ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর অঞ্চল দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে উপজাতীয় যোদ্ধাদের এক অভিযান এবং তারপরের সামরিক সংঘাতের মধ্যে দিয়ে ।
সেই সংঘাতের শিকার হয়েছিলেন এরকম কিছু মানুষ, এবং কাশ্মীরের রাজনীতিবিদদের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির অ্যান্ড্রু হোয়াইটহেড।
তা নিয়েই বিবিসি বাংলার ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।
সেটা ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাস। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধারা অভিযান চালান কাশ্মীর উপত্যকায়।
তাদের হাতে ছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র – কিন্তু তারা তেমন সুশৃঙ্খল বাহিনী ছিল না। ট্রাকে করে এই যোদ্ধাদের দল অগ্রসর হলো বারামুল্লার দিকে।
কাশ্মীর উপত্যকার এক প্রান্তে একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল এই বারামুল্লা। এখানে একটি ক্যাথলিক মিশন ও হাসপাতালের ওপর আক্রমণ চালায় যোদ্ধারা।
বিবিসি রেডিওর রিপোর্টে বলা হয়, বারামুল্লার অন্যান্য ভবনের মতোই সেন্ট জোসেফ’স কনভেন্টেও এই যোদ্ধারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এই উপজাতীয় যোদ্ধারা লড়াইয়ের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব রীতিই মানে, আধুনিক যুদ্ধের কোন নিয়মকানুন তাদের জানা নেই।
৪৭ সালের ঘটনা সম্পর্কে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করতে বিবিসির হয়ে ২০০৩ সালে এন্ড্রু হোয়াইটহেড কাশ্মীর গিয়েছিলেন ।
কাশ্মীর বিখ্যাত তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য
ওই ঘটনায় যারা বেঁচে গিয়েছিলেন – তাদের দু জন এ্যানজেলা রারানিয়া এবং টম ডাইকস। সেন্ট জোসেফস কনভেন্টে যখন আক্রমণ হয় তখন তাদের বয়েস একেবারেই কম।
এ্যানজেলার মা ছিলেন একজন ডাক্তার। আর টম ডাইকস ছিলেন একটি ব্রিটিশ পরিবারের সন্তান, তার মা ওই হাসপাতালে এসেছিলেন আরেকটি সন্তান জন্ম দেবার জন্য।
অ্যাঞ্জেলা বলছিলেন, “আমি দেখলাম, দেয়াল টপকে ভয়ংকর কিছু লোক ভেতরে আসছে। তাদের হাতে বন্দুক, মুখে দাড়ি। তাদের হাতে যারা মারা যাচ্ছে – সেই নিহতদের হাত থেকে ঘড়ি খুলে নিচ্ছিল তারা।”
টম ডাইকসেরও মনে আছে সেই দিনটির ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
“আমি দরজার ফাঁক দিয়ে আক্রমণকারীদের উত্তেজিত মুখগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম, আর আতংকিত নার্সরা একটা কোণায় জড়োসড়ো হয়ে আছে।”
“আমার মনে আছে তাদের কয়েকজনকে কাপড়চোপড় ছেঁড়া অবস্থায় দেখেছি। তারা ধর্ষিত হয়েছিল কিনা আমি জানি না। “
এ্যানজেলা বলছিলেন, “তারা যাকেই পাচ্ছিল, তাকেই ছুরি মারছিল বা গুলি করছিল।এমনকি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা লোকদের ওপরও তারা আক্রমণ চালিয়েছিল।”
বারামুল্লা শহরেও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এই আক্রমণকারীরা ।
কাশ্মীর এখন ভারত ও পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে বিভক্ত।
ওই শহরের একটি প্রভাবশালী শিখ পরিবার ছিল বালিরা। শিখ সম্প্রদায় ছিল আক্রমণকারীদের এক বড় টার্গেট।
সেই বালি পরিবারের একজন বলছিলেন,”শহরে ব্যাপক আতংক তৈরি হয়েছিল। সবাই দৌড়ে পালাচ্ছিল। সবার মুখেই এক কথা – বাঁচতে হলে পালাও।”
একজন শিখ মহিলা বলেছেন, যুবতী মেয়েদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেসময়।
“এরই মধ্যে তারা আবার যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছিল অন্য গ্রামে।”
” আমার সম্পর্কীয় তিন বোন ছিল, তাদের সবাইকেই ওরা ধরে নিয়ে যায় আমার চোখের সামনেই। তার পর তাদের আর কোন খোঁজ পাই নি আমরা।”
এই আক্রমণ হয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের ভারত ত্যাগের দু’মাস পরে ।
কাশ্মীরের জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশই মুসলিম, তবে তাদের শাসক ছিলেন হরি সিং – একজন হিন্দু মহারাজা।
করণ সিং
তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না যে হিন্দু-প্রধান ভারতে যোগ দেবেন, নাকি মুসলিম-প্রধান পাকিস্তানে যোগ দেবেন।
সেই রাজ্যের যুবরাজ ছিলেন তার পুত্র করণ সিং।
করণ সিং-এর কথায় – “১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পর আমার পিতা তাত্ত্বিকভাবে স্বাধীন রাজায় পরিণত হয়েছিলেন। কারণ তিনি ভারত বা পাকিস্তান কোনটাতেই যোগ দেন নি।”
“তিনি দুটি দেশের সাথেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। সে প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই উপজাতীয়দের ওই অভিযান হয়।”
উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো অভিযান চালিয়েছিল পাকিস্তান এবং ইসলামের নাম নিয়ে।
মহারাজা তখন একটি উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন এবং এ আক্রমণের জন্য একেবারেই তৈরি ছিলেন না।
করণ সিং বলছিলেন, সেসময় কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের রাজপ্রাসাদেই ছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের শাসক ছিলেন হরি সিং
“তখন একটা দরবার চলছিল – এটা ছিল এরকম একটি অনুষ্ঠান যেখানে আমার পিতা সিংহাসনে বসেন এবং সবাই তার প্রতি সম্মান জানায়।”
“প্রাসাদে একেবারে ফাঁকা – সবাই বাইরে। তার মধ্যে হঠাৎ সব আলো নিভে গেল। এক অদ্ভূত ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হলো। “
“আলো নিভে গিয়েছিল কারণ আক্রমণকারীরা মহুরায় অবস্থিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দখল করে নিয়েছিল। সেটা ছিল শ্রীনগর-উরি রোডের ওপর – মাত্র ৩০-৩৫ মাইল দূরে।”
কাশ্মীরের মহারাজাকে ভারতে যোগ দেবার দিকে ঠেলে দিল এই আক্রমণ।
কাশ্মীর বিভক্ত ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এল ও সি দিয়ে
তিনি ভারতের অংশ হবার জন্য দিল্লির সাথে একটি চুক্তি সই করলেন, এবং ভারতের সামরিক সহযোগিতা চাইলেন। তার পর তিনি একটি গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে জম্মু শহরে চলে গেলেন।
করণ সিং বলছিলেন, “এটা ছিল একটা ভয়াবহ যাত্রা। আমরা যখন যাত্রা শুরু করি তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আমার পিতা এসব ঘটনার কারণে স্বাভাবিকভাবেই খুব বিমর্ষ এবং বিচলিত হয়ে ছিলেন। পুরো পথটায় তিনি গাড়িতে একটি কথাও বললেন না।”
“জম্মু পৌছানোর পর তিনি গাড়ি থেকে নেমে বললেন, আমরা কাশ্মীরকে হারিয়েছি।”
তবে উপজাতীয় যোদ্ধাদের হাতে আক্রান্ত সেন্ট জোসেফস কনভেন্টের লোকদের অবশ্য পালানোর কোন সুযোগ ছিল না।
শ্রীনগর প্রাসাদ
আক্রমণকারীরা দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে লুটপাট চালালো, এবং নানদের লাঞ্ছিত করলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৬ জন নিহত হলো । তাদের মধ্যে হাসপাতালের রোগী থেকে শুরু করে নার্স – সবাই ছিল।
আরো ছিলেন টম ডাইকসের বাবা-মা-ও। ওই হাসপাতালেই পেছন দিকে একটি খোলা জায়গায় তাদের কবর হয়েছে।
টম বলছিলেন, “গোলাগুলি থেমে যাবার পর আমরা আসলে বাবা-মাকে খুঁজছিলাম। একটা জায়গায় দেখলাম মৃতদেহের স্তুপ। আমার ভাই ডগলাস সেখানে চিৎকার করে কাঁদছিল। একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। আমাকে বললেন, তোমার বাবা-মা মারা গেছেন।”
এই মহিলাটি ছিলেন এ্যানজেলা রারানিয়া।
এ্যান্জেলা বলছিলেন, “ওরা সব নানদের বের করে নিয়ে এলো। আমার বাবা সেখানে ছিলেন, এবং চেষ্টা করছিলেন আক্রমণকারীদের অন্যদিকে সরিয়ে দেবার জন্য। আক্রমণকারীরা তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা বললো, আপনি ওই গাছটার দিকে চলে যান।”
“তিনি যখন সেদিকে হাঁটছিলেন – তখন তিনি বলছিলেন, তার প্রতি দয়া দেখাতে, কারণ তার স্ত্রী-সন্তান আছে। নানরাও বলছিলেন, তাকে রেহাই দেবার জন্য। কিন্তু তারা তাকে গুলি করলো।
দশদিন অবরোধের পর ভারতীয় বাহিনী আক্রমণকারীদের শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য করলো। পুরো কাশ্মীর উপত্যকা দখল করে নিলো ভারতীয় বাহিনী ।
ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীর।
সাংবাদিকরা বলেন, শ্রীনগরের ছোট রানওয়েতে এত বিমানের ওঠানামা সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। একের পর এক বিমান আসছিল – আরো বেশি শিখ যোদ্ধাদের নিয়ে।
কিন্তু কাশ্মীরের অন্য কিছু অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণেই রয়ে গেল।
কয়েক মাসের মধ্যেই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। রাজ্যটি দু-ভাগে ভাগ হয়ে গেল – যে বিভক্তি এখনো আছে।
এর পর আছে সেই প্রশ্ন – যে এ উপজাতীয় অভিযানের পেছনে পাকিস্তানের কতটা ভুমিকা ছিল। করণ সিং এ ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীকেই সমর্থন করেন।
মি. সিং বলেন, “এ আক্রমণের পেছনে পাকিস্তানের ইন্ধন এবং অর্থ কাজ করেছে। আমরা পরে জেনেছি যে , এই উপজাতীয়দের মধ্যে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সৈন্য এবং সামরিক অফিসাররাও ছিল।”
“কাশ্মীর দখল করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। এটা এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই।
কিন্তু পাকিস্তানের এ চেষ্টা তো সফল হয়নি। হয়েছিল কি? প্রশ্ন করা হয়েছিল করণ সিংকে।
“না, এ অপারেশন পুরোপুরি সফল হয় নি। কিন্তু আমার বাবাকে ভারতে যোগদানে বাধ্য করতে সফল হয়েছিল তারা” – জবাব দেন তিনি।
তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন সরদার আবদুল কাইয়ুম খান – একজন নেতৃস্থানীয় কাশ্মীরী মুসলিম নেতা। ১৯৪৭ সালে তিনি নিজেও কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন।
কাইয়ুম খান বলেন, উপজাতীয় অভিযান আসলে তার পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিয়েছিল।
কাইয়ুম খানের কথায় – “এর পেছনে পাকিস্তান কলকাঠি নেড়েছে – এমন সকল অভিযোগই ঐতিহাসিকভাবে ভুল।”
“আমরা সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করেছিলাম ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে। তখন ব্যাপারটা এরকম ছিল যে রাজ্যের সেনাবাহিনী রাজ্যের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তবে ধীরে ধীরে এমন হলো যে সীমান্ত এলাকা থেকে আরো লোক এতে যোগ দিতে শুরু করেছিল। কিন্তু পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যায় উপজাতীয় লোকদের অভিযানের কারণে।”
কাশ্মীরে এখন সর্বত্র চোখে পড়বে সেনা উপস্থিতি
“সমন্বয় থাকলে তারা হয়তো বিনা বাধায় শ্রীনগর বিমান বন্দরে পৌঁছে যেতে পারতো। কিন্তু এই যোদ্ধারা ছিল বিশৃঙ্খল। পেছন থেকে কোন কমান্ড ছিল না। ফলে তারা লুটপাট শুরু করলো। এবং যখন তাদের দু’হাত ভরে গেল, তখন তারা ফিরে চলে গেল।”
এ ব্যাপারে একমত মহারাজার পুত্র করণ সিং ।
তিনি বলছেন, উপজাতীয়রা যদি কয়েকদিন ধরে লুটপাটে ব্যস্ত না ধাকতো তাহলে পাকিস্তান-সমর্থিত বাহিনী বারামুল্লায় পৌঁছে যেতো, আর কাশ্মীরের ইতিহাসও হয়তো বদলে যেতো।
“পরিস্থিতি খুব নাজুক হয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী যখন নামতে শুরু করে তখন আক্রমণকারীরা শ্রীনগরের বিমানবন্দরের মাত্র ৪/৫ মাইল দূরে। “
এর পর কাশ্মীর বিভক্ত হয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তান- নিয়ন্ত্রিত দুটি অঞ্চলে।
সেই থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ চলছে । কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালের পর থেকে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে চলেছে তীব্র, সহিংস ও রক্তাক্ত বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা ।
১৯৪৭-পরবর্তীকালে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ নামে পরিচিত এক আইন অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা, নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার অধিকার দেযা হয়।
কয়েক বছর আগে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট কাশ্মীরের সেই বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে।
পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে রূপান্তরিত করা হয় লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে।
আজ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে সৃষ্টি হওয়া কাশ্মীরের সেই বিভক্তি জোড়া লাগে নি।উৎসঃ বিবিসি বাংলা