোমেনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরের। কিন্তু তিনি সুনামগঞ্জের পাঁচজন সংসদ সদস্যের পাশে রয়েছেন উল্লেখ করে রেলমন্ত্রীর কাছে যে আধা সরকারি পত্র (ডিও) দিয়েছেন, সেটি আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি যে পাঁচজন এমপি’র পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে একজন জাতীয় পার্টির এমপিও রয়েছেন। আব্দুল মোমেন ভালো করেই জানেন, আমিও (মান্নান) সুনামগঞ্জের একজন সংসদ সদস্য। সুনামগঞ্জের সঙ্গে ছাতকের রেললাইন নির্মাণ নিয়ে তিনি যেমন অবগত, ঠিক তেমনি বিষয়টি আমিও অবগত। আমি যতটুকু জানি, তার বর্ণিল জীবনে তিনি কখনো সুনামগঞ্জে যাননি। সুনামগঞ্জে কখনো তার পা পর্যন্ত পড়েনি। অথচ তিনি রেললাইন নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্য কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কিন্তু আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বন্ধুত্ব একই সঙ্গে আমরা দুজনেই মন্ত্রিসভার সদস্য অথচ তিনি আমার সঙ্গে এ বিষয়ে এতটুকু যোগাযোগ করেননি। আমার সঙ্গে কথা না বলে অন্য পাঁচজন সংসদ সদস্যের পক্ষ নিয়ে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার পাঠানো কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’ পরিকল্পনা দপ্তরের পেইজে দেয়া এই স্ট্যাটাস নিয়ে দুই মন্ত্রীর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। তবে- এখনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ‘প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে ছাতক থেকে সুনামগঞ্জে রেল নিয়ে আসার সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। মন্ত্রী যে দাবি করেছেন- এই ২২ কিলোমিটারের মধ্যে নদী, হাওর রয়েছে, সেটি সঠিক নয়। এদিকে রেল নিয়ে আসলে প্রকৃতির উপর কোনো প্রকার বিরূপ প্রভাব পড়বে না। এটি হচ্ছে অজুহাত। হাওর-পরিবেশের দোহাই দিয়ে তিনি একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করছেন, যাতে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত না হয়। অথচ শত বছরের দাবি ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ হয়ে মোহনগঞ্জে রেল নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় বলছেন ছাতক ও দোয়ারাবাজার এলাকায় মানুষ নাই। এখানে মানুষ নাই তো কি আছে? এটি যোগাযোগবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।’ সুনামগঞ্জ সদর আসনের সংসদ সদস্য ও বিরোধী দলের হুইপ এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহও সোজাপথে ছাতক থেকে রেল নিয়ে আসার পক্ষে। তিনি বলেন, ‘ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জে রেললাইন স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আমরা জাতীয় সংসদে বার বার কথা বলেছি। রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কয়েকবার সমীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। এদিক দিয়ে রেললাইন নিয়ে আসলে দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। এতে রেললাইন নির্মাণ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে, সরকারের অর্থ ব্যয় অনেক কম হবে। পাশাপাশি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ উপকারভোগী হবেন।’M. Zamin