লিখেছেন ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী
“ও মন রমজানেরও রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ..”
গতবছরের মত এবারো মন্ট্রিয়ালে করোনাজনিত লকডাউনের মাঝে সীমিত পরিসরে রোজার ঈদ পালন করলাম। এক অদ্ভুত সময় এখন। কোনদিন ভাবা হয়নি পর পর দুবছর এভাবে একরকম খাঁচার ভিতর বন্দী হয়ে ঈদ উদযাপন করতে হবে। মন্ট্রিয়ালে শশুরালয়ে শশুর-শাশুড়ী, সহধর্মিনীর পরিবারের ভাই-ভাবী, ভাগ্নে-ভাগ্নির সাথে ছোট ভাই মাহী ও তার স্ত্রী মুমু সহ ঈদের দিনটা বাসার ভেতর গতবারের চেয়ে অনেক জমজমাটই কেটেছে। কিন্তু সোশ্যাল গ্যাদারিং এর বাধ্যবাধকতায় আর সব বারের মত প্রতিবেশী বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঈদ সাক্ষাত সেভাবে হয়ে ওঠেনি। মনের ভেতর উঁকি দিয়ে উঠলো একেবারে শৈশবে মাইজদিতে নানার বাড়িতে নানু, মামা, খালা, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে কোন রকম বাধাবিহীন রোজার ঈদ পালনের সেই মধুর স্মৃতিগুলো। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশী সবার সন্মীলনে কী এক আনন্দময় রোজার ঈদই না পালন করতাম মাইজদিতে!
মাতুতালয়ে জন্মের পর হতে ৮০র দশকের মাঝামাঝি-৮৭ সাল পর্যন্ত মাইজদিতে নানুর বাড়িতেই আমাদের রোজার ঈদ পালন করা হত। আমার জন্মের পর হতে ৮৪ সালের শেষ নাগাদ মাইজদি বাজার ও শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামের মাঝামাঝি নাপতার পুলের কাছে-৯৮ কানুগাজী মসজিদ রোডস্থ নানুর বাড়ির চৌহদ্দিতেই আমরা থাকতাম। এরপর স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে এলেও ৮৭ সাল পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ দিকে দলবেঁধে সবাই নানুর বাড়িতে চলে আসতাম-রোজার ঈদ পালন করতে। পরবর্তীতে ৮৮ সালে নানুরা স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসলে আমাদেরও মাইজদিতে রোজার ঈদ পালনের ইতি ঘটে।
# রোজার দিনের স্মৃতি:
(১)
মাইজদিতে রোজার দিনগুলোর কিছু স্মৃতি এখনো বেশ মাথায় আছে। ছোট ছিলাম বলে রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা ততটা ছিলনা। একেবারে শুরুতে আর সব শিশুর মত সেহরি খেয়ে সারদিনে একবার বা দুবার খেয়ে একদিনে ‘দুই’ টা বা ‘তিন’টা রোজা রাখতাম! এরপর কয়েক বছর পরীক্ষামুলকভাবে একটা বা দুটো পূর্নাংগ রোজা রাখা হত- প্রথম, শেষ কিংবা ২৭ শে রোজা। পরবর্তীতে এই সংখ্যা ৫, ৭, ১০, ১৫ এইরকম করে বেড়ে এক সময় ৩০ রোজাই রাখা শুরু হয়।
মাইজদির দিনগুলোতে রোজার সময় রাত আড়াইটা বা তিনটার দিকে কোর্ট বিল্ডিং আর মাইজদি বাজারের দিক হতে দুইটা সাইরেনের শব্দে সেহরির জন্য ঘুম ভাংতো বা আব্বা-আম্মা ডাক দিয়ে ঘুম ভাংগাতেন। ঘুমানোর আগে অতি উৎসাহ থাকলেও সেহরির সময় আরামের বিছানা ছেড়ে সেহরি করতে মন বেশী চাইতোনা। তারপরও আব্বা-আম্মার ডাকাডাকিতে একসময় কোনরকমে পানি দিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে সেহরি করতে বসতাম।
আম্মা সাধারনত সেহরির তরকারী আগের দিন বিকালে বা সন্ধ্যার দিকে তৈরী করে রাখতেন আর ভাত রান্না করতেন সেহরির সময়। সেহরির সময় সবার থালায় গরম ভাত সহযোগে তরকারী বেড়ে দেয়া হত। আবার কখনো কখনো আব্বার হাতেই ভাত খেয়ে নিতাম। সেহরিতে মুরগী, গরুর মাংশ আর ডালই বেশী খাওয়া হত-কখনো কখনো থাকতো বড় মাছের কোন তরকারী। তরকারী দিয়ে প্রথম দফার ভাত খাওয়া শেষ করে গরম দুধ, আম বা কলা দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ভাত খাওয়া হত। কোন কোন সময় আবার দাদার বাড়ি হতে পাঠানো কিংবা নানুর নিজের হাতে তৈরী টক আমসত্বের সাথে গুঁড় আর দুধ মাখানো ভাত খেয়ে খাবারের দ্বিতীয় পর্বটা সারতাম। ঘরে বানানো শক্ত আমসত্ব আগের দিন সারাদিন পানিতে ভিজিয়ে নরম করা হত যাতে সেহরির সময় ভাতের সাথে সহজে মিশিয়ে খাওয়া যায়।সেহরির শেষে আম্মা আবার নিয়ম করে গরম চা খেতেন। কোনভাবে এটা মিস করলে পরদিন উনার খুব মাথাব্যথা করতো। সেহরিতে চা খাবার এই রেয়াজ আমাদের বাসায় এখনো চালু আছে। সেহরির শেষ সাইরেন বাজার সংগে সংগে আমরা শেষবারের মত পানি খেয়ে অজু করে বাসাতেই ফজরের নামাজ পড়ে ফেলতাম। ফজর নামাজের পর আম্মা( আব্বা থাকলে উনিও) একটু কোরান শরীফ পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। আম্মা বা নানুকে দেখতাম নামাজের পর রান্নার হাড়িতে ঢাকনা দিয়ে ঘরের কোনে ঝুলানো দড়ি বা নারকেলের ছোবড়ায় তৈরী শিকায় তুলে রাখতেন- বিড়াল বাবাজির হাত হতে খাবারকে রক্ষা করার জন্য।
(২)
রোজার পুরো মাস স্কুল বন্ধ থাকতো বলে সকালে ওঠার তাড়া অতটা থাকতোনা। তারপরও সেহরিতে অতিরিক্ত পানির খাবার ফলে ‘নিম্নগামী’ চাপে সকাল সকাল ঘুম ভেংগে যেত। বিরক্তি নিয়ে কোন রকমে ঘুম জড়ানো চোখে ‘ছোট’ কাজটি সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়তাম। যাই হোক, সকাল নয়টা-দশটার দিকে পুরোপুরি ঘুম ভেংগে যেত। সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে কিছুক্ষন স্কুলের পড়ালেখা করে দুপুরের দিকে আবার জোহর নামাজের প্রস্তুতি নিতাম। দুপুরের পর আব্দুর রব হুজুর আসতেন আরবী পড়াতে। উনার কাছে আমরা বয়স অনুযায়ী কায়দা, আমপারা আর কোরান শরীফ পড়তাম। আম্মা-নানু-খালারাও সারাদিন নামাজ, দোয়া-দরূদ আর কোরান শরীফ পড়তেন। রোজার মাসে উনারা একবার অন্তত কোরান শরীফ খতম করতে চাইতেন। মফস্বল শহর বলে মাইজদিতে এমনিতেই কোলাহল বেশ কম ছিল। তো রোজার দিনে লোকজনের চলাফেরা ও ব্যস্ততা কমে গিয়ে জীবনযাত্রা আরো অলস ও স্থবির হয়ে পড়তো। বিশেষ করে দুপুর পর্যন্ত শহরটা একরকম ঘুমিয়েই থাকতো। এক শুনশান নিরবতা বিরাজ করতো পুরো শহর জুড়েই। আমরাও রোজার সময় পাড়ায় অতটা হৈ-হুল্লুড় না করে বিকেলের দিকে নানুর বাড়ির উঠানেই টুকটাক খেলাধুলা করতাম। দুপুরের পর- আসরের নামাজের একটু আগ থেকেই আম্মা আগের দিনের ভেজানো নরম ছোলার সাথে সুগন্ধী মসলা আর ছোট ছোট আলুর টুকরা মিশিয়ে ইফতারের জন্য বুট ভাজার কাজ শুরু করতেন। রান্নার সময়ে জিহ্বার আগায় সামান্য একটু বুটের ঝোল নিয়ে অনেক সময় লবন পরীক্ষা করতেন। রোজা না রাখলে আমি বা ভাইয়া এই লবন পরীক্ষার কাজটি সুচারুরূপে পালন করতাম। বুট ভাজার সময় মসলার সুগন্ধ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়তো যে লোভ সম্বরন করা খুব কঠিন ছিল। আমি বুট ভাজা খেতে অনেক পছন্দ করতাম ( এখনো করি)। অনেক সময় আম্মাকে বলে রান্নার গরম হাঁড়ি থেকে একটা বাটিতে কয়েক চামুচ বুট ভাজা নিয়ে ইফতারের অনেক আগেই এক দফা খেয়ে নিতাম। ইফতারের বুট ভাজার সাথে মাঝে মাঝে ইফতারের পরের রাতের খাবার বা সেহরির তরকারী রান্না হত। গরম গরম রান্না করা খাবারের গন্ধে পুরো ঘরের বাতাস মৌ মৌ করতো। ইফতারের কিছুক্ষন আগে আম্মা ডালের বড়া ( পেঁয়াজু) ভাজার কাজ শুরু করতেন। আমাদের মাইজদি জীবনের ইফতারিতে ঢাকার মত বেগুনী, ঘুঘনি, বিরানি বা হালিম খাবার প্রচলন ছিলনা। জিলাপি খাবার রেয়াজও ছিল কম। তবে পেঁয়াজুর সাথে আম্মা মাঝে মাঝে পাতলা করে স্লাইস করা আলুর টুকরা সামান্য বেসনে মাখিয়ে ভেজে রাখতেন ইফতারের জন্য। এই আলু ভাজাটা আমার বিশেষ পছন্দের ছিল-সত্যি বলতে কী পেঁয়াজুর চাইতেও বেশী ভালো লাগতো। এই ভাজাপোড়ার বাইরে ভেজানো মুরি বা চিড়ার সাথে দুধ, কলা মিশিয়ে একটা ‘ঠান্ডা আইটেম’ সবসময় আমাদের বাসার ইফতারিতে রাখা হত। আব্বা-আম্মা এটা নিয়মিত খেতেন। ইফতারের জন্য একটা কাঁচের জগ ভরে আম্মা লেবুর শরবত তৈরী করে রাখতেন। রোজা না রাখলে সে শরবতের চিনিও আমরা পরীক্ষা করতাম। গরমের দিনে ইফতারের সময় আব্বা গুঁড় দিয়ে তৈরী বেলের শরবত খেতে পছন্দ করতেন-ঐটা নাকি পেট অনেক ঠান্ডা রাখতো। আমার অবশ্য বেলের চাইতে লেবুর শরবতই বেশী ভালো লাগতো। পাশেই নানুর বাসায় ইসুব গুলের ভূঁসি, রূহ-আফজা বা তোকমার শরবত তৈরী করা হত। আমরা মাঝে মাঝে সেই শরবতও একটু চেখে দেখতাম। ইফতারের জন্য আগে থেকেই দোকান থেকে কেনা প্যাকেট হতে কয়েকটি খুরমা খেজুর নিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে একটা পিরিচে রাখা হত। খেজুরের সাথে সিজন অনুযায়ী ক্ষিরা, তরমুজ, ফুঁটি (বাংগী), পেঁপে, কিংবা মিষ্টি ল্যাংড়া বা ফজলি আম কেটে রাখা হত। নানুর বাড়িতে অনেকগুলো আম গাছ ছিল। এর মধ্যে নানুর ঘরের পিছনের একটি ফজলি জাতের আম গাছের আম বেশ বড় ও মিষ্টি হত এবং এই বিশেষ আমটিতে কোন পোকা হতনা (আম্মারা এটাকে মালদহের আম বলতেন)। আমের সিজনে প্রায়দিনই এই গাছ হতে একটা বা দুটো পাকা আম উঠানে বা নানুর বাসার চালে ঝরে পড়তো। আমি বা ভাইয়া সেই আম কুড়িয়ে বাসায় নিয়ে কেটে খেতাম। আমি ফুঁটি খেতে অত পছন্দ করতাম না-বিস্বাদ লাগতো বলে। তবে ফুঁটির উপর একটু চিনি ছড়িয়ে দিলে খেতে অত খারাপ লাগতোনা। সবচেয়ে ভালো লাগতো ইফতারের আইটেমে তরমুজ থাকলে- ইফতারের সময় রসালো মিষ্টি তরমুজের আসলে কোন তুলনাই হয়না। আমরা এক একটা ইফতারে প্রায় অর্ধেকের মত তরমুজই শেষ করে ফেলতাম। বাসায় সেহরি এবং ইফতারের সময়-সম্বলিত একটা ক্যালেন্ডারে চোখ থাকতো ঐদিনের ইফতার বা সেহরির শেষ সময় ঠিক কয়টায়। ঢাকার সাথে মাইজদি/নোয়াখালীর ইফতার বা সেহরির দুই-তিন মিনিটের ব্যবধান থাকতো এবং সেটা রোজার সময়ের ঐ বিশেষ ক্যালেন্ডারে উল্লেখ করা থাকতো। ইফতারের একটু আগে আগে রেডিও চালিয়ে সুরা, হাম্দ বা নাত শুনতে শুনতে ইফতারের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম। ‘ইয়া ইলাহি দে পানা’, অন্য কোন হাম্দ বা নাত এবং দোয়া- দরূদ শুনতে শুনতে এক সময় ইফতারের জন্য সাইরেন বেজে উঠতো আর আমরা খেজুর বা শরবত খেয়ে ইফতার শুরু করতাম। স্থানীয়ভাবে আমাদের ওখানে ইফতারের জন্যসাইরেন বাজার প্রায় দুই-তিন মিনিট পরে রেডিওতে মাগরিবের নামাজের আজান বেজে উঠতো-ঢাকার ইফতারের সময়ের সাথে মিল রেখে। ইফতারির আইটেমগুলো প্রথমে আলাদা আলাদা ভাবে খাবার পর আব্বা নিজ হাতে একটা স্টীলের বড় বোলে মুরি, বুট আর পেঁয়াজু মিশিয়ে একটা মুরি মাখানি তৈরী করতেন যা সাধারনত আমরা মাগরিবের নামাজ পড়েই খেতে বসতাম। ঢাকার মত এই মুরি মাখানিতে ডাবলি/ঘুঘনি, মাংশের ঝোল, বিরানি,জিলাপি বা হালিম মিশানোর চল ছিলনা। তারপরও তেল, কাঁচা মরিচ, টমেটো আর সর্ষের তেল সমেত আব্বার হাতে বানানো আমাদের এই মুরি মাখানিও খেতে মন্দ ছিলনা। তবে আমার কাছে মুরি মাখানি ততক্ষনই ভালো লাগতো যতক্ষন পর্যন্ত মুরিটা মচমচে থাকতো। মুরি একটু চিমসে গেলে আমার আর মুরি মাখানি খেতে ভালো লাগতোনা। ইফতার শেষে আম্মা কিছু বুট আর পেঁয়াজু তুলে রাখতেন এশা আর তারাবীর নামাজের পর হালকা নাস্তা হিসেবে খাবারের জন্য। এশার নামাজের ওয়াক্ত শুরু হবার আগে আম্মা প্রায়ই চলে যেতেন আমাদের বাসার পাশেই নানুর বাসায়- নানু আর খালাদের সাথে একটু গল্প-গুজব করতে। নানুর বাসায় কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে আম্মা আবার আমাদের বাসায় চলে আসতেন-এশা আর তারাবীর নামাজ পড়তে। মাঝে মাঝে আম্মার সাথে আমরাও নানুর বাসায় চলে যেতাম এবং উনাদের ঐদিনের ইফতারের আইটেমও একটু চেখে দেখতাম। ঐ সময় আমরা আমাদের বাসাতেই এশা এবং তারাবীর নামাজ আদায় করতাম। এশার নামাজ শেষে আব্বা-আম্মা দীর্ঘ বিশ রাকাত তারাবীর নামাজ আদায় করতেন। ছোট ছিলাম বলে তারাবির নামাজ ঐভাবে পড়া হতোনা। তবে এশা ও বেতর নামাজ ঠিকই আদায় করতাম। নামাজ শেষে সবাই মিলে আবার ইফতারের সময় তুলে রাখা দুএকটা পেঁয়াজু আর বুট ভাজা খেয়ে দেখতাম। সেহরিতে উঠার তাড়া থাকায় আর কিছুক্ষন পরে হালকা করে রাতের ভাত খেয়ে রাত প্রায় দশটা-এগারটার দিকে ঘুমিয়ে পড়তাম। পেট ভরা থাকলে কখনো কখনো রাতের এই ভাত খাবার পর্বটা বাদ দেয়া হত। আমাদের বাসায় রোজার সময়ের এই রুটিন এখনো কিছুটা বজায় আছে।
# রোজার ঈদের প্রস্তুতি:
(১)
মাইজদিতে নানুর বাড়ির চৌহদ্দিতেই-আলাদা একটা ঘরে তখন আমরা থাকতাম (প্রথমে মাঝখানের ঘরে, পরে কাবা খালাম্মার বিয়ের পর দক্ষিনের ঘরে)। আমরা বলতে মুলত আম্মা, মিজান ভাইয়া, আমি ও ছোট ভাই রুমী (সবচেয়ে ছোট ভাই মাহীর জন্ম অনেক পরে, ঢাকায়)। আব্বা তাঁর চাকুরী/ব্যবসা উপলক্ষে মুলত ঢাকা বা চট্টগ্রামেই থাকতেন- সপ্তাহান্তে বা ঈদের ছুটিতে মাইজদি আসতেন। ঈদের অল্প কয়েকদিন আগে আমার কুমু খালাও চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে নানুর বাসায় আসতেন ঈদের ছুটিতে। হান্নান মামা সবেমাত্র ঢাকায় উনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছেন। কাবা খালা, মুন্নী খালা আর সবচেয়ে ছোট খালা আমেনা খালা ( আমাদের কচি আন্টি) তখনো মাইজদিতেই স্কুলে বা কলেজে পড়তেন। কিছুদিন পর অবশ্য মুন্নী খালাও ঢাকায় উনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেন। আমার অকালপ্রয়াত বড় খালার দুই ছেলে-মেয়ে- আলো ভাইয়া ও সাহানা আপাও উনাদের দাদারবাড়ি বাংলাবাজার হতে মাইজদিতে আসতেন নানুর বাড়িতে রোজার ঈদটা উদযাপন করতে। ঈদের কয়েকদিন আগ থেকেই আমি আর মিজান ভাইয়া নানুর বাসা সংলগ্ন ‘জনতা স মিলে’র পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিনে বিস্তৃত শহরের প্রধান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম ঢাকা হতে আসা হাক্কানী পরিবহন, উদয়ন বা জননী পরিবহনের বাস হতে কখন হান্নান মামা, মুন্নী আন্টি কিংবা চট্টগ্রাম/ঢাকা হতে আসা বাস হতে কুমু আন্টি-কাদের মামা বা আব্বা নামেন। উনাদের কাউকে বাস হতে নামতে দেখলেই আমরা দৌড়ে গিয়ে উনাদের জড়িয়ে ধরতাম, উনাদের দু-একটা ব্যাগ হাতে নিতাম আর দৌড়ে গিয়ে আম্মা বা নানুকে খবর দিতাম। ৮০ সালের দিকে কুমু আন্টি এবং ৮৩ সালের দিকে কাবা আন্টির বিয়ের সুবাদে আমার দুই খালু- কাদের মামা ও হাফিজ মামা এবং আরো তিন কাজিন তানিয়া, লিসি ও জেসির আগমনে রোজার ঈদের সময় নানুর মাইজদির বাসাটি বড় উৎসবমুখর হয়ে উঠতো! ব্যাপক গল্পগুজব, খাওয়া-দাওয়া, নিকট আত্মীয় ও মামা-খালাদের বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় সমগ্র নানুর বাড়িই এক উচ্ছল আনন্দে ভরে উঠতো। পরবর্তীতে ৮৪ সালের শেষে আমরা স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে গেলে রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে আমরা, কুমু আন্টিরা, হান্নান মামা আর মুন্নী আন্টি কখনো সায়েদাবাদ হতে ঢাকা-মাইজদি’র বাসে করে আবার কখনো কমলাপুর হতে সদ্য চালু হওয়া আন্তনগর ট্রেন ‘উপকুল’ এক্সপ্রেসে চড়ে একসাথে আয়োজন করে মাইজদিতে নানুর বাড়িতে চলে আসতাম- রোজার ঈদ পালন করতে। অন্যদিকে, কাবা খালাম্মা- হাফিজ মামারা ৮৫ সালের দিকে চট্টগ্রামে চলে গেলেও রোজার ঈদ পালন করতে আমাদের মত উনারাও ঈদের দিন কয়েক আগে ‘চট্টগ্রাম-মাইজদি’র বাসে চেপে নানুর বাড়িতে চলে আসতেন। ঈদের ঠিক আগে আগে আমার সব খালা-মামা-খালু আর খালাতো ভাইবোনদের এই মিলনমেলায় নানুর বাসাটি বড় জমজমাট হয়ে উঠতো!
(২)
পনেরো রোজার পর থেকেই আমরা সময় গুনতে থাকতাম কখন ঈদ হবে-২৯ না ৩০ রোজা এবার-নতুন কী জামাকাপড় পরা হবে এই ঈদে! ২৯ রোজার ইফতারের পরপরই ঈদের চাঁদ দেখার জন্য পাড়ার হোসেন মামার দোকানের সামনে আমরা পাড়ার ছেলেপেলেরা গিয়ে জড়ো হতাম-খালি চোখে ঈদের চাঁদ দেখতে। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে নতুন চাঁদের সরু চিকন রেখার দেখা পাওয়া বেশ দুরূহ ছিল। রেডিও বা টিভির অফিসিয়াল ঘোষনার জন্য অপেক্ষা করতে হত তখন। অনেক সময় রাত নয়টা বা দশটার দিকে ফাইনাল ঘোষনা আসতো পরের দিন ঈদ হবে কি হবে না। যাই হোক, ইফতারের পরপর খালি চোখে ঈদের চাঁদ দেখা গেলে পাড়ার সবাই মিলে কিছুক্ষন হইহুল্লুড় করে বাসায় ফিরতাম-পরেরদিনের ঈদের প্রস্তুতির জন্য। রাত আটটা বা নয়টার দিকে একটা দীর্ঘ সাইরেন বেজে উঠে পরদিন ঈদ পালনের সংকেত দিত। চাঁদ দেখার পর অনেক সময় আমরা নানুর বাসার পাশেই পিন্টু নানার ( আম্মার নানার বাড়ি-নূরমহল যেখানে খুব ছোটবেলায় বড় আম্মা ও বড় আব্বার সাথেও দুই একবার ঈদ করার স্মৃতি রয়েছে) বাসায় চলে যেতাম- উনাদের তখনকার সাদা-কালো ২০” ‘ন্যাশনাল প্যানাসনিক’ টিভিতে ‘ও মন রমজানেরও রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গানটি শুনতে। ঈদের চাঁদ দেখে বাসায় আসার পর আমাদের সম্পূর্ন মনোযোগ এবং আলোচনা কেন্দ্রীভুত হত ঈদের দিনের জামা-কাপড়, ঈদ-সালামী, খাওয়া-দাওয়া ও ঘোরাফেরার প্ল্যান নিয়ে।
# ঈদের নতুন জামা–কাপড়:
(১)
আমাদের একেবারে ছোটবেলার রোজার ঈদগুলোতে আম্মা সাধারনত উনার নিজের ‘ঊষা’ সেলাই মেশিনেই আমাদের তিন ভাইর জন্য ঈদের নতুন জামা-কাপড় সেলাই করে দিতেন ( সবচেয়ে ছোট ভাই মাহী তখনো পৃথিবীতে আসেনি)। ঈদের বেশ কয়েকদিন আগেই মাইজদির কোন দোকান হতে কাপড় কিনে আম্মা আমাদের তিন ভাইর জন্য নানারকম ডিজাইনের শার্ট বানিয়ে দিতেন। মনে আছে একবার ঈদে আমাকে আর মিজান ভাইকে গাঢ় ঘিয়া কালারের উপর চিকন জরি আর নীল স্ট্রাইপের একটা বিশেষ ‘ডিস্কো’ স্টাইলের শার্ট বানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই শার্টের নিচের দিকটায় একটা ইলাষ্টিক লাগিয়ে শার্টের কাপড়টা একটু কুঁচিকুঁচি করে সেলাই করা হয়েছিল।এই কুঁচিকুঁচি ডিজাইনের জন্য শার্টের নীচের দিকটা প্যান্টের উপর ঠিক বসে থাকতো-শার্ট ‘ইন’ করার কোন ঝামেলা পোহাতে হতোনা। এই ‘ডিস্কো’ শার্টটা সেসময়ের তুলনায় একটু আধুনিকই মনে হতো আর আমরাও এই শার্ট পরে নিজেদের বেশ ‘স্টাইলিশ’ মনে করতাম! আম্মা তার মনের মাধুরী মিশিয়ে ছোটবেলায় মিজান ভাইয়া, আমাকে আর রুমীকে এরকম কত জামা-কাপড় যে সেলাই করে পরিয়েছিলেন তার শেষ নেই! আমার পরে একটা মেয়ের শখ ছিল বলে ছোট ভাই রুমীর জন্য আম্মা ঐসময় সাধারনত মেয়েদের স্টাইলেই জামা সেলাই করতেন। বলা বাহুল্য, আম্মা সে আমলে নিজের হাতে সেলাই করতে ভীষন পছন্দ করতেন। উনি শুধু আমাদের জন্যই না মাইজদিতে থাকাকালীন সময়ে আমাদের খালাদের জন্যও ঈদের সময় কাপড় কিনে নিজ হাতেই বিভিন্ন স্টাইলে কাপড় কেটে উনার সেই ‘ঊষা’ সেলাই মেশিনেই সালোয়ার-কামিজ বানিয়ে দিতেন। আমি নিজেই কাবা খালা, মুন্নী খালা, আমেনা খালা আর সাহানা আপাকে আম্মার হাতে সেলাই করা অনেক জামা পরতে দেখেছি। বড় গুনী ছিলেন আমার আম্মা-যেমন ভালো ছাত্রী ছিলেন তেমনি ভালো রান্না করতেন, ভালো সেলাই করতেন। আব্বা চাকুরী/ব্যবসা উপলক্ষে বেশীর ভাগ সময়ই চট্টগ্রাম বা ঢাকা থাকতেন। বলা যায় আম্মা ঐসময় একরকম একলা হাতেই আমাদের সংসারটা সামলেছেন-আমাদের তিন ভাইকে বড় করেছেন। উনার মেট্রিক পরীক্ষার পাঁচদিন আগে মিজান ভাইয়া, আইএ পরীক্ষার কিছুদিন পর আমার আর বিএ পরীক্ষার পরপর রুমীর জন্ম। নিজে পড়েছেন, আবার ছোট ছোট তিন বাচ্চার সংসারও সামলেছেন-অবশ্য নানুর বাড়িতে নানু, খালা-মামাদেরও অনেক সাপোর্ট পেয়েছেন। মিজান ভাইয়া, আমাকে আর রুমীকেতো আম্মা সেই হাই স্কুল পর্যন্তও পড়িয়েছেন, নিজ হাতে আমাদের নোট করে দিয়েছেন- গড়ে দিয়েছিলেন আমাদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস আর সাংস্কৃতিক অংগনের প্রতি আমাদের চিরায়ত অনুরাগ ও ভালোবাসার প্রাথমিক বুনিয়াদ। সেই সাংস্কৃতিক ধারা এখনো বহমান আমাদের দেহে-মনে-প্রানে!
(২)
আব্বা ব্যবসার কাজে ঢাকা বা চট্টগ্রামে রোজার পুরোটা সময় কাটিয়ে ঈদের এক বা দুদিন আগে মাইজদিতে আসতেন-পরিবারের সাথে ঈদ করতে। আসার সময় আমাদের ভাইদের জন্য ঈদের নামাজে পরার সুন্দর টুপি, পায়জামা-পান্জাবী, কর্ডের হাফপ্যান্ট বা ঐসময়ের প্রচলিত তার্কিশ গেন্জি (পোলো) কিনে আনতেন। আম্মা হয়তো কাপড় কিনে নিজের হাতে ঈদের বেশ কয়েকদিন আমাদের জন্য শার্ট বানিয়ে রাখতেন কিন্তু আমাদের প্রধান আকর্ষন থাকতো কখন আব্বা আসবেন-ঈদের রেডিমেইড জামাকাপড় বা নতুন জুতা বা স্যান্ডেল কখন হাতে পাবো। ঈদের আগের রাতে নতুন জামাকাপড় আর জুতা-স্যান্ডেল বালিসের পাশে রেখে কিছুক্ষন পরপর গন্ধ শুঁকতাম। পরদিন কখন এই নতুন জামাকাপড় পরে বের হবো এই উত্তেজনায় ঘুম আসতোনা চোখে! এখনো বেশ মনে পড়ে কোন এক ঈদে আব্বার দেয়া একটা কালো রংয়ের লম্বা ভেলভেটের টুপির কথা যা পরে পরপর বেশ কয়েকবছর ঈদের নামাজ পড়েছিলাম। এই ভেলভেটের টুপিটা সত্যিই অনেক সুন্দর ছিল। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগতো টুপিটার মসৃন ভেলভেট কাপড়ের উপর ক্রমাগত আংগুল বুলিয়ে দেখতে-বিশেষ আরাম বোধ হোত হাতে! আরেকটি ঈদে আব্বা আমাদের ভাইদের জন্য ঢাকা হতে কমলা-হলুদের উপর চিকন লাল স্ট্রাইপের তার্কিশ গেন্জি কিনে এনেছিলেন যা আমাদের খুব পছন্দ হয়েছিল। আরো মনে পড়ে ঢাকা থেকে ঈদের সময় আব্বার এনে দেয়া নেভি ব্লু বা মেরুন রংয়ের কর্ডের হাফপ্যান্টের কথা। সে সময় কর্ডের প্যান্টের বেশ প্রচলন ছিল দেশে! ডিজাইন আর কোয়ালিটি ভালো ছিল বলে আম্মা ঈদের পর এই তার্কিশ গেন্জি এবং কর্ডের প্যান্টগুলো যত্ন করে ধুয়ে তুলে রাখতেন- শুধুমাত্র বড় কোন অনুষ্ঠানে বা কোথাও বেড়াতে গেলে পরার জন্য। কালো ভেলভেটের উপর চিকন স্ট্রাইপের একটা ঈদের হাফপ্যান্টের কথাও বেশ মনে পড়ে। এই হাফপ্যান্টটা একটু টাইট হয়েছিল। এই হাফপ্যান্টেরই জীপার লাগানোর সময় বেমক্কা একবার আমার অতি আপন ‘সম্পদ’টির চামড়ায় জীপারের চেইনটা আটকে গিয়ে চরম বিপদে ফেলে দিয়েছিল আমাকে! নানা কসরত করে সেই জীপারের চেইনটি ছুটিয়ে আনতে প্রচন্ড ব্যথায় চোখ-মুখ পানিতে ভরে উঠেছিল। পরবর্তীতে জীপার সংক্রান্ত এইধরনের বিপদে আরো বেশ কয়েকবার পড়েছিলাম-প্রতিবারই উদ্ধার পেতে জান ওষ্ঠাগত হয়েছিল! আমাদের কালের ছেলেপেলেদের সবারই বোধ হয় ‘জীপার’ জনিত এই ‘সুখ- স্মৃতি’ কম-বেশী আছে! ভুক্তভোগীই কেবল জানে এই জীপার আটকানোর যন্ত্রনা কী! ঢাকা থেকে আমাদের ঈদের নতুন জামা-কাপড়ের সাথে আব্বা আবার সুগন্ধী আতর আর পারফিউমও ( আমরা এটাকে তখন ‘সেন্ট’ বলতাম) নিয়ে আসতেন। ঈদের দিন সকালে বড় আব্বাদের বাসার সামনের পুকুরে গোসল শেষে নতুন পান্জাবীতে আর হাতের তালুর উল্টাদিকে এই আতর খানিকটা মেখে আমরা ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। আতরের এই গন্ধ সারাদিন ধরে হাতের মধ্যে লেগে থাকতো। তবে তেল বেইজ্ড ছিল বলে অনেক সময় পান্জাবীর আতর দেয়া জায়গাটা হলুদ হয়ে ফুটে উঠতো। দেখতে খুব একটা ভালো লাগতোনা তাই ঈদের নামাজ শেষে তাড়াতাড়ি পায়জামা-পান্জাবী বদলে ঈদের নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে ফেলতাম। নতুন শার্ট বা গেন্জি পরে তার উপর আব্বার আনা সুগন্ধী ‘সেন্ট’টা স্প্রে করে ঈদের দিনে মানুষের বাসায় বেড়াতে যেতাম। তৈলাক্ত না হওয়ায় এবং স্নিগ্ধ সুন্দর গন্ধের জন্য আমি আতরের চেয়ে ‘সেন্ট’ ব্যবহার করতেই বেশী পছন্দ করতাম। নতুন জামা-কাপড়ের সাথে ‘সেন্ট’ এর এই সুগন্ধ সারাদিন মনটাকে এক অদ্ভুত সুন্দর অনুভুতিতে ভরিয়ে রাখতো!
(৩)
একবার ঈদের সময় কী কারনে যেন আব্বার ঢাকা থেকে মাইজদি আসতে দেরী হচ্ছিল। টেলিফোন বা যোগাযোগের আর কোন ব্যবস্থা না থাকায় জানার উপায় ছিলনা উনি আদৌ রওনা দিয়েছেন কিনা ঢাকা হতে। আমরাতো অধীর আগ্রহে বাসায় অপেক্ষা করছিলাম কখন আব্বা আসে আর আমরাও আমাদের ঈদের নতুন কাপড় হাতে পাবো। কিন্তু ঈদের আগের দিন সারাদিন পেরিয়ে সন্ধ্যা নাগাদও আব্বার যখন কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যাচ্ছিলনা আম্মা, নানু আর খালাদেরকে কোন এক অজানা ভয়ে বেশ আশংকাই করতে দেখলাম। আমার আব্বা বুঝি হারিয়েই গেল! আম্মা মনে হয় এক পর্যায়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন- উনার ‘মিজানের আব্বার’ কোন বিপদ হলো কিনা এই আশংকায়। উনাদের শংকা দেখে আমরা ছোটরাও একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তবে মনে হয় ভয়ের চাইতে নতুন কাপড় না পাবার আশংকায় আরো বেশী দু:খ পাচ্ছিলাম। এমন দু:খ ভারাক্রান্ত মনে অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে আমরা ভাইরা সবাই ঘুমিয়েই পড়ি। গভীর রাতে-মনে হয় একটু সকালের দিকেই, আব্বার কথার আওয়াজে হালকাভাবে আমার ঘুম ভেংগে যায়। সেই ঘুম জড়ানো চোখেই আব্বাকে দেখে এবং সেই সাথে আমাদের জন্য আনা ভেলভেটের হাফ প্যান্ট, কালো লম্বা টুপি, তার্কিশ গেন্জি আর সেন্টের বোতল ইত্যাদি দেখে খানিকটা ‘আস্বস্ত’ হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
(৪)
আরেকবার ঢাকা হতে মাইজদি যাবার সময় কী কারনে যেন আমাদের ঈদের জামা-কাপড় কেনা হয়নি। কথা ছিল আব্বা ঈদের ঠিক আগে আগে ঢাকা হতে মাইজদিতে এসে আমাদের নতুন জামা-কাপড় কিনে দিবেন। আমাদের মন একটু খারাপ ছিল কারন মাইজদিতে হয়তো বেশী চয়েস থাকবেনা- নিজের পছন্দের জামা-কাপড়ও হয়তো কেনা হবেনা। যাই হোক, আব্বার জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন দেখলাম যে ঈদের আগের দিন দুপুরের মধ্যেও উনি আসছেন না মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার এই মন খারাপ করা দেখে কুমু খালা বিকেলের দিকে তাড়াতাড়ি করে মাইজদি পৌরসভার নিচে ‘কসকর’ নামক এক বিপনী বিতান হতে আমার জন্য একটি গেন্জির সেট কিনে এনে হাতে তুলে দেন। একেবারে শেষ মুহুর্তে কুমু খালার কাছ হতে ঈদের নতুন জামা হাতে পেয়ে কী যে আনন্দ লেগেছিল তখন ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। যদিও গেন্জির সাথের হাফপ্যান্টটা আমার ঐ সময়ের বয়সের তুলনায় একটু বেখাপ্পা রকমের ডিজাইনের ছিল (কোন বকলেস বা বোতাম ছিলনা)। তাই একটু লজ্জা নিয়েই ঈদের দিন নতুন গেন্জির সাথে ঐ প্যান্টটা পরেছিলাম। আব্বা সময়মত না আসায় একটু টেনশনে পড়লেও কুমু খালার কল্যানে সেবার একেবারে শেষ মুহুর্তে ঈদের নতুন জামা-কাপড় হাতে পেয়েছিলাম। এই ছোট কিন্তু বিশাল তাৎপর্যময় ঘটনাটি শৈশবে আমার মনে অনেক রেখাপাত করেছিল-ঘটনাটির স্মৃতি আমার হৃদয়ে চির অম্লান!
# ঈদের আগের রাত:
শেষ রোজার ইফতারের পর ঈদের ঘোষনা নিশ্চিত হবার সাথে সাথে আমাদের নিজের এবং নানুর বাসায় ঈদের দিনের সাজগোজ আর রান্না-বান্নার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। খালারা ঈদের আগের সন্ধ্যায় আগে থেকে সংগ্রহ করা মেহদি পাতা শিলপাটায় বেটে নিয়ে নিজেদের হাতে নানা রকম ডিজাইন বা সুন্দর সুন্দর নকসায় ঐ বাটা মেহদি লাগাতেন। কয়েক ঘন্টা পর সেই মেহদি তুলে হাত ধুয়ে ফেললে হাতের উপর মেহদি রাংগানো লালচে-কমলা বা গাঢ় কমলা রংয়ের ডিজাইনটা পরিস্ফুট হয়ে উঠতো। ঈদের বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ঈদের দিনের খাবার-দাবারের প্রস্তুতি শুরু হত। রোজার মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই নানু বা আম্মা-খালারা ময়দার একটা বড় ডো করে সেখান থেকে অল্প করে ছিঁড়ে আংগুল দিয়ে বিশেষ কায়দায় ডলে ডলে চিকন ওভাল শেইপের অসংখ্য ছোট ছোট টুকরা তৈরী করে (স্থানীয়ভাবে এটাকে ‘চুটকি’ বলা হত) রোদে শুকাতে দিতেন-নারকেল সহযোগে ঈদের দিনের বিশেষ ‘চুটকি’ সেমাই বানানোর জন্য। নানুর বাসায় নানার আমলের একটা পিতলের যন্ত্র দেখেছিলাম যার একটা দাঁতালো অংশ চেয়ার বা টুলের সাথে অ্যাটাচ করে যন্ত্রটির মুখে বা গলায় ময়দার ডো ভরে সাথে লাগানো হাতল ঘুরালে চিকন লম্বা দড়ির মত অসংখ্য ময়দার টুকরা বেরিয়ে আসতো যেটা হতে একটু বড় আকারের ‘চুটকি’ বা অন্য কোন পিঠা বা সেমাই রান্না করা হত ঈদের সময়। ঈদের দিন সকালে নামাজের পর আম্মার বা নানুর হাতে বানানো এই মিষ্টি চুটকি সেমাইয়ের বাইরেও পায়েস, দুধে ডোবানো সাদা লাচ্ছা সেমাই কিংবা দোকান হতে কেনা লাল-হলুদ রংয়ের আরেকধরনের সেমাই খাওয়া হত। পরের দিকে ঈদের দিন সকাল বেলায় মাংস, চিংড়ি, ডিম ও সবজি দিয়ে এক ধরনের লম্বা নুডলস রান্না করা হত। আম্মার হাতে বানানো ঈদের সকালবেলায় তৈরী এই মজার নুডলস আমার ভীষন পছন্দের ছিল। দেশে গেলে আমি এখনো ঈদের দিন সকাল বেলা আম্মার হাতে তৈরী এই বিশেষ মজাদার নুডলস খেয়ে সকালের নাস্তা সম্পন্ন করি। সেমাই আমার বিশেষ পছন্দের না হলেও আম্মার হাতে তৈরী ঘন দুধের পায়েস আমার ভীষন ভালো লাগতো। দিনের প্রধান খাবার হিসেবে আগের রাতেই মুরগী, গরুর মাংশ বা পোলাওর রান্নার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখা হত। আমরা ঈদের নামাজ শেষে বাসায় আসতে আসতে এগুলোর কোন কোনটি আবার রান্না হয়ে যেত। ঈদের দিন বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশীর বাসায় ঘুরে ঘুরে ঈদের খাবার চেখে দেখার জন্য আমরা সকালের নাস্তা একটু কম করেই খেতাম।
# ঈদের দিনের আনন্দ:
(১) ঈদের নামাজ:
ঈদের দিন খুব ভোরে উঠেই আমরা তিন ভাই আব্বার সাথে বড় আব্বাদের বাসার সামনের বড় পুকুরটাতে গোসল করতে যেতাম। প্রায় একই সময়ে টুটুল মামারা সহ পাড়ার অন্য সব ছেলেপেলেরাও ঐ পুকুরে গোসল করতে আসতো। পুকুর ঘাটলায় নতুন সাবান, শ্যাম্পু, গামছা রেখে এক উৎসবমুখর পরিবেশে পুকুরে নেমে সবাই মিলে গোসল করতাম। মাথায় সানসিল্ক শ্যাম্পু আর গায়ে নতুন কসকো বা লাক্স সাবান মেখে ফেনা তুলে পরপর বেশ কয়েকটা ডুব দিয়ে আমরা ঈদের গোসল সেরে ফেলতাম। এরপর বাসায় এসে নতুন পায়জামা-পান্জাবী পরে সামান্য আতর মেখে সবাই মিলে এক সাথে বড় আব্বাদের পুকুরের উল্টাদিকে মাইজদি মিয়াজিপাড়া জামে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। নামাজ আর খুতবা শোনার সময়টাতে আমাদের শিশুমন পড়ে থাকতো কখন নামাজ শেষ হবে আর বাসায় গিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরতে পারবো। নামাজ শেষে মসজিদের ছোট বড় সবার সাথে ঈদের অত্যাবশ্যকীয় কোলাকুলি সম্পন্ন করে মসজিদের পাশের কবরস্থানে আমার নানার কবর জিয়ারত করতে যেতাম। এরপর বাসায় এসে পায়জামা-পান্জাবী ছেড়ে নতুন শার্ট/গেন্জি, হাফপ্যান্ট, আর জুতা পরে বাসায় তৈরী নুডলস, সেমাই, পায়েস বা জর্দা দিয়ে হালকা করে সকালের নাস্তা সেরে নিতাম।
(২) ঈদ–সালামী সংগ্রহ ও খাওয়াদাওয়া:
নতুন জামা-কাপড় পড়ার পরপরই শুরু হত আমাদের ছোটদের জন্য বহুল প্রতিক্ষীত ‘ঈদ-সালামী’ সংগ্রহ পর্ব। নতুন জামাকাপড় পরে প্রথমেই সালাম দিতাম আব্বা-আম্মাকে। কখনো আব্বা, আবার কখনো আম্মা ঈদের জন্য আগে থেকে তোলা নতুন এক টাকার বান্ডিল হতে আমাদের আর খালাতো ভাই-বোনদের ‘এক’ টাকা করে সালামী দিতেন। ৮০র দশকের শুরুতে এই এক টাকা সালামীই ‘যথেষ্ট’ বলে বিবেচিত হত আমাদের জন্য। দুটো ডিজাইনের এক টাকার নোটের প্রচলন ছিল তখন। একটা এক টাকার নোটের ডিজাইনে সাদা বেইজের উপর হালকা ধুসর রংয়ের লাইনার আর হাতে মুষ্টিবদ্ধ এক গোছা ধানের ছবি ছিল। এই এক নোটটির ব্যবহার ঐ সময়ে কিছুটা কমে এসেছিল। আরেকটি এক টাকার নোটের ডিজাইনে তৎকালীন অর্থসচিব সাইদুজ্জামানের সিগনেচার সম্বলিত হালকা গোলাপী-হলুদ-সাদা রংয়ের বেইজের উপর পার্পল কালারের লাইনার আর মাঝে তিনটে হরিনের একটি ছবি ছিল। এই এক টাকার নোটটি তখন নতুন ছাপা হয়েছিল আর দেখতেও অনেক সুন্দর ছিল। আব্বা-আম্মার কাছ থেকে সালামী সংগ্রহ শেষে পর্যায়ক্রমে খালা বা খালুদের কাছ হতে এক বা দুই টাকা করে ঈদ সালামী পেতাম। তবে তখনকার দিনে সবচেয়ে বড় সালামী পেতাম নানুর কাছ থেকে- কখনো এক টাকার চার-পাঁচটা নতুন নোট আবার কখনো একটা কড়কড়ে পাঁচ টাকার নোট। নানুর বাড়ির সালামী পর্ব শেষ করে আমরা সবাই হাজির হতাম বড় আব্বাদের বাসায়-নূর মহলে। ৮১-৮২ র দিকে বড় আব্বারা স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে গেলে পিন্টু নানার ( নানুর সেজ ভাই) পরিবার বড় আব্বা-আম্মার ( আমার নানুর বাবা-মা) স্মৃতি বিজড়িত ‘নূরমহলে’ স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। পুরানো রেওয়াজ অনুযায়ী ঈদের দিনের দুপুরের খাওয়াটা আমরা ঐ নূরমহলে পিন্টু নানার বাসায়ই সারতাম এবং আমার নানু স্থায়ীভাবে মাইজদি ছাড়ার আগে, মোটামুটি ৮৭ সাল পর্যন্ত, আমাদের রোজার ঈদের দুপুর বেলার খাবার পিন্টু নানার বাসাতেই নির্ধারিত ছিল। নূরমহলে পিন্টু নানা, মনি নানু, টুটুল মামা, কান্তা আন্টির সাথে আমাদের শৈশবের কত স্মৃতি যে নিবিঢ়ভাবে জড়িয়ে আছে বলে শেষ করা যাবেনা। ঈদের দিন পিন্টু নানার বাসায় বড় নানার পরিবার (নানুর সবচেয়ে বড় ভাই), মুক্তা নানুদের ( পিন্টু নানার স্ত্রী আমাদের মনি নানুর বড় বোন) পরিবারের দীপু মামা, অপু মামা ও রনি, ছোট্ট ভাইয়ার সম্বন্ধী কাম বন্ধু জসিম নানা ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাত হত। যাই হোক, ঈদের দিন নূরমহলে এসে বড় আব্বা বা পিন্টু নানা এবং বড় নানার কাছ থেকে আরো চার-পাঁচ টাকা সালামী পেতাম। স্কুলে ভর্তি হবার আগের রোজার ঈদগুলোতে সবমিলে ১০-১২ টাকার মত সালামী উঠতো আর তাতেই মনটা বড় উৎফুল্ল হয়ে উঠতো! স্কুলে ভর্তি হবার পর অবশ্য নানুর কাছ হতে মোটামুটি ১০-২০ টাকা, আম্মার কাছ হতে ১০ টাকা আর একেকজন খালার কাছ হতে ৫ টাকার মত পেয়ে মোট ঈদ সালামীর পরিমান বেড়ে ৬০-৭০ টাকার মত হয়ে যেত। এই অল্প টাকাই তখনকার আমলে কত বিশাল মনে হত! সালামীর এই নতুন টাকাগুলো খুব যত্নের সাথে প্যান্টের পকেটে রেখে দিতাম- খেয়াল রাখতাম নতুন নোটে কোনরকম ভাঁজ বা দাগ যাতে না পড়ে। কিছুক্ষন পরপর সালামীর নতুন টাকাগুলো বের করে গন্ধ শুঁকতাম-গুনে দেখতাম টাকাগুলো ঠিকঠাকমত আছে কিনা। ঈদ সালামী সংগ্রহের সময় আবার খেয়াল থাকতো মিজান ভাইয়া বা অন্য কোন কাজিন আমার চেয়ে কোনভাবে বেশী সালামী পেয়ে গেল কিনা! কে কার চেয়ে কত বেশী সালামী পেল-এই নিয়ে একটা সূক্ষ প্রতিযোগিতা ছিল ভাইয়ার সাথে। কী ছেলেমানুষী উত্তেজনা যে কাজ করতো তখন!
(৩) ঈদের দিনের কেনাকাটা ও খাওয়াদাওয়া:
ঈদের দিনে সালামীর টাকার একটা বড় অংশ ব্যয় হত দুপুরের খাবারের পরে পাড়ার হোসেন মামা বা সৈয়দ আলম মামার দোকান হতে পাঁচ টাকায় একটা কোক, পেপসি বা সেভেন-আপ কিনে খেতে। অন্য সময়ে দোকান হতে কোক-পেপসি কিনে খাওয়া ছিল একধরনের বিলাসিতা যার সুযোগ আমাদের খুব একটা হতোনা। কিন্তু ঈদের দিন সালামীর টাকা হাতে পেয়ে নিজেকে বেশ ধনবান মনে হত। তাই টাকা হাতে পেলে আমাদের ছোটদের অন্যতম আকর্ষন থাকতো কখন একটা পুরো কোক, পেপসি, সেভেন-আপ, স্প্রাইট, ফান্টা বা মিরিন্ডা কিনে খেতে পারবো। হোসেন মামা বা সৈয়দ আলম মামার দোকানে সাধারনত বড় কোক বা পেপসির বোতলের ছিপি না খুলেই ছিপিতে একটা ছিদ্র করে প্লাস্টিকের স্ট্র গুজে আমাদের হাতে কাঁচের বোতলটি ধরিয়ে দেয়া হত। এই ড্রিংকগুলো তখন বেশ ঝাঁজালো লাগতো। তার উপর স্ট্র দিয়ে ড্রিংকটি টানার ফলে খুব অল্পেই আমাদের ছোট পাকস্থলি বাতাসে ভরে যেত। অর্ধেক বোতল কোন রকমে শেষ করে অনেকসময়ই রণে ভংগ দিতাম! পুরো বোতল শেষ করতে না পারার একটা আফসোস থেকে যেতো বটে! সালামীর বাকী টাকা দিয়ে চার আনা দামের বিভিন্ন ফ্লেভারের নাবিস্কো লজেন্স, চার আনা বা আট আনা দামের প্লাষ্টিকে মোড়া কালো বরই বা তেতুলের আঁচার কিনে খেতাম। এক বা দুই টাকা আবার ব্যয় হত মাথায় বেলুন লাগানো একধরনের ছোট চিকন বাঁশের বাশি কিনতে। বাঁশের এই ছোট বাঁশির নিচের দিকে মুখ দিয়ে ফুঁ দিয়ে মাথায় বসানো বেলুনটা ফুলিয়ে নিয়ে বাঁশির তলা হতে মুখ সরিয়ে নিলে পোঁ পোঁ করে বাঁশির আওয়াজ শোনা যেত। দম বেশী থাকলে বেলুনটা বেশী ফুলতো আর লম্বা সময় জুড়ে বাঁশির পোঁ পোঁ আওয়াজ শোনা যেত। বারবার এভাবে বেলুন ফুলিয়ে বাঁশির আওয়াজ শোনার মাঝেই ছিল আমাদের সময়ের ছেলেমেয়েদের অন্যতম ঈদ-বিনোদন। সালামীর টাকা একটু বেশী পেলে কখনো কখনো পাঁচ টাকা দামের দেশীয় মিমি চকলেট কিংবা বিপি /এমপি বাবল গাম কিনে ফেলতাম। আজকের দিনের মত কিটক্যাট বা অন্যান্য বিদেশী চকলেট বার তখন পাওয়া যেতনা। তাই দাম একটু বেশী হলেও কমলা ফ্লেভারের গাঢ় খয়েরী রংয়ের সুস্বাদু এই দেশীয় মিমি চকলেট বারটি আমাদের সময়ে শিশু-কিশোরদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। দশ-বারটা স্কয়ার আকৃতির ছোটছোট বারে বিভক্ত এই গাঢ় খয়েরী রংয়ের চকলেট বারটি একটা রূপালী রাংতা কাগজে মোড়ানো থাকতো। তার উপর থাকতো দুটি কমলার কোয়ার ছবি সম্বলিত গাঢ় খয়েরী রংয়ের আরেকটি আকর্ষনীয় কাগজের মোড়ক। আমরা একটা বা দুটো ছোট বার ভেংগে নিয়ে বাকী চকলেট বারটা রাংতা কাগজে মুড়ে রাখতাম-পরে আবার খাবার জন্য। এই শক্ত ডার্ক চকলেটের ছোট একটি বার মুখে নিয়ে একটা কামড় দিতেই নিমিষে তা গলে গিয়ে মুখের ভেতরটা কমলার ফ্লেবার সম্বলিত ডার্ক চকলেটের এক স্বর্গীয় স্বাদে ভরিয়ে তুলতো! জীবনে দেশী-বিদেশী নানা স্বাদের বা আরো ভালো কোয়ালিটির চকলেট বারও খেয়ে দেখেছি কিন্তু ছোটবেলার ঐ দেশী একধরনের এই মিমি চকলেটের স্বাদ এখনো যেন মুখে লেগে আছে! আমি জানিনা এই মিমি চকলেট বারটি এখনো পাওয়া যায় কিনা!
মফস্বল শহরে তখন রিগলি বা কোরিয়ান হাইতাইর মত উন্নতমানের চুয়িংগাম পাওয়া যেতনা। কিন্তু বিপি বা এমপি বাবল গাম নামে পাঁচ টাকা দামের দেশীয় একটা ছোট চ্যাপ্টা বাবলগামের প্যাকেট পাওয়া যেত। একটা বিদেশী মেয়ের মুখে বাবলগামের ফুলানো ছবি সম্বলিত নীল রংয়ের কাগজের একটি প্যাকেটে রূপালী রাংতা কাগজে মোড়ানো চ্যাপ্টা আকৃতির পাঁচটা বাবল গাম থাকতো। এই বাবলগামগুলো সামান্য কিছুক্ষন চিবুলেই সমস্ত চিনি শেষ হয়ে বিস্বাদ হয়ে পড়তো। আমরা তখন ঐ বিস্বাদ গামটা আরো কিছুক্ষন মুখে রেখে কিছুক্ষন পরপর মুখের ভেতর হতে বিশেষ কায়দায় গামটি ফুলিয়ে ঠোটের সামনে বেলুনের মত বড় করে তুলে ধরতাম। গামের বাবল বেশী বড় হয়ে গেলে ঠোঁট দিয়ে বিশেষ কায়দায় ঠাস করে সেটাকে ফুটিয়ে দিতাম। বারবার এভাবে গাম ফুলানো আর ঠাস করে ফুটিয়ে ফেলার মাঝে এক অদ্ভুত বিনোদন টের পেতাম। ঐসময় পাড়ার দোকানে এক টাকায় নীল রংয়ের একটা প্যাকেটে এমএনএম এর দেশীয় সংস্করন হিসেবে সাদা রংয়ের ছোট ছোট শক্ত দুধ-চিনির বল বিক্রি হত – আমরা এটাকে ‘টিকটিকির ডিম’ বলতাম। এক একটা প্যাকেটে আট-দশটা করে ‘টিকটিকির ডিম’ থাকতো। আমরাও এরকম একটা প্যাকেট কিনে কিছুক্ষন পরপর একটা করে‘ টিকটিকির ডিম’ মুখে নিয়ে হালকা করে চুষে উপরের শক্ত লেয়ারটাকে একটু নরম করে নিতাম। তারপর দাঁত দিয়ে হালকা কামড় দিলেই মুখের ভিতর ‘ডিম’টি ভেংগে গিয়ে চিনিতে মুখটা ভরিয়ে দিতো আর আমরাও অনেক মজা পেতাম। ৮৬/৮৭ সালের দিকে মাইজদি টাউনের দিকে একটা ‘কোন’ আইসক্রিমের দোকান চালু হয়। ঈদের দিন প্রচন্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠলে দুপুরের খাবার শেষে আমরা কাজিন আর ছোট খালা-মামারা দলবেঁধে নানুর বাসা হতে দুই বা তিন টাকায় রিকশা ভাড়া করে মাইজদি টাউনে এসে এই আইসক্রিম খেয়ে একটু শীতল হতাম।
(৪) ঈদের দিনের ঘুরাঘুরি:
ঈদের দিন দুপুরের খাবারের পরে কখনো কখনো আম্মা-খালাদের সাথে মাইজদি বাজারের দিকে মাষ্টারপাড়ায় চলে যেতাম বড় নানাদের (নানুর বড় ভাই) বাসায়। সেখানে নিজাম মামা, হারুন মামা, রোজী খালাম্মা, রুমা খালা আর রেখা আন্টি থাকলে খালুজান, কাজিন সুমন, কচি ও লুনার সাথে দেখা হত। সেখানেও হালকা করে ঈদের সেমাই বা নাস্তা খাওয়া হত। মাঝে মাঝে ঐবাসায় বড় নানুর একমাত্র ভাই ডা: আব্দুল হাই নানার সাথেও দেখা হত। কখনো কখনো ঈদের দিন মাইজদি বাজারের দিকে যাবার পথে সোলেমান উকিলের বাসায় রিপন ভাই, আল্পনা আপা বা রীতা আপাদের সাথে দেখা করতে যেতাম। উনাদের বাসা হতে একটু পূর্বদিকে এগুলে পথে পড়তো আম্মার নোয়াখালী কলেজের বন্ধু-বান্ধবী যুগল নজরুল মামা, ডালিয়া আন্টি, নজরুল মামার ছোট ভাই আমির মামা ও শিরিন খালাদের ( মামা-খালাদের পারিবারিক বন্ধু) বাসা- আম্মার সাথে সেখানেও কখনো কখনো ঢুঁ মারা হত। এই পথ দিয়ে আরো কিছুদূর গেলে মুন্নী খালার বান্ধবী প্রনতি খালাদের বাড়ি পাশ দিয়ে শর্টকাট একটা পথে মাষ্টারপাড়ায় বড় নানাদের বাসায় যাওয়া যেত। এই পথে হিন্দুদের ছোট দুটো মঠ চোখে পড়ত। নিরিবিলি ছিল বলে দিনের বেলায় ঐপথ দিয়ে যেতে গা বেশ ছমছম করতো। বর্ষার সময় এই নিচু পথে পানি উঠে যাবার ফলে বড় নানার বাসায় যাবার এই শর্টকাট পথটা হেঁটে যাবার অনুপযুক্ত হয়ে পড়তো। যাই হোক বড় নানার বাসায় গেলে উনাদের পাশেই বড় নানুর বড় বোনের বাসায়ও আমরা এক পাক ঘুরে আসতাম। ঐবাসার সেলিম মামা, বাচ্চু মামা, হাসি খালা, লাকী খালা, রুবী খালা, শাখি খালা, শিলা খালা ও লাসনা খালাদের সাথে কত নিয়মিতই না দেখা হত মাইজদির দিনগুলোতে! আজ বহু বছর হল উনাদের সাথে দেখা হয় না! এই মাষ্টার পাড়াতেই ছিল হান্নান মামার এক সময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু স্বপন মামাদের বাসা। মাইজদি বাজারের দিক দিয়ে বড় নানুর বাসায় যেতে উনাদের বাসা পার হয়ে যেতে হত। ঈদের দিনে অনেক সময় মুন্নী খালাম্মা মাইজদি বাজারের দিকে উনার ঘনিষ্ট বান্ধবী ফুটন খালাদের বাসায় আমাকে আর মিজান ভাইয়াকে নিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে কাবা খালাম্মাও যেতেন আমাদের-উনার বান্ধবী জেবু খালাম্মার (ফুটন খালাম্মার বড় বোন) সাথে দেখা করতে। কোন কোন ঈদে আমার সবচেয়ে ছোট খালা আমেনা খালাম্মার সাথে উনার স্কুলবান্ধবী লিপি খালা, রিনা খালা কিংবা চায়না খালাদের বাসায়ও যাওয়া হত। ঈদের দিন একটু বিকেলের দিকে পাড়ায় ফিরে এলে আম্মা-খালাদের সাথে প্রতিবেশী বড় দর্জি-ছোট দর্জি-মেরি খালা-ফারুক মামা-শিল্পিদের বাসায়, কাওসারি খালাম্মা, রানি খালাম্মা, আইজুল হক নানা, শাহাবু্দ্দিন-ফারুক মামা, আজাদ মামা-স্বপন মামা-হোসনা খালা-বিলকিস খালা-পান্নাদের বাসায়, নার্গিস নানুদের বাসায় সোহেল ভাই, শামীম ভাই, সোমা আপা, শাকিল ভাইর সাথে অথবা বকুল নানুর বাসার ভাড়াটিয়া ক্যাশিয়ার সাহেবদের বাসায় নাসরিন, আইরিন আপা, হান্নান ভাই, দোলন ভাইদের সাথে ঈদের সাক্ষাত করতে যেতাম। কোন কোন সময় ঈদের দিন বা ঈদের পরের দিন কোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে জলিল মোক্তার নানার (আম্মা-খালাদের বাচ্চুর মা খালাম্মাদের বাড়ি) বাড়িতে-বাচ্চু মামা, লাতু মামা, কান্চন মামা, আজাদ মামা, বাহার মামা, আলেয়া খালাম্মাদের বাসায় ঈদের দাওয়াত খেতে যেতাম। এই বাড়ির লাতু মামার সাথে ( লক্ষীপুরের স্বনামধন্য মাসুদ উকিল) আম্মার খালাতো বোন ও বান্ধবীতুল্য শেফু খালাম্মার সাথে বিয়ে হবার সুবাদে পরিবারটি আমার নানুর পরিবারের অনেক ঘনিষ্ট ছিল। আমরা প্রায়ই নাপতার পুলের ভিতর দিয়ে কেদার ডাক্তার নানা, হুমায়ুন কবির উকিল নানার বাড়ি পার হয়ে একটা নির্জন পায়ে হাটা পথে শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামের পিছন দিক দিয়ে একটা শর্টকাট পথ ধরে জলিল মোক্তার নানার বাসায় যেতাম। ঐখানে বাচ্চু মামার স্ত্রী মুর্শিদা খালাম্মা- উনাদের সন্তান হেলাল ভাই, রানি আপা আর শেফু খালাম্মা থাকলে কাজিন নুপুর আপা ও ঝুমুরদের সাথেও দেখা হত। ঐ বাসায় আম্মা-খালারা সাধারন লম্বা সময়ের জন্য যেতেন। গল্পগুজবের ফাঁকে ঈদের খাওয়াদাওয়াও পরিবেশন করা হত।
# ঈদের রাত:
ঈদের সারাদিন নানুর বাড়ির বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন, আম্মা-খালাদের বন্ধু-বান্ধবী, পাড়ার প্রতিবেশীদের বাসায় ঘুরে প্রায় সন্ধ্যার দিকে ক্লান্ত হয়ে নানুর বাসায় ফিরে আসতাম। জামা-কাপড় ছেড়ে নানুর বাড়ির টিউবওয়েলের পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে কিছুক্ষন রেষ্ট নেবার পরে রাতের খাবার দেয়া হতো সবাইকে। মোটামুটি রাত নয়টার মধ্যে রাতের খাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই মিলে আমরা আবার হাজির হতাম পিন্টু নানার বাসায়- বিটিভিতে ঈদের দিনের বহুল প্রতিক্ষিত ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’ দেখতে। বলা বাহুল্য, আমাদের বা নানুর বাসায়, এমনকী গোটা পাড়ার আর কোন বাসাতেই তখনো পর্যন্ত টেলিভিশন আসেনি। তাই টিভির কোন ধারাবাহিক বা সাপ্তাহিক নাটক, জনপ্রিয় কোন ইংলিশ টিভি সিরিজ, বাংলা সিনেমা কিংবা বিশেষ কোন দিবসের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখতে মাইজদির দিনগুলোতে আমরা পিন্টু নানার বাসাতেই ভিড় করতাম। বলা বাহুল্য, আজকের মত এত এত চ্যানেল তখন ছিলনা। একটাই মাত্র চ্যানেল ছিল-আর সেটা ছিল বিটিভি। আর বিটিভিতে ঈদের সেরা আকর্ষন ছিল আবদুল্লাহ আবু সাইদ, আনিসুল হক বা জুয়েল আইচের উপস্থাপনায় ঈদের দিনের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’ যা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করতাম। মনে মনে দোয়া করতাম আনন্দমেলা প্রচারের সময় কারেন্ট যেন থাকে বা কোন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি যাতে না ঘটে। রাতের বেলা আনন্দমেলা দেখে নানুর গোটা পরিবার যখন বাসায় ফিরতো তখন আমাদের ছোটদের অনেকেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়তো। তবে বড়রা তখনো বেশ প্রানবন্ত থাকতো। খাটের বিছানা গোছগাছ করে বা সিমেন্টের ফ্লোরে বিছানা পেতে শুরু হত রাতে শোয়ার বন্দোবস্ত। নানু, আব্বা-আম্মা আর আমরা তিন ভাইসহ আমাদের পরিবার, কুমু আন্টি-কাদের মামা-তানিয়া, কাবা খালাম্মা-হাফিজ মামা-লিসি-জেসি, হান্নান মামা, মুন্নী আন্টি, আমেনা খালাম্মা, আলো ভাইয়া-সাহানা আপা আর কাজের মানুষ সহ মোট ১৮-২০ জন মানুষের শোয়ার আয়োজন হত নানুর বাসার এই ৩/৪ টি খাটে আর গনবিছানা করে ফ্লোরে। ঘুমানোর আগের সময়টুকুতে মুন্নী খালাম্মা বা হান্নান মামার মুখে দিনের নানা ঘটনার রসাত্মক বর্ননা, চুটকি শোনা ছিল এক নির্মল বিনোদন। লাইট বন্ধ করার আগের এই স্বল্প পারিবারিক আড্ডা যেন সম্পূর্ন করে তুলতো ঈদের সমস্ত আনন্দকে। এক পর্যায়ে সারাদিনের ক্লান্তিতে এক প্রশান্তির ঘুমে ঢলে পড়তো সবাই। এভাবেই শেষ হত মাইজদিতে নানুর বাড়িতে আমাদের রোজার ঈদের দিনটা।
# ঈদ পরবর্তী দিনগুলো:
(১)
ঈদের পরবর্তী দুই-তিনদিন নানুর বাসায় চলতো আত্মীয়-স্বজন আর মামা-খালাদের বন্ধু-বান্ধবদের ব্যাপক আড্ডা, গল্প-গুজব, তাস খেলা আর সেই সাথে চলতো হরেক রকম খাওয়া-দাওয়া আর নাস্তার আয়োজন। এই পুনর্মিলনীতে কখনো হাজির হতেন নূরমহল হতে পিন্টু নানা, টুটুল মামা, কান্তা আন্টি, মন্টু ভাইয়া, শবনম নানু, আবার কখনো বড় নানার বাসা হতে বড় নানা, নিজাম মামা, হারুন মামা, রেখা আন্টি, রোজি আন্টি, রুমা খালাম্মারা। হান্নান মামার ঘনিষ্ট বন্ধু মজনু মামা কিংবা স্বপন মামা, খালাদের বন্ধু/সুহৃদ-মোহম্মদ আলী মামা, আমির মামা, শাহেদ মামা, ফুটন খালা, শিরিন খালা, লিপি খালা, শিউলি খালা, জোসনা খালা, জকশিনের শওকত মামা, হাফিজ মামার বন্ধু হুমায়ুন মামারও প্রায় নিয়মিতই দেখা মিলতো নানুর বাড়িতে রোজার ঈদের এই পারিবারিক মিলনমেলায়। অনেক সময় রোজার মধ্যে কিংবা ঈদের দু-একদিন পর আমার দাদার বাড়ি হতে দাদা অথবা জ্যাঠা কিংবা আম্মাদের দাদার বাড়ি হতে কালু নানা, সিদ্দিক নানা (আম্মাদের চাচা), দুলাল মামাবা কাশেম মামা মৌসুমী ফল, আমসত্ব, খৈ-মুরি-চিড়া, নারকেল-সুপারী বা ক্ষেতের ধান সাথে নিয়ে মাইজদিতে নানুর বাড়িতে আসতেন আমাদের সাথে দেখা করতে। ঈদের পর আলো ভাইয়ার দাদার বাড়ি হতে প্রায়ই উনার ছোট চাচা-রুহুল আমিন মামা অথবা কাজিন সমীর ভাই, সোহাগ ভাই, কখনো কখনো উনার সৎ ভাই দিদারকেও মাইজদিতে আসতে দেখতাম।
ঈদ পরবর্তী দিন বা রাতের কিংবা বিকেলের কোন নাস্তার দাওয়াতে আমাদেরও যাওয়া হতো বড় নানা, জলিল মোক্তার নানা, লয়ার্স কলোনীতে শবনম নানু, হান্নান মামার বন্ধু মজনু মামাদের বাসায় কিংবা প্রতিবেশী কাওসারী খালাম্মা, নার্গিস নানু, রানি খালাম্মা, কবির উকিল আংকেলদের বাসায়। কবির উকিল আংকেলের বাসায় উনার তিন ছেলে সুমন ভাই, ইমন ভাই (আমার মিজান ভাইয়ার স্কুলের ও পাড়ার ঘনিষ্ট বন্ধু) ও সুজনের সাথে দেখা হত। কখনো কখনো ঈদের পর মাইজদি বাজারের কাছে মুক্তা নানুদের বাসায় কিংবা ঐসময়ে অল্প সময়ের জন্য মাইজদিতে বসবাসকারী আলো ভাইয়া-সাহানা আপার সেজ চাচার বাসায়ও (বিপ্লব ভাই, বিজয় ভাই, বিপুলদের বাসায়) দাওয়াত খেতে যাওয়া হত। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও ঈদের দাওয়াত কিংবা সৌজন্য সাক্ষাতে কখনো কখনো চলে যেতাম ভুলু স্টেডিয়ামের পাশে মিজান ভাইয়ার পিটিআই স্কুলের বন্ধু সাধন ভাই, মিঠু ভাই কিংবা আমার বন্ধু মুকুলদের বাসায়, আবার কখনো পিটিআই স্কুলের পাশে ভাইয়ার বন্ধু সোহাগ ভাই আর আমাদের পাড়ার কাছেই আমার স্কুল বন্ধু ফয়সালদ (ডা: জালাল ও ডা: নার্গিসের ছেলে) কিংবা মিজান ভাইয়ার বন্ধু রাশেদ ভাইর বাসায়। চট্টগ্রাম হতে মাইজদিতে এলে কখনো কখনো নার্গিস নানুর ছোট বোন-আমার আম্মার ঘনিষ্ট বান্ধবী রুনু খালা উনার ছেলে হামীম কে নিয়ে বেড়াতে আসতেন আমাদের বাসায়। আবার ঢাকা হতে মাইজদিতে এলে আম্মাদের মোস্তফা মামা ও শান্তি আপার সাথেও দেখা হত ঈদের সময়! কী এক স্নিগ্ধ, সুন্দর ও হৃদ্যতাপূর্ন পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম আমরা সে সময়- ঈদের সময় তার পূর্নতা টের পেতাম!
(২)
নানুর বাসায় মামা-খালা-খালুদের ঈদ-পুনর্মিলনীর অন্যতম অনুসংগ ছিল তাস খেলা। মুলত হান্নান মামার উদ্যেগেই আব্বা, কাদের মামা, হাফিজ মামা দুপুরে খাবার আগে বা পরে আবার কখনো সন্ধ্যার পর স্পেইড ট্রাম (কল ব্রিজ) কিংবা ব্রে খেলতে বসতেন। কখনো কখনো কুমু আন্টি, মুন্নী আন্টি আবার কখনো ছোট্ট ভাইয়াকেও ( মন্টু ভাইয়া, নানুর সবচেয়ে ছোট ভাই) উনাদের সাথে স্পেইড ট্রাম খেলতে দেখতাম। সত্যি বলতে কী উনাদের খেলা দেখেই কল ব্রিজ বা ব্রে খেলাটা সেই ৬/৭ বছর বয়সেই শিখে ফেলি আমি।একটা সাদা কাগজে চারজনের নাম লিখে মামা একেকজনের ‘কল’ লিখতেন আর কে কার্ড সাফল করবে, কে কাটবে, কে ফার্ষ্ট লিড দিবে সেই তদারকি করতেন। একটা রাউন্ড শেষে কে কয়টা কল পেল, কে শর্ট হলো আর কে বোনাস পেল সেই হিসাবটাও ঐ কাগজে টুকে রাখতেন। কখনো ৩০০ আবার কখনো ৫০০ তে একেকটা গেম শেষ হত। কিছুক্ষন পরপর সবার টোটাল পয়েন্ট চেক করে দেখা হত কে কোন পজিশনে আছে। আপাতত যে এগিয়ে থাকতো তাকে মাইনাস খাওয়ানোর জন্য মামার দিক থেকে একটা জোর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যেত। মামা তখন বাকী সব পার্টনারকে সাথে নিয়ে যেভাবে কৌশলে বা ইংগিতে লিডিং প্লেয়ারকে ডাউন করানোর জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা নিতেন তা সত্যিই ছিল বড় চমকপ্রদ! আব্বাকে দেখতাম প্রায় গেমেরই শুরুর দিকে এগিয়ে থাকতেন- কিছুটা সাবধানী ‘কল’ দেবার কারনে। তাই এক পর্যায়ে উনাকে মাইনাস খাওয়ানোর জন্য একটা সন্মিলিত প্রচেষ্টা দেখতাম মামা-খালুদের দিক থেকে। কোন কারনে উনাদের সন্মিলিত প্রচেষ্টা ভেস্তে গেলে খেলার মধ্যেই পর্যালোচনা হতো-কার কোন লিডটা ভুল হইসে, কী করলে কী হইতো ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সবার সন্মিলিত প্রচেষ্টায় বা দুর্ভাগ্যক্রমে মাইনাস খাওয়াটা আর এড়ানো সম্ভব না হলে আব্বার মেজাজ যে কি পরিমান খারাপ হয়ে যেত তা না দেখলে বোঝা যেতনা। কোন একবার তো বারবার মাইনাস খেয়ে প্রচন্ড রকম চেতে গিয়ে নিজেরে সামলাতে না পেরে আব্বা উনার হাতের কাছের রেডিওটা কনক্রিটের ফ্লোরে ছুঁড়ে ফেলে নিজের ঝাল মিটিয়েছিলেন। রাগ নেমে গেলে সেই ঝুরঝুর করে ভেংগে পড়া রেডিওটাকেই আবার দুইদিন পরে মাইজদি বাজার থেকে জোড়া লাগিয়ে ঠিক করে বাসায় এনেছিলেন! মাঝেমাঝে এরকম ছোটখাটো খুনসুটি লাগতো কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশী আনন্দময় ছিল সবাই মিলে একসাথে বসে খেলাটা দেখার বা খেলার মাঝের নানারকম রসিকতা উপভোগ করার মুহুর্তগুলো। আমি নিজেও অসম্ভব মজা পেতাম উনাদের পাশে বসে খেলা দেখতে আর খেলার মাঝের নানারকম কমেন্টগুলো শুনতে! তাই কোন কারনে তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হয়ে গেলে মনে মনে একটু কষ্ট লাগতো। আব্বা-খালুদের তাস খেলার মাঝে কখনো নানু আবার কখনো আম্মা বা খালারা বড় বোলে করে মুরি-চানাচুর বা অন্য কোন নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসতেন-সাথে থাকতো গরম গরম চা। আবার কখনো আম, লিচু বা অন্য কোন মৌসুমী ফল কেটে পরিবেশন করা হত সবার খাবার জন্য।
(৩)
বড়দের পাশাপাশি আমরা ছোটরাও একপাশে লুডু, চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ, ক্যারামবোর্ড কিংবা বাগাডুলি নিয়ে খেলতে বসতাম। অনেকসময় আবার নানুর বাড়ির উঠানেই ফুটবল, ছোঁয়াছুঁয়ি ইত্যাদি খেলা খেলতাম আমরা ছোটরা সবাই। বিকেল বেলায় অনেক সময় টুটুল মামার সাথে শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামেও চলে যেতাম ফুটবল খেলতে। মাইজদিতে নানুর বাসাটি বিক্রি করার কয়েক বছর আগে -সম্ভবত ৮৬/৮৭ সালের দিকে হান্নান মামা, মজনু মামা ও উনাদের আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে নানুর বাসার অনতিদূরে একটি ক্লাবঘরে কিছুদিনের জন্য দর্শনীর বিনিময়ে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখাবার একটা ব্যবসায়িক উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কোন এক ঈদে আমরা কয়েকজন ঐ ক্লাবঘরে গিয়ে হিন্দি ছবি ‘মহাগুরু’ ও ‘ভগবান দাদা’ দেখেছিলাম বলে এখনো মনে পড়ে।
# বিদায় মাইজদি:
ঈদের ছুটির পুরোটা সময়ই মামা-খালার সরব উপস্থিতি, আমাদের ছোটছোট কাজিনদের খেলাধুলা-কোলাহল, ব্যাপক খাওয়া-দাওয়া, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের পদচারনা ও আড্ডায় সমগ্র নানুর বাড়িই যেন উৎসবমুখর হয়ে থাকতো। কিন্তু আনন্দের সময় বোধ হয় খুব তাড়াতাড়িই পার হয়! মাইজদির অতি আপন এই পারিবারিক ও সামাজিক পরিসরে একটু রিল্যাক্সড ও উৎসবমুখর ঈদ উদযাপন শেষে একসময় তাগিদ আসতো সবার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবার। ঈদের তিন-চারদিন পর হতেই আব্বা, হান্নান মামা, কুমু খালা ও মুন্নী আন্টিদের প্রস্তুতি শুরু হত ঢাকা ফিরে যাবার। আমরা যারা তখনো মাইজদিতে থাকতাম মনটা সবার ভীষন খারাপ হয়ে যেত খালা-মামাদের আসন্ন বিদায়ের এই প্রস্তুতিতে এবং একটা সময় বিষন্ন মনে ঢাকাগামী বাসে বা ট্রেনে আব্বা, মামা, খালাদের বিদায়ও দিতে হত! খুব ছোটবেলার আরেকটি বিষাদে ভরা বিদায়ের স্মৃতি উল্লেখ না করলে মাইজদি জীবনের স্মৃতি একটু অসম্পূর্ন থেকে যাবে! একেবারে ছোটবেলায় আমার অকালপ্রয়াত বড় খালার ছেলে আলো ভাইয়া ও সাহানা আপা উনাদের দাদার বাড়ি হতে মাইজদিতে এসে ঈদ শেষে আবার যখন বাংলাবাজারে উনাদের দাদার বাড়ি ফিরে যেতেন তখন এক হৃদয়-বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হত।সাহানা আপাকে আপাতদৃষ্টিতে একটু স্ট্রং দেখালেও আলো ভাইয়া কিছুতেই নানুর বাড়ি হতে ফিরে যেতে চাইতেন না। উনাদেরকে নিতে আসলে বড় খালুকে অনেক লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হত-বড় আব্বাদের বাসার সামনের রাস্তায় অপেক্ষমান গাড়িতে। কিন্তু বিদায়ের সময় নানুর বাড়ি ছেড়ে যাবার কষ্টে আলো ভাইয়া এমনভাবে কান্না শুরু করতেন যে উনার কষ্টে আমাদের পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী সবার চোখেই পানি চলে আসতো-অল্প বয়সে মা’হারানো আমার এই খালাতো ভাইটার জন্য। শুধু ঈদের সময়ই না, ছোটবেলায় যে কোন সময়ই নানুর বাড়ি হতে দাদার বাড়িতে ফেরত যাবার সময় এই করুন দৃশ্যের অবতারনা হত-আর সেই সাথে নানুর বাড়ির সবারই মন অসম্ভব খারাপ হয়ে যেত যার রেশ পরবর্তী বেশ কয়েকদিন থেকে যেত আমরা যারা মাইজদিতে থাকতাম তাদের মনে!
৮৪ সালের শেষে আমাদের গোটা পরিবার ঢাকায় আর কাবা খালাম্মার পরিবার চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে চলে আসলে ঈদের ছুটি শেষে আমাদের আর কাবা খালার পরিবারেরও ঢাকা বা চট্টগ্রামে আপন ডেরায় ফেরার তোড়জোড় লেগে যেত। ঈদের ছুটির শেষে একসময় মাইজদির বাসা হতে নানু, আমেনা খালাম্মা, আলো ভাইয়া বা সাহানা আপার সাথে বিদায় নিয়ে আমরাও ঢাকাগামী ট্রেন ‘উপকুল’এক্সপ্রেস অথবা ঢাকা-মাইজদির কোন বাসে চেপে ঈদের মধুর স্মৃতি আর মাইজদিতে স্বজন ছেড়ে আসার বিষন্নতায় মাখানো এক মিশ্র অনুভুতি নিয়ে ফিরে আসতাম ঢাকায়।
আজকের দিনের মত নাগরিক যান্ত্রিকতা তখনো আমাদের স্পর্শ করেনি। ডিজিটাল সময়ের ব্যস্ততাও তখন ছিলনা। আম্মা-খালা-মামাদের পরিবারগুলো মাত্রই স্ব স্ব স্থানে বা কর্মক্ষেত্রে বিকশিত হচ্ছিল- বাড়তি চাহিদাও তখনো তৈরী হয়নি।এখনকার মত আর্থিক স্বচ্ছলতাও হয়তো ছিলনা সেসময়। কিন্তু আপন পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা প্রতিবেশীর প্রতি আন্তরিকতা আর ভালোবাসার কোন ঘাটতি ছিলনা-মাইজদিতে নানুর বাড়িতে আমাদের শৈশবের ঐ দিনগুলোতে। কখনো কী পারবো আবার ঐ সময়ে ফিরে যেতে!
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা!
লেখক : ডঃ মোহম্মদ মাহবুব চৌধুরী
মন্ট্রিয়াল, কানাডা