গোপেন দেব : আমি তখন মার্কুলীতে। ক্লাশ টেনে পড়ি হয়তো।বাংলাদেশের প্রাচীনতম সাপ্তাহিক এবং তখনকার সময়ে সিলেটের খুব জনপ্রিয় পত্রিকা ‘যুগভেরী’।পড়াশুনার ফাঁকে এবং বাবাকে লুকিয়ে ( বাবা চাননি, ভাবতেন পড়াশুনা নষ্ট হবে এতে ) টুকটাক নিউজ পাঠাই, একান্তই শখের বসে।একদিন দুপুরের দিকে মার্কুলী বাজারে মাসুকের দোকানে বসে গল্প করছি। কে একজন ( মনে নেই নামটা ) এসে আমাকে বললেন, চেয়ারম্যান সাহেব আমাকে ডাক্তার বাবুর বাসায় যেতে বলেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম কেন ? বললেন, ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছেন। মার্কুলী পুরান বাজারের ডা. আর এম দাসের বাসা কাম ফার্মেসীর দুতলায় তাঁরা বসা। গেলাম সেখানে। যাবার পর চেয়ারম্যান সাহেব ( মরহুম আইয়ুব আলী চাচা ) পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে, তাঁদের সাথে। জানালেন তিনি, আমি এখানকার সাংবাদিক। খুব বিব্রত এবং ততোধিক লজ্জিত হলাম। এতো বড় ও পেশাদার সাংবাদিকদের মাঝে আমার পরিচয় সাংবাদিক ?! হাসান শাহরিয়ার ভাই কিন্তু বেশ আন্তরিকতার সাথে আমার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। আমার জড়তা কাটিয়ে দিলেন পুরোটাই। তখন তিনি দৈনিক ইত্তেফাক’র বিশেষ সংবাদদাতা।প্রায় সপ্তাহখানেকের একটি বিশেষ এসাইমেন্ট নিয়ে এসেছেন তাঁর পত্রিকা থেকে। সরেজমিন রিপোর্ট করবেন সিলেটের ভাটি অঞ্চলের সমস্যা, সম্ভাবনা নিয়ে। সাথে আছেন ইত্তেফাকের হবিগন্জ ও সুনামগন্জের নিজস্ব সংবাদদাতা মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।( হুমায়ুন রশীদ ভাই বর্তমানে একই পত্রিকার সিলেট অফিস প্রধান )।এই তিনজন ছাড়া সেখানে চেয়ারম্যান চাচা, ডা. ঋতুমোহন দাস ( আর এম দাস ) আর আমি ছিলাম।
তখন এক সময়ের স্টীমার জংশন প্রসিদ্ধ ব্যবসা বহুল জনপদ মার্কুলী বাজার কুশিয়ারা নদীর ভাঙ্গনে বিলুপ্তির পথে। মার্কুলী বাজারটি কুশিয়ারা, বিবিয়ানা, কালনী এই তিনটি নদীর সংযোগ স্থলে অবস্থিত। মার্কুলীর ভয়াবহ নদী ভাঙ্গন নিয়ে এরিমধ্যে আমি অনেকগুলো রিপোর্ট করেছি যুগভেরী সহ আরো কটি পত্রিকায়।শাহরিয়ার ভাই জানতে চাইলেন, নদীভাঙ্গন, লুপকাটিং, বন্যা, স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবিদের সমস্যা ইত্যাদি প্রসঙ্গে। যতটুকু জানি, বললাম। হাসান ভাইয়ের কথায় একজন আমার দেয়া তথ্যগুলো নোট নিচ্ছিলেন। যিনি নোট নিচ্ছিলেন তাঁকে তিনি বললেন, লিখেন/ লিখো স্থানীয় সাংবাদিক গোপেন দেব জানান … । মনে নেই নোটটা কে ঠুকছিলেন ইকবাল ভাই, নাকি হুমায়ুন রশীদ ভাই ! শাহরিয়ার ভাই বললেন, “ তুমি যা বলেছো, আমাদের ধারাবাহিকের এই কিস্তির জন্যে যথেষ্ট তথ্য আছে”। তিনি একটি কার্ড দিলেন, বললেন, ঢাকায় গেলে যেন অবশ্যই দেখা করি। অনেক আলাপ আলোচনার পর তাঁরা বিদায় নিলেন। মনে আছে হবিগন্জ থেকে স্পিডবোটে করে পুলিশের একজন এ এস পি এসেছিলেন মার্কুলী নৌ পুলিশ ফাঁড়ি পরিদর্শনে।এটিতে করেই তাঁরা এসেছিলেন। দুদিন পর ইত্তেফাকে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়,বেশ বড় করেই।ঐ ধারাবাহিকটি ছিল সম্ভবত ‘বৃহত্তর সিলেটের হাওর অঞ্চল : …..’ এরকম শিরোনামে। প্রতিবেদনে আমার দেয়া তথ্যগুলো উল্লেখ করা হয়েছে দেখে ভালো লেগেছে। যদিও প্রতিবেদনের কোথাও আমি ছিলাম না। ( সত্যি বলি, যেহেতু শাহরিয়ার ভাই বলেছিলেন আমাকে উদৃত করে নোট নিতে এবং আমার বক্তব্যও ছাপা হয়েছে সেটিতে, তাই প্রতিবেদনের কোথাও এই অধমের নামটি থাকবে সেই প্রত্যাশা যে ছিল, তা’ কিন্তু অস্বীকার করছি না। এছাড়া সরেজমিন রিপোর্ট/ প্রতিবেদনগুলো সেই এলাকার নানাজনের প্রাসঙ্গিক বক্তব্য/তথ্য উল্লেখ করেই তৈরি হয় বলে জানিও।তবে এতে এতটুকুও মন খারাপ হয়নি আমার, এটুকু স্পষ্টই বলতে পারি।ইত্তেফাক তখন প্রচারে, প্রভাবে, নামে দেশের নাম্বার ওয়ান দৈনিক। এখনকার মতো এতো পত্রিকা ছিল না তখন। যেগুলো ছিল সেসবের নিউজে ‘শব্দ কার্পণ্য’ ছিল চোখে পড়ার মতো ! ছিল মফস্বলের সংবাদের গুরুত্বহীন প্রকাশনা ! একজন কিশোর এবং একেবারেই মফস্বলের এক সংবাদপ্রেরকের নাম ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের কোথায়ও থাকলে ধারাবাহিকের ঐ পর্বটির গুরুত্ব হ্রাস পেতো বলেই হয়তোবা ভেবেছিল্ন সংশ্লিষ্টরা ! কৈশোরেও নামের প্রসঙ্গটি একেবারেই অগুরুত্বপূর্ণ ও ভাবলেশহীন বিষয় মনে হয়েছিল আমার। আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে এলাকার অনেককেই প্রতিবেদনটি দেখাচ্ছিলাম। আমার খুশি বরং নিহিত ছিল এই ভেবে যে, অবহেলিত আমাদের অঞ্চলের সুখদু:খের কথা ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে প্রথম পাতায় এবং তথ্যগুলোর বেশির ভাগই আমার দেয়া – এই বিষয়টির ওপর।) এই ধারাবাহিকগুলো হাসান শাহরিয়ার, মনসুর উদ্দিন ইকবাল ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই তিনজনের নামে ছাপা হয়েছিল। অবশ্য প্রতিবেদনে স্থানীয় চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী চাচা এবং স্থানীয় প্রবীণ চিকিৎসক ডা. আর এম দাসের নাম উল্লেখ ছিল এক দুটি লাইনে। সাক্ষাৎকালে শাহরিয়ার ভাইর স্নেহ ও উৎসাহ আমাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে একথা বলতে পারি। আজ শাহরিয়ার ভাই নেই। আমার এই স্মৃতিচারণাটি হুমায়ুন রশীদ ভাই, ইকবাল ভাই দুজনেরই মনে থাকার কথা।
এরপর, অর্থাৎ বহুদিন পর। পড়াশুনার পাঠ শেষ করে হঠাৎই ঢুকে পড়লাম সিলেটের বহুল প্রচারিত দৈনিক সিলেটের ডাক’এ। নিউজ ডেস্কে কাজ করি। পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সাত্তার ভাই ( মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, বর্তমানে লন্ডনে ), বার্তা সম্পাদক জুবের ভাই ( এনামুল হক জুবের বর্তমানে প্রধান বার্তা সম্পাদক )। তাঁদের তত্বাবধানে একদল উদ্যমী, চৌকষ তরুন সাংবাদিক নিউজ রুমে।ঘটনা দুর্ঘটনার খবর ছাড়াও প্রতিদিনই জাতীয় মানের নানা প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত আমাদের বার্তা কক্ষ।
সালটা হবে ১৯৯৪ কিংবা ৯৫। সুনামগন্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ মহামারী রূপ নিয়েছে। তাহিরপুরের কিছু এলাকায় বিষাক্ত মশার কামড়ে শতশত লোক আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আমাদের তাহিরপুর উপজেলা সংবাদদাতা সফর মল্লিক ( বর্তমানে প্রয়াত ) ও সুনামগন্জ জেলা প্রতিনিধি আইনুল ইসলাম বাবলু নিয়মিত সংবাদ পাঠাচ্ছেন।সাত্তার ভাই ভাবলেন, সংবাদের গুরুত্ব বিবেচনায় একজন স্টাফ রিপোর্টারকে এবিষয়ে এসাইমেন্ট দেয়া দরকার। পড়লো দায়িত্বটা আমার ওপর। সাত্তার ভাই তাঁর রুমে আমাকে সুনামগন্জের ম্যালেরিয়া রিপোর্টিংয়ে বসালেন। প্রতিদিন সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর ছাড়াও টেলিফোনে খবর নিতে হতো তাহিরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সুনামগন্জের জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, স্থানীয় এনজিও কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যের সাথে। প্রতিদিন স্থানীয় ছাড়াও জাতীয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় তিন/চার কলাম জুড়ে সুনামগন্জের ম্যালেরিয়ার খবর। তবে আমাদের পত্রিকা এই নিউজটি কভার করে যাচ্ছিলো সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। ম্যালেরিয়া এবং এই বিশেষ ধরণের প্রাণঘাতি মশা নিয়ে সিলেটের ডাকএ চিকিৎসা বিজ্ঞান ও কীটপতঙ্গ বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শও ছাপা হয়।ম্যালেরিয়ার এই অব্যাহত প্রকোপে আতংকিত উপদ্রুত এলাকা। হাসান শাহরিয়ার ভাই ঢাকা ইত্তেফাক অফিস থেকে টেলিফোন করলেন সাত্তার ভাইর কাছে। তিনি তখনও ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা। তাঁর এলাকা তাহিরপুর। তিনিও খুব বিমর্ষ এসব খবরে। নিজ নামে নিউজ করতে শুরু করলেন সুনামগন্জের ম্যালেরিয়া নিয়ে। আমাদের অফিসে দিনে দুবার ফোন তাঁর।সাত্তার ভাই শাহরিয়ার ভাইকে বলেছিলেন, “গোপেন নিউজ করছে এনিয়ে। আপনি ওর সাথে কথা বলে সরাসরি তথ্য নিতে পারবেন”। এরপর নিয়মিত কথা হতো শাহরিয়ার ভাইর সাথে। শাহরিয়ার ভাই বলতেন, “তুমি তোমার পত্রিকার জন্যে যেটি লিখেছো আমাকে এটিই ফ্যাক্স করে দাও”।( তখন ফ্যাক্সই ছিল )।আমিও সাত্তার ভাইর অনুমতি নিয়ে ফ্যাক্স করে দিতাম। দেখতাম পরদিন সিলেটের ডাক ও ইত্তেফাকএ প্রায় একই নিউজ এসেছে তাহিরপুরের ম্যালেরিয়া নিয়ে। বাইলাইন নিউজ – সিলেটের ডাকএ আমার নামে আর ইত্তেফাকএ হাসান শাহরিয়ারের নামে।একই দিনে দুটি পত্রিকায় অনুরূপ, অবিকল নিউজ ! আমাদের পত্রিকায় বেশ কয়েক সংখ্যাতেই ম্যালেরিয়ার এই খবরগুলো লীড নিউজ হয়।আর ইত্তেফাকেও একদিন লীড হয় এটি। একপর্যায়ে সুনামগন্জের জেলা প্রশাসক ( নাম সম্ভবত কামাল উদ্দীন ) সিলেটে আমাদের অফিসে আসেন এবং জানান, মৃতের সংখ্যা পাঁচ শ’ ছাড়িয়ে গেছে ! ইতোমধ্যে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর দৃষ্টিও পড়েছে এতে। বিবিসি, রয়টার্স’র ঢাকা অফিস থেকে আমাদের নির্বাহী সম্পাদক সাত্তার ভাইর কাছে টেলিফোন আসছে। ম্যালেরিয়া বিষয়ে জানতে চাইলেই সাত্তার ভাই টেলিফোন ধরিয়ে দিতেন আমাকে।
যা হোক।যে কথা বলার জন্যে এত সব লিখা, তাহলো হাসান শাহরিয়ার ভাইয়ের আমার প্রতি সংবাদ সূত্র বিষয়ে বিশ্বস্ততার বিষয়টি। সেই মার্কুলীতেও আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, আমার মতো একজন তরুন, অনভিজ্ঞের কাছ থেকে তথ্য জানতে অনাগ্রহতার বিন্দুমাত্র প্রকাশ ঘটেনি।বহুবছর পরও সংবাদজগতের এই মহীরুহের অনুরূপ ব্যবহার পেয়েছি নিউজ আদান প্রদান করতে গিয়ে।অহংকার, গরিমা বড় সাংবাদিক এরকম মনোভাব তাঁর মাঝে দেখিনি। বরং মফস্বল সাংবাদিকদের উল্টো সম্মান করতেন, আপন ভেবে কাছে নিতেন।তাঁর নিজ এলাকা তাহিরপুর শুধু নয়, সুনামগন্জ ও হবিগন্জের ভাটি অঞ্চল তথা সিলেটের প্রতি তাঁর যে অন্যরকম টান সেটি ইত্তেফাকে তাঁর করা বিশেষ রিপোর্টগুলোর দিকে তাকালেই সবার বোঝার কথা।
হাসান শাহরিয়ার আজীবন সাংবাদিকতায় মগ্ন একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ। দেশের প্রখ্যাত পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদকের পদেই শুধু নয়, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি সহ দেশবিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সম্মানজনক পদে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি।
আমাদের গর্ব শ্রদ্ধেয় হাসান শাহরিয়ার ভাইয়ের পরলোকগমন সংবাদটি বেশ কস্টের।
শাহরিয়ার ভাই শেষ সালাম।
লেখক : মন্ট্রিয়ল প্রবাসী সাংবাদিক