রাজধানীর রূপনগরে তিন পুরিয়া গাঁজাসহ আটক করা হয়েছিল দুই যুবককে। এর পর ৬৪ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মোটা অঙ্কের ঘুষই নয় কেবল, আটক দুজনের একজনকে মুক্তির বিনিময়ে তার একটি বাড়ি লিখে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন রূপনগর থানার এসআই মো. সাইফুল ইসলাম। কিন্তু স্বজনরা সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বেধড়ক মারধরের শিকার হতে হয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের আটক বখাটে সেই যুবককে। শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ ও অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় এরই মধ্যে গুরুদণ্ড পেয়েছেন এসআই সাইফুল।
জানা গেছে, অভিযোগের ভিত্তিতে এসআই সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা (ঢাকার পিএসঅ্যান্ডআইআই বিভাগের বিভাগীয় মামলা নং-৪৩৩/২০) হয়। ঘটনা তদন্ত করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ) শামসুল আরেফীন। তাতে এসআই সাইফুলের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলা, শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ ও অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণ হয়। পরে ডিএমপির (অধস্তন কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০০৬-এর বিধি ৪(খ)(৭) অনুযায়ী, ওই পুলিশ কর্মকর্তার গুরুদণ্ড হিসেবে একটি ইনক্রিমেন্টের সমপরিমাণ অর্থ প্রতি মাসের বেতন থেকে পাঁচ বছরের জন্য কাটার সাময়িক আদেশ দেওয়া হয়। তবে ঘুষ বাণিজ্যের পরও সাইফুল ইসলাম রূপনগর থানাতেই কর্মরত।
এ বিষয়ে এসআই সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে সব অভিযোগই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। গতকাল শনিবার আমাদের সময়কে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওইদিন গাঁজাসহ দুজনকে আটকের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েই তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে টাকা লেনদেনের প্রশ্নই ওঠে না। আর আটক দুজনের একজনকে ছাড়ার বিনিময়ে তার বাড়ি লিখে নেওয়ার প্রস্তাবের বিষয় সম্পূর্ণ বানোয়াট, রীতিমতো হাস্যকর।’ অভিযোগের পর তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গুরুদ- দেওয়া হয়েছে- প্রসঙ্গটি টানতেই সুকৌশলে তা এড়িয়ে যান এসআই সাইফুল। কেবল বলেন, ‘আমি ওই বিষয়ে অবগত নই। এটাও অসত্য তথ্য।’ আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে অবশ্য উঠে এসেছে, এসআই সাইফুল ইসলাম নিজেই বরং অসত্য তথ্য দিয়েছেন। কারণ গুরুদ- পাওয়ার পর নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে গত ২০ এপ্রিল ডিএমপির প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের উপপুলিশ কমিশনারের দপ্তরে তিনি এ বিষয়ে লিখিত জবাব দিয়েছেন।
লিখিত সেই জবাবে এসআই সাইফুল উল্লেখ করেন, এএসআই মো. হারুন অর রশিদসহ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রূপনগর থানা এলাকায় হোন্ডা মোবাইল-৭৬ (ডে) ডিউটিতে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। সেদিন বেলা আড়াইটার দিকে চলন্তিকা মোড় থেকে থানায় আসার সময় বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতন স্কুলের সামনে কিছু ব্যক্তির গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হয়। সঙ্গীয় অফিসারের সহায়তায় তাদের দেহ তল্লাশি করে সন্দেহভাজন বিদ্যুৎ রহমানের (২৪) কাছে এক পুরিয়া এবং মো. ফয়সালের (২৫) কাছে পান দুই পুরিয়া গাঁজা। আটকদের থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানায় তারা গাঁজাসেবী। পরবর্তী সময়ে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকের জিম্মায় তাদের তুলে দেওয়া হয়।
ওই ঘটনায় দায়ের জিডিতে কেবল ফয়সালকে আটক ও অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ রহমানকে আটক ও তাকে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে লিখিত জবাবে তিনি উল্লেখ করেন, জিডিতে তার বিষয়টি লিপিবদ্ধ না করা অজ্ঞাতবশত হয়েছে। তবে এমন ভুল যেন আর না ঘটে, সে বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও যতœবান ও সতর্ক থাকবেন বলে জানান। আবার আটক ফয়সালকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে তিনি কারও কাছে কোনো টাকা-পয়সা দাবি করেননি কিংবা কারও মাধ্যমে তা গ্রহণও করেননি বলে লিখিত জবাবে উল্লেখ করেন এসআই সাইফুল ইসলাম। তবে অভিযুক্ত এসআই যে তথ্য দিয়েছেন তার উল্টোটাই বলছেন ভুক্তভোগীরা। গতকাল দুপুরে ফল ব্যবসায়ী মো. বিদ্যুৎ রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সেদিন তার মুক্তির জন্য এসআই সাইফুল ইসলামকে ১৯ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।’ তবে তাকে কোনো মারধর করা হয়নি।
ভুক্তভোগী হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী মো. ফয়সাল জানান, তার সঙ্গে কোনো মাদক না থাকলেও দুই পুরিয়া গাঁজাসহ আটক দেখানো হয়। পরে থানায় নিয়ে মারধর করে অভিভাবকদের ফোন দিতে বলেন এসআই সাইফুল। চাচাতো ভাই মোস্তাকিন থানায় এলে ফয়সালের মুক্তির জন্য প্রথমে ১ লাখ টাকা দাবি করা হয়। এত টাকা নেই জানালে ওই এসআই তখন আসামির ভাইকে বলেন- ‘ফয়সাল বড়লোকের ছেলে, তার বাবার তো ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি; টাকা না থাকলে এর (বাড়ি) একটা লিখে দেন। না হলে ছাড়ব না।’ ৬ ঘণ্টা পর অনেক দেনদরবার করে ৪৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ফয়সালের মুক্তি মেলে।
রূপনগর থানা সূত্রে জানা গেছে, আটক ফয়সালের অভিভাবকদের সঙ্গে এসআই সাইফুলের দেনদরবারের সময় সেখানে হঠাৎই ঢুকে পড়েন ডিএমপির ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ডিভিশনের (আইএডি) এক কর্মকর্তা। তিনি ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই সাইফুল তাকে ঘটনা চেপে গিয়ে ঘুষ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। বলেন, ‘স্যার আপনি ৫০ (৫০ হাজার টাকা) নেন, আমি নিই ৫০; চেপে যান।’ কিন্তু ঘুষের প্রস্তাবে সায় না দিয়ে ওই আইএডি কর্মকর্তা সেই ঘটনা সবিস্তারে অভিযোগ আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান। আর ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই গুরুদ- দেওয়া হয় এসআই সাইফুল ইসলামকে।