ড. আবু সালেহ মুহাম্মাদ তোহা,কোরআন এক অলৌকিক গ্রন্থ, যা মানবজাতির পথনির্দেশক হিসেবে প্রেরিত হয়েছে। কোরআন আল্লাহর বাণী, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়ে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ আছে এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে সন্দেহাতীতভাবে ক্রমান্বয়ে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। রমজান মাসে কোরআন অবতরণের সূত্রেই রমজান কোরআনের মাস হিসেবে বিবেচিত।
কোরআন অবতরণের মাস : মানবজাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তাআলার প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআন মাজিদ রমজান মাসে অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআন অবতরণের সূত্র ধরেই রমজান মাস শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারি এবং সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
কোরআন অবতরণের সূচনা : রমজান মাসের কদরের রাতে নবী (সা.)-এর প্রতি কোরআন অবতরণের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যা সুদীর্ঘ ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়েছে। শুরুটা মহিমান্বিত কদরের রাতে হওয়ার কারণে আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে কদরের (রমজানের এক বিশেষ) রাতে আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা : কদর, আয়াত : ১)
হেরা গুহায় প্রথম ওহি : রাসুলুল্লাহ (সা.) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ মতান্তরে ১২ তারিখ (৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাস) সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন। (সিরাতুল মুস্তফা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫১) রবিউল আউয়াল মাসে জন্ম হিসেবে ৪০ বছর পর রবিউল আউয়াল মাসেই নবী (সা.)-এর বয়স ৪০ বছর পূর্ণ হয়। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন সত্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর কাছে একাকিত্ব আকর্ষণীয় হয়ে উঠলে তিনি হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকতে শুরু করেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে এসে খাদ্য-পাথেয় নিয়ে যেতেন। এভাবে ছয় মাস অতিক্রম হওয়ার পর অর্থাৎ রবিউল আউয়াল মাসের পর (১) রবিউস সানি, (২) জুমাদাল উলা, (৩) জুমাদাল উখরা, (৪) রজব, (৫) শাবান, (৬) রমজান মাসে তাঁর প্রতি কোরআন অবতীর্ণ হওয়া শুরু হয়। প্রথমে সুরা আলাকের শুরুতে পাঁচটি আয়াত অবতীর্ণ হয়। (বুখারি, হাদিস : ৩; মুসলিম, হাদিস : ৪৪২)
পুরো কোরআন প্রথম আসমানে স্থানান্তর : আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদকে রমজান মাসের কদরের রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইজজাতে স্থানান্তর করেন। কোরআন মাজিদ লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘বরং এটি মহান কোরআন, লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত।’ (সুরা : বুরুজ, আয়াত : ২১-২২)
রমজান মাসে কদরের রাতে আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদকে সেখান থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইজজাতে নিয়ে রেখেছেন। সেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ২৩ বছরে নবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কদরের রাতে কোরআন মাজিদ পুরোটাই লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আসমানে বাইতুল ইজজাতে অবতীর্ণ করেছেন। অতঃপর প্রয়োজন অনুযায়ী ২৩ বছর ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। (ইবনে কাসির, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৪৪১; তাফসিরে কুরতুবি, ২০তম খণ্ড, পৃ. ১২৯)
রোজা ও কোরআনের সুপারিশ : রোজা রোজাদারের জন্য আর কোরআন তার পাঠকারীর জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রোজা ও কোরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে, রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলা তাকে পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৬২৬)
রমজানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোরআন তিলাওয়াত : রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা বছর রাত জেগে নামাজ আদায় করতেন এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কোরআন তিলাওয়াত করতেন। এতে তাঁর পা ফুলে যেত। আল্লাহ বলেন, ‘আপনাকে কষ্ট-ক্লেশ দেওয়ার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি।’ (সুরা : ত্ব-হা, আয়াত : ২)
এর পর থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) রাতের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশে নামাজ ও তিলাওয়াত করতেন। রমজানে তাঁর তিলাওয়াতের মাত্রা আরো বেড়ে যেত। তিনি জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে সারা বছর অবতীর্ণ হওয়া কোরআনের অংশগুলো পুনরাবৃত্তি করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রমজানের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। রাসুল (সা.) জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে কোরআন পুনরাবৃত্তি করতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬; মুসলিম, হাদিস : ৬১৪৯)
রমজানে আমাদের দায়িত্ব : কোরআনের সঙ্গে রমজানের নিবিড় সম্পর্কের কারণে এই বরকতময় মাসে পুণ্যবান মনীষীরা রোজা রাখার মহান হুকুম পালনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য নফল ইবাদতের মধ্যে কোরআন তিলাওয়াতকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। রমজানের পুরো মাসকে পবিত্র কোরআনের জন্য ওয়াক্ফ করে দিতেন। তাঁদের কেউ কেউ সাধ্যানুযায়ী অধিকবার কোরআন খতমের প্রতি মনোনিবেশ করতেন। আবার অনেকের মনোযোগ থাকত কোরআনের গভীরে গিয়ে নিগূঢ় তথ্য ও রহস্যগুলো উদঘাটন করে তার মুক্তামালায় জীবনকে সাজিয়ে নেওয়া। এই পবিত্র মাসে আমাদের কাম্য হলো—
১. সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে না জানলে এই রমজানেই কোরআন শেখার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা শুরু করা।
২. কোরআন পড়তে জানলে একাধিক খতম হওয়ার মতো বেশি করে তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তোলা।
৩. কোরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি কোরআনের মর্মবাণী বোঝার জন্য তাফসির ও হাদিস অধ্যয়নসহ হক্কানি আলেমদের সাহচর্য লাভ করা।
৪. কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী সুন্নাহমাফিক আমল করে কোরআনের সঙ্গে সুমধুর সম্পর্ক গড়ে তোলা।
৫. তারাবির নামাজে কোরআন শুনে খতম করা।
৬. রমজান মাসে গড়ে তোলা অভ্যাস বছরজুড়ে চালু রাখা।
পরিশেষে বলা যায়, কোরআনের মাসে কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হোক, এটাই হওয়া উচিত সবার প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়। এতেই পূর্ণতা পাবে রমজানের আবেদন। মহান আল্লাহ সবাইকে তাওফিক দান করুন।