পটিয়ার সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। হুইপ বড় ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে দখল-চাঁদাবাজিতে মত্ত তিনি। যার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। দুই ভাইয়ের কর্মকাণ্ডে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে নবাবের বিরুদ্ধে কর্ণফুলী থানায় মামলা দায়ের করেন এএইচ এন্টারপ্রাইজের মালিক আনোয়ার হোসেন। মামলায় এমপির ছোট ভাইসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আরো ১০ থেকে ১৫ জনকে আসামি করা হয়। তবে পরবর্তীসময়ে মামলাটি আর আলোর মুখ দেখেনি।
কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেছিলেন, ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগে ওই মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলায় পটিয়ার সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরীর ছোট ভাইকে প্রধান আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বাদী আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেন, শিকলবাহায় নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউনিয়ন মার্কেন্টাইল’র পক্ষে সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করে আসছিলেন তিনি। বেশ কিছুদিন ধরে আসামিরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। চাঁদা না পেয়ে ২০০৫ সালের ৩ মে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে হামলায় একজন আহত হন। এসময় তার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের একটি স্বর্ণের চেইন ও একটি পালসার মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাব কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছি। আটটি প্রকল্পে বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ করছিলাম। শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমার কাছে অন্যায়ভাবে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হচ্ছিল। আমি রাজি হইনি। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে এসে তারা হামলা চালায়। এসময় পটিয়ার হুইপের ভাই উপস্থিত ছিলেন। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণস্থল কর্ণফুলী থানা এলাকায় হলেও পটিয়ার হুইপের ছোট ভাই চাঁদা দাবি করেছিলেন।
করোনার সংক্রমণের মধ্যে ২০২০ সালের ২ এপ্রিল নিজের জন্মদিনে নবাব নতুন করে আলোচনায় আসেন। আগে কখনো জন্মদিন পালন করতে দেখা না গেলেও বড় ভাই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাকে ঘটা করে জন্মদিন পালন করতে দেখা যায়। ওইদিন পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে কাটা হয় কেক। এসময় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের বেশকিছু নেতাকর্মীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
মুজিবুল হক চৌধুরী নবাবকে কেক খাইয়ে দেন পটিয়া উপজেলা যুবলীগের সদস্য শাহানা আকতার টিয়া। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বাধ্য করেন সেই অনুষ্ঠানে থাকতে। পরে জন্মদিনের কেক কাটার ছবি ফেসবুকেও দেন নবাব। এতে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
স্থানীয়রা জানান, নবাবের কথার বাইরে এখানকার ব্যবসায়ীরা যেতে পারেন না। তার কথাই এখানে আইন। কথায় কথায় দেন হামলা-মামলার হুমকি। স্ক্র্যাপ ব্যবসা ও সাপ্লাই সবই তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধপূর্ণ জায়গা নিয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করলে একপক্ষে গিয়ে থানাকে ব্যবহার করে তিনি বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নেন। পটিয়ার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নে ভূমি দখল করে নবাব গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার। যাতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন কোটি টাকা।
জানা যায়, নবাবের সহযোগী ভাগিনা লোকমান উপজেলার আরএফপির সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করেন। কমিটি করে টেন্ডার ছাড়াই কোটি কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নিয়েছেন লোকমান। নবাবের বোন রেখা চৌধুরী বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নামে বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের কাজ থেকে টাকা নেন। ঠিকাদারদের কাজ থেকে কমিশন আদায় এবং পোশাক কারখানায় গাড়ি সরবরাহও করেন রেখা। এছাড়া ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মজনু শোভনদন্ডী, খরনা, ভাটিখাইন ও কচুয়াই এলাকায় আধিপত্য দেখান। সব বিতর্কিত কাজেই তাদের অবস্থান থাকে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পটিয়ার আশিয়া, জঙ্গলখাইন, কাশিয়াইশ, হাইদগাঁও, কেলিশহর, কচুয়াই, খরনাসহ বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির টপ সয়েল বিক্রি করে কোটি টাকা অবৈধ আয় করেছেন হুইপের ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী প্রকাশ নবাব। এ ঘটনায় পটিয়া থানার সাবেক এক ওসির সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নবাব। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনেও তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এর আগে কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্যারটেকে জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে আলোচনায় আসেন নবাব। এছাড়াও সামশুল হকের কথামতো বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি না দেওয়ায় রাশেদ মনোয়ার-নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে নিজের অনুগতদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করতে ভূমিকা রাখেন তিনি।
২০০৯ সালে স্থানীয় পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাসব্যাপী মেলায় ঝুন্টু নামে এক ব্যক্তি জুয়া খেলার আয়োজন করেছিলেন। পরবর্তীসময়ে মেলায় জুয়ার আয়োজন নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে হুইপ সামশুল হকের নির্দেশে চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়। প্রায় আট বছর পর মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত।
উৎসঃ kalerkantho