২০০৮ সালে তার গ্রামে টিনশেডের পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না। আর এখন ঢাকাসহ নিজ এলাকার যেদিকে তাকান সব জায়গাতেই তার সম্পদ। আছে সুরম্য প্রাসাদ ‘হাওড় বাংলা’। জেলেদের হাওড়-বাঁওড়ও তার ভোগদখলে। ২০০৮ থেকে ২০১৮- এই ১০ বছরে টিনের ঘর থেকে তার সম্পদ বাড়ল কয়েক শ গুণ। গত দুই বছরের হিসাব বাইরে থাকল। এমপি হয়ে সম্পদের পাহাড় গড়া সুনামগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে জমি দখল, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ আছে আরও নানা অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের আওতায় তিনি।
সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে প্রভাবশালী নেতাদের আটকের পরই আলোচিত ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গে সখ্য এবং সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ ওঠে সুনামগঞ্জ-১ আসনের এই সাংসদের বিরুদ্ধে।
এর পরই মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও তার স্ত্রী মাহমুদা হোসেন লতার যাবতীয় ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে কমিশনের সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজী স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) মহাব্যবস্থাপক বরাবর পাঠানো হয়।
ওই বছরই অর্থাৎ ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) বরাবর দুদক চিঠি পাঠায় এই সাংসদ যেন দেশত্যাগ করতে না পারেন সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। অনুসন্ধান দলের প্রধান সৈয়দ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত সেই চিঠিতে রতনের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগের ‘প্রাথমিক সত্যতা’ পাওয়ার কথা বলা হয়।
মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার বিষয় সে সময় গণমাধ্যমকে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন দুদকের সাবেক সচিব দিলওয়ার বখত। তিনি বলেন, এই সংসদ সদস্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উপায়ে সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধানে ‘প্রাথমিক সত্য’ পাওয়া গেছে।
এসব ঘটনায় গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ে সাংসদ রতনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন একটি দল। সেদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত টানা তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে নোটিশ পাঠিয়ে দুদকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে তলব করা হয়।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সে সময় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ‘হয়রানির শিকার’। নিজের কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। বরং তিনি নিজেই এত দিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
হলফনামায় যা ছিল, যা হয়েছে
সুনামগঞ্জ-১ আসন (ধর্মপাশা, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ) থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। তখন নির্বাচন কমিশনে তার সম্পদের হিসাব বিবরণী হলফনামা থেকে দেখা যায়, এই সাংসদের গ্রামে টিনশেডের পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না। তার কৃষিজমি ছিল ৩ দশমিক ৯৩ একর। অকৃষি জমি ১ দশমিক ১৫ একর। এ ছাড়া তার আর কোনো স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনের ঠিক ১০ বছর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য তিনি নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেন সেখানে সম্পদের হিসাব বিবরণীতে দেখা যায়, তার কৃষিজমি বেড়ে হয়েছে ৫২৩ একর, অকৃষি জমির পরিমাণ ৮ দশমিক ২৬ একর।
একইভাবে স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে দুটি দালান, একটি টিনশেড ঘর। এ ছাড়া ঢাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট। সাংসদের আছে একটি ল্যান্ড ক্রুজার ও একটি টয়োটা সিডান কার। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি গাড়ি বেনামে আছে বলেও জানা যায়।
যেভাবে হলো ‘হাওড় বাংলা’
সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার নিজ গ্রামে গড়েছেন বিশাল এক অট্টালিকা, নাম দিয়েছেন ‘হাওড় বাংলা’। বাড়িটি যে জায়গায় নির্মিত হয়েছে, সেখানে ওই এলাকার দুই ব্যক্তির ৬২ শতাংশ জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, ‘হাওড় বাংলা’র সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে গাছতলা গ্রামের বাসিন্দা আলতু মিয়ার ৩২ শতক এবং পাইকুরাটি গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ রঞ্জন সরকারের ৩০ শতক জমি আছে। আলতু মিয়ার জমির ৮ শতাংশ জায়গায় রতন তার এক বোনকে একটি টিনশেড ঘর করে দেওয়ার কথা বলে ২০০১ সালে আলতু মিয়ার কাছ থেকে কিনতে চেয়েছিলেন।
রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার সময় আলতু মিয়াকে ৩০ হাজার টাকা দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ৮ শতাংশের টাকা তো দেনইনি, উল্টো আগের ৮ শতাংশের সঙ্গে ২৪ শতাংশসহ মোট ৩২ শতাংশ জায়গা সীমানা প্রাচীর দিয়ে দখল করে নেন। নিজের নামে লিখে নেওয়া এই জায়গা নিয়ে মামলায় ২০০৮ সালে আদালত রায়ে নামজারি বাতিল করে দেন।
একইভাবে তার এই ‘হাওড় বাংলা’র ভেতরে বিকাশ রঞ্জন সরকার নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তার জমি রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিকাশ রঞ্জনের জমির দাগ নম্বর ১৭৫১। এ ছাড়া সাংসদের দুই ভাইয়ের নামে আরও ২ একর ৬৫ শতক জমি তিনি দলিল করে দিয়েছেন, তবে সেই জমির কোনো টাকা পাননি ওই ব্যাংক কর্মকর্তা।
সুনামগঞ্জের জলমহালও তার দখলে
হাওড়-বাঁওড় বেষ্টিত সুনামগঞ্জে রয়েছে অসংখ্য জলমহাল। এই সাংসদের নির্বাচনী এলাকার বেশির ভাগ জলমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি নিজে। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সুনই জলমহালটি তার একটি। এটি নিয়ন্ত্রণ করেন সাংসদ ও তার ছোট ভাই ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন।
চলতি বছরে ৭ জানুয়ারি সুনই নদ জলমহালে মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণ (৬৫) হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই ঘটনায় আহত হন আরও ২০ জন। ঘটনার পর নিহত ব্যক্তির ছেলে চন্দন বর্মণ সাংসদ মোয়াজ্জেম ও তার ছোট ভাই মোজাম্মেল, বড় ভাই মোবারক হোসেন ওরফে মাসুদকে আসামি করে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও পুলিশ সেই মামলা নেয়নি।
স্থানীয় মৎস্যজীবী সমিতির নামে এই জলমহাল ইজারা নিলেও জলমহালটির সব সুবিধা ভোগ করেন এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও তার ভাইয়েরা। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে শ্যামাচরণের মতো মৎস্যজীবীরা এখানে জিম্মি রতনের কাছে।
তদন্ত কত দূর?
মূলত ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে র্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো পরিচালনায় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কিছু নেতার সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এর সঙ্গে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারির অভিযোগ আসে অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে।
ওই ঘটনায় বিভিন্ন প্রভাবশালীর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে সাংসদ রতনের বিরুদ্ধে। এমনকি কানাডার ‘বেগমপাড়া’য় তার বাড়ি থাকার কথাও প্রকাশিত হয় গণমাধ্যমে।
দীর্ঘদিন ধরে এই সাংসদের বিষয়ে তদন্ত করছে দুদক। ইতোমধ্যে সংস্থাটির তলবে নিজের সম্পদ বিবরণী জমা দেন কমিশনের কাছে। মুখোমুখি হয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদের।
সাংসদ রতনের বিষয়ে তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে ঢাকা টাইমস ফোনে যোগাযোগ করলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন কোনো সাড়া দেননি।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট অন্য একজন কর্মকর্তাকে ফোন করে তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার এই বিষয়ে বলার এখতিয়ার নেই। তবে সাংসদ রতনের বিরুদ্ধ তদন্ত এখনো চলমান। তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে এখনই ঠিক বলতে পারবেন না তিনি।