খান মাহবুব:উৎসব মানেই সবাই মিলে একত্র হয়ে মিলনের মোহনায় দাঁড়িয়ে একমঞ্চে উদ্যাপন। তাই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উৎসবের উপস্থিতি লক্ষণীয়। বর্তমানে অতিমারি করোনার তাণ্ডব শুধু ঈদ নয়, জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ স্থবির করে দিয়েছে।
যখন জীবন ও জীবিকা অনিশ্চয়তার দোলাচলে দুলছে, তখন ঈদ কি কোনো আনন্দ নিয়ে হাজির হতে পারে? সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ৩২ লাখের বেশি মানুষের প্রাণসংহার হয়েছে করোনায়। দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ হাজারের কাছাকাছি।
ঈদ মানে আনন্দ হলেও গতবারের মতো এবারও ঈদ সেভাবে হাজির হচ্ছে না। বরং করোনাকালে ঈদ মানে আরেকটি বিষাদমাখা দিন-যে দিনেও গুনতে হয় মৃত্যুর সংখ্যা। অনেককে ছুটতে হয় হাসপাতাল, গোরস্থান কিংবা শ্মশানে। এ পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে মিসরে সরকারি পরিপত্র জারি করে ঈদ উৎসবের আয়োজন বাতিল করা হয়েছে।
করোনাকালের ঈদ বড়ই দুর্বিষহ। সাধারণ মানুষের কাছে অর্থের প্রবাহ নেই, আবার সঞ্চিত কিছু অর্থ থাকলেও এত দিনে তা শেষ হতে চলেছে। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে উৎসব কী করে হয়? করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকায় এটিএম বুথ থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ কোটি টাকা উত্তোলন হতো ঈদ মৌসুমে। এখন টাকার সঞ্চয় কম বলে উত্তোলনও কম। সাধারণত ঈদ মৌসুমে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বেশি টাকা লেনদেন হয়। জাকাত ও ফিতরা বাবদ ৭০ হাজার কোটি টাকা গরিবদের মাঝে বিতরণ হয়। এখন সব কিছুতেই ভাটার টান। করোনা মোকাবিলায় সরকারের ভালো কিছু উদ্যোগ থাকলেও বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী কর্মকাণ্ড লক্ষণীয়। এখন পর্যন্ত লকডাউন কার্যত একটি ঘোষণামাত্র। কার্যকারিতা লক্ষ করা যায় না। সকালে ঘোষণা-দোকানপাট বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা; কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা-রাত ৮টা পর্যন্ত। আর গণপরিবহণে ভাড়া বাড়ানোর পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বালাই নেই। এসব বিষয়ে সরকারের গভীর নজরদারি প্রয়োজন।
সরকার করোনার মধ্যেও চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এ তালিকায় পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল অগ্রগণ্য। শুধু তাই নয়, গত ৪ মে একনেক সভায় ১১ হাজার ৯০১ কোটি টাকার ১০টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া একটি সাহসী পদক্ষেপ। ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ গড়ার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদপূর্ব তারল্য প্রবাহ কম। ফলে ঈদের আনন্দ মলিন ও ধূসর।
ঈদের মূল চালিকাশক্তি পণ্য ও অর্থের সঞ্চালন। সেটা করোনাকালে যথাযথভাবে হচ্ছে না। তবে এই দুর্যোগকালেও একটা সুখের খবর হলো রেমিটেন্স প্রবাহ আশাব্যঞ্জক। এর মাধ্যমে আমরা আশা করতে পারি গ্রামীণ অর্থনীতিতে, ঈদ বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
গত তিন দশকে মানুষের আর্থিক সামর্থ্য বৃদ্ধি ও যোগাযোগের উন্নয়নের ফলে ঈদের ফ্যাশন ও খাদ্যাভ্যাসে গ্রাম ও শহরের মধ্যে একটা নৈকট্য এসেছিল। ঈদে আর যাই হোক জৌলুসের কমতি দেখা যায়নি। ঈদ উপলক্ষ্যে ধারদেনার শোধ, অর্থের সঞ্চালন শহর থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কমবেশি ছিল। আজ করোনার কারণে ঈদের সামাজিক অর্থনীতির চিরায়ত রূপে ঘটেছে পরিবর্তন।
জানি না আবার কবে ঈদে উন্মুক্ত প্রান্তরে পরস্পর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে সবাই এককাতারে নিজেকে সমর্পণ করতে পারব। সেদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
খান মাহবুব : প্রাবন্ধিক; খণ্ডকালীন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়উৎসঃ jugantor