দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান চলাকালে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত এই আদেশ দেন। গত ১৩ জুন আদালত থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে ক্যাসিনোকাণ্ডসহ বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানে হুইপ সামশুল হকের নাম উঠে আসে। তাঁর সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ বেড়েছে বলে অভিযোগ আছে। এর আগে অনুসন্ধান শুরুর পর ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সামশুল হকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়েছিল দুদক। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় আলোচনায় উঠে আসেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাঁর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনসহ পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির বিষয়েও অনুসন্ধান চলছে।
আদালত আরো যে পাঁচজনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন তাঁরা হলেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান সাজ্জাদুল ইসলাম, একই মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল হাই এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের কর্মচারী আবুল কালাম আজাদ। দুদকের আগের বিদেশ গমনের নিষেধাজ্ঞার চিঠিতে হুইপ সামশুল হকসহ ২২ জনের নাম ছিল। সেখানেও ছিল সংসদ সদস্য শাওন, প্রকৌশলী আব্দুল হাই ও ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের আজাদের নাম। অনুসন্ধান চলাকালে এই ব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন বলে গত ৭ জুন নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আদালতে আবেদন করেন দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের হাকিম কে এম ইমরুল কায়েশ এই ছয়জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।
দুদকের পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুসন্ধানদলের প্রধান সৈয়দ ইকবাল হোসেন গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এর আগে ক্যাসিনোকাণ্ডের তথ্য প্রকাশের পর দুদক সামশুল হক চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের ক্ষেত্রে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আসে যে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় আদালতের অনুমতি নিতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারেই সামশুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনের ক্ষেত্রে বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার জন্য আদালতের আদেশের আবেদন করা হয় এবং আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘হুইপ সামশুল হকের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানও চলছে। এ ব্যাপারে একটি টিম কাজ করছে।’ তিনি বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাঁদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে পৃথক আবেদন করা হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে হুইপ সামশুল হক ও সংসদ সদস্য শাওনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি। তবে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আদালতের আদেশের ব্যাপারে আমি এখনো কিছু জানি না।’
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের শত শত কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে বড় বড় ঠিকাদারি কাজ নিয়ে অনিয়ম করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো ব্যবসা করে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় অর্জন করে বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে মর্মে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা তাঁর আবেদনে উল্লেখ করেন। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছেন, সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তিরা (সামশুলসহ ছয়জন) দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। এতে ‘অনুসন্ধান কার্যক্রম দীর্ঘায়িত বা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে’ বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশনা এরই মধ্যে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পৌঁছেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নজরদারি করবে সংশ্লিষ্ট শাখা।
দেশজুড়ে জুয়া, ক্যাসিনো বন্ধে শুরু হওয়া র্যাবের অভিযান সম্পর্কে সমালোচনা করে বিতর্কের জন্ম দেন সামশুল হক চৌধুরী। তিনি বলেছিলেন, ‘তিন-চার ঘণ্টা চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাব ঘিরে রেখে অভিযান পরিচালনা করা হলো। র্যাবের অভিযানে ক্লাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। কোনো ক্লাবে যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জুয়া বা ক্যাসিনো ব্যবসা চলে, তা নিশ্চিত হয়ে এবং খোঁজখবর নিয়েই অভিযান চালানো উচিত।’ তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে ১৮০ কোটি টাকা আয়ের অভিযোগ তোলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এরপর অদৃশ্য শক্তির চাপে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর হুইপ সামশুল হকের কুশপুত্তলিকায় ঘৃণা প্রদর্শন এবং তা ডাস্টবিনে ফেলে প্রতিবাদ জানায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধন করে সংবিধান লঙ্ঘন ও শপথভঙ্গের অপরাধে সামশুল হক চৌধুরীকে অপসারণেরও দাবি জানানো হয়। জুয়ার পক্ষে সাফাই গাওয়ার বিরোধিতা করে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসিয়ে দিনে ছয় লাখ টাকা আয় করেন বলে ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান এবং নগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরী দাবি করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দিদারুলকে হত্যার হুমকি দেন হুইপের ছেলে শারুন। পরে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন দিদারুল।
দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনোকাণ্ডের গ্যাংয়ের সঙ্গেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের হোতা সামশুল হকের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ক্লাবে জুয়ার কারবারে তাঁর জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্যও মেলে। তবে করোনার কারণে অনুসন্ধান পর্যায়েই আছে সব অভিযোগ। নির্বাচনী হলফনামায় প্রদর্শিত সম্পদের বাইরেও নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন সামশুল হক ও তাঁর স্ত্রী। বিদেশে পাচার করেছেন বিপুল অর্থ। ২২ জনের সঙ্গে বিদেশ গমনের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সামশুল হকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) অনুরোধ জানায় দুদক। অভিযোগ তদন্ত করতে ২০১৯ সালেই সামশুল হক চৌধুরীর পিএ নুর উর রশীদ চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন অনুসন্ধানকারীরা।
সূত্র জানায়, যুবদল ও জাতীয় পার্টির রাজনীতি থেকে ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন সামশুল হক চৌধুরী। তাঁর সম্পদ বাড়ছে অস্বাভাবিক গতিতে। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর মাত্র ১০ বছরে সামশুল হক চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে অন্তত এক হাজার ৫৪৬ শতাংশ। তিন নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে সামশুল ও তাঁর স্ত্রী হয়ে উঠেছেন সম্পদশালী। ২০০৮ সালে নির্বাচনে শ্যালক ও ভায়রার কাছ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা এবং নিজের মাত্র ৫০ হাজার টাকা নিয়ে সংসদ নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন সামশুল। ওই সময় তিনি এতই দরিদ্র ছিলেন যে তাঁর হাতে নগদ টাকা ছিল মাত্র এক হাজার ৩৬৯ টাকা। আর তাঁর স্ত্রীর কোনো সম্পদ ছিল না।
২০০৮ সালে সামশুল হক চৌধুরী ২১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৬৯ টাকার সম্পদের মালিক ছিলেন। পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর সম্পদের পরিমাণ বাড়ে ৫৩০ শতাংশ। এই সময়ই তাঁর স্ত্রী লাখপতি হয়ে ওঠেন। ২০১৪ সালে নিজেই ব্যয় করেন ২০ লাখ টাকা। এই সময় সামশুল হকের ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ৪০ লাখ ১২ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০০৮ সালে তাঁর একটি প্রাইভেট কার ছিল। ২০১৪ সালে সেটি পরিবর্তন করে ৬১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি। এই সময়ে তিনি পটিয়ার রশিদাবাদ গ্রামে ‘রাজপ্রাসাদ’ নির্মাণ করেন।
২০১৮ সালের হলফনামায় দেখা যায়, সামশুল দম্পতির ভূ-সম্পত্তি বেড়েছে ৩২ লাখ টাকার। অস্থাবর সম্পদের সঙ্গে ডলার যুক্ত হয় প্রায় ২৭ লাখ টাকার। ব্যাংকে জমা ছিল ৯২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৩৮ টাকা। স্বামী-স্ত্রী দুজনের বন্ড বা ঋণপত্র সম্পদ যুক্ত হয়ে পাঁচ লাখ টাকার সঙ্গে ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও অলংকারের পরিমাণও বাড়ে। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পাহাড় আড়াল করতে সম্পদের মূল্য নামমাত্র দেখিয়েছেন হলফনামায়। কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়ির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। রিয়াজুদ্দিন বাজারের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় ৯০০ বর্গফুটবিশিষ্ট চারতলা ভবন তথা তিন হাজার ৬০০ বর্গফুট ভবনের মূল্য উল্লেখ করেন দুই লাখ ৮০ হাজার টাকা। প্রতি বর্গফুটের দাম মাত্র ৭৭.৭৮ টাকা! এ যেন ‘শায়েস্তা খাঁ’র আমলের বাজারমূল্য।