বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। বর্তমানে করোনা মহামারী মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দেশে করোনা সংক্রমণের এক বছর পর আবারও করোনার ভয়াবহ বিস্তার ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মহামারী প্রতিরোধের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন প্রবীণ এই ভাইরোলজিস্ট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : আমাদের দেশে করোনা শনাক্তের এক বছর পার হয়ে গেল। করোনা আবার তার ভয়াল রূপ দেখাচ্ছে। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এতদিন পরেও করোনার গতি-প্রকৃতি ও ব্যাপক বিস্তার রোধ কেন সম্ভব হলো না বলে মনে করছেন?
নজরুল ইসলাম : করোনার বর্তমান গতি-প্রকৃতি নিয়ে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা দেওয়া কঠিন, যদি না আমরা কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে না পাই। গত বছরের মার্চে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। এরপরে মে মাসের দিকে শনাক্তের হার বৃদ্ধি পেয়ে তা ২০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। পরে আগস্টের দিকে করোনা শনাক্তের সংখ্যা কমে এসেছিল। আমাদের দেশে বর্তমানে মৃত্যুর হার ১.৫ বা ১.৬ ভাগ। ইতিমধ্যে দেশে ব্যাপক লোক আক্রান্ত হয়েছে। বেশকিছু মৃত্যুবরণ করেছে। আবার অনেকেই আরোগ্য লাভ করেছে। এতে করে অনেকের মাঝেই অ্যান্টিবডি ডেভেলপ করেছে। এসব ধরে নিয়ে আমরা ভেবেছিলাম, এইবার করোনার বিস্তার কম হবে। কিন্তু দেখা গেল, আমাদের অনুমান মিলল না। করোনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ল। চলতি বছরের মার্চ থেকে করোনা বেড়েই চলেছে। এখন দৈনিক শনাক্ত ২০ ভাগ ছাড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কতজন লোকের প্রকৃত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে সেই তথ্য আমাদের জানা নেই। যেহেতু এসব নিয়ে আমাদের দেশে কোনো গবেষণা নেই, তাই করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী গতি-প্রকৃতি নিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।
আমরা দেখছি, গত জানুয়ারি থেকে করোনার ইউকে ভ্যারাইটি বিশ^ব্যাপী সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আবার আফ্রিকান ভ্যারাইটিও ছড়িয়ে পড়ছে। এসব ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আমাদের হাতে কোনো গবেষণা ফলাফল নেই। তবে আমরা দেখছি, এই নতুন ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের ফলে করোনা বিশ^ব্যাপী ব্যাপকহারে লোকজনকে আক্রান্ত করছে। এই নতুন ভাইরাস যাতে আমাদের দেশে না প্রবেশ করতে পারে সে জন্য আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে এই কাজটি কতটা দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা আমরা জানতে পারছি না। তবে অনেকে মনে করছেন, এইসব ভাইরাস আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে এবং এই নতুন ভাইরাসই দেশে বর্তমানে করোনার এই ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এটাও অনুমান। এটাকে বাস্তবে ধরতে হলে গবেষণা দরকার, সেটি হয়নি।
দেশ রূপান্তর : তাহলে বোঝা যাচ্ছে আমাদের দেশে করোনা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই। তবে করোনা নিয়ে কোনো জরিপ বা তথ্য আছে কি যার মাধ্যমে আসল কারণটা জানা যাবে?
নজরুল ইসলাম : না। তেমন কোনো জরিপও নেই। আইসিডিডিআর একটি স্টাডি করেছিল গত বছরের জুলাই পর্যন্ত। সেই রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল মাসখানেক পরে। তাতে দেখা গেছে বস্তি এলাকায় করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বস্তিবাসীদের মধ্যে অ্যান্টিবডির হার ছিল ৭৪ শতাংশ। আর বস্তি এলাকার বাইরে করোনা শনাক্ত হয়েছিল ৯ শতাংশ এবং অ্যান্টিবডির হার ছিল ৪৫-৪৮ শতাংশ। যদি সেই রিপোর্ট ঠিক হয়, তাহলে তো এতদিনে আরও অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা। তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের সংক্রমণের হার বাড়ছে কেন! এই উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। দেখতে হবে এই অ্যান্টিবডি আসলে কার্যকর অ্যান্টিবডি কি না?
দেশ রূপান্তর : আপনি করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে আমরা দেখলাম সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হলো, আবার ৪ দিন পরেই ৭ দিনের লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হলো, এ বিষয়ে বলুন।
নজরুল ইসলাম : আমাদের জাতীয় পরামর্শক কমিটির মিটিং হয়েছে। সেখানে লকডাউনের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সেখানে আমরা বেশকিছু পরামর্শের কথা বলেছি। যেগুলো ১৮ দফা হিসেবে নির্দেশনায় এসেছে। তবে এগুলো কীভাবে পালন করা হবে সেসব বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। এই নির্দেশনার আওতায় যেসব মন্ত্রণালয় বা দপ্তর আসবে তারা সেটি সমন্বয় করে পালন করার কথা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলোএই যে ১৮টি নির্দেশনা দেওয়া হলো, এখানে একটিতেও রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই। আমাদের দেশে এখন শনাক্ত রোগী এবং মৃতের সংখ্যা দুটোই বাড়ছে। তাই নির্দেশনায় রোগীর চিকিৎসা বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকা দরকার ছিল।
দেশ রূপান্তর : গত কয়েকদিনের করোনা শনাক্তের হার ২০ প্রায় শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতেও দেশে টিকা নেওয়ার হার কমে আসছে দিন দিন। জনসাধারণের মাঝে টিকা নেওয়ার বিষয়ে এক ধরনের অনীহা লক্ষ করা যাচ্ছে। এমনটা হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
নজরুল ইসলাম : আমাদের দেশের লোকজনের মনস্তত্ত্ব খুবই জটিল। কখনো দেখা যায়, তারা ভয় পায়। আবার দেখা যায়, কেউ বিষয়টাকে আমলেই নিচ্ছে না। আবার এক ধরনের লোক আছেন, তারা করোনাকে বিশ্বাসই করে না। আবার আরেক শ্রেণির মানুষ রয়েছে, তারা বলে, আমাদের করোনা হবে না। করোনা বড়লোকদের হয়! আবার কিছু কিছু লোক আছে, বলে যা করার আল্লাহ করবে, তোমরা এসব নিয়ে মাথা ঘামাও কেন! এই ধরনের একটি জটিল ও মিশ্র মনোভাবের জনসাধারণের দেশ আমরা। এদের মোকাবিলা করা কঠিন। তবু সরকার যদি কঠোর হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ভলান্টিয়ার সবাই মিলে যদি মাস্ক পরিধান করা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা এসব বিষয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করে তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হতে পারে। এছাড়া জনসাধারণের মাঝে গিয়ে তাদের বোঝানো এবং যারা কথা শুনতে চায় না, তাদের লঘু শাস্তি দিয়ে নিয়মের মধ্যে আনা যেতে পারে।
দেশ রূপান্তর : দেশে করোনা শনাক্তের এক বছর পেরিয়ে গেলেও রোগীদের চিকৎসায় এখনো নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই। হাসপাতালে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সেই রোগী মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও পত্রিকায় উঠে এসেছে। করোনা মোকাবিলায় এক বছরের অভিজ্ঞতার পরও হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থা করতে না পারার অবস্থা তৈরি হলো কেন দেশে? বিশেষ করে, বাজেটে করোনার চিকিৎসার জন্য বিশেষ অর্থ বরাদ্দের পরেও এই পরিস্থিতির দায় কার?
নজরুল ইসলাম : রোগীদের জন্য চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে না পারা মানে কী! আমরা করিনি। তাই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত বছরের জুন মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি ঘোষণায় নির্দেশনা দিয়েছিলেন, জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে হবে। কয়টি জেলায় তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে? আমি খোঁজ নিয়েছি, মাত্র ২৮টি জেলায় তা করা হয়েছে। বাকিগুলোয় কেন এখনো করা গেল না! দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নিজেরা তো করছেই না, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরেও তা হচ্ছে না। অথচ, দশ হাজার কোটি টাকা এই করোনার জন্য বরাদ্দ করা আছে।
দেশ রূপান্তর : সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, আপনারা পরামর্শ দিচ্ছেন, তবুও এমনটা কেন হচ্ছে বলে আপনার ধারণা? এখানে ফাঁক ও ফাঁকিটা কোথায়? নাকি অনীহা?
নজরুল ইসলাম : এখানে প্রধান ভূমিকা পালন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তার সঙ্গে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা সংস্থা সহায়তা করবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই করোনা পরিস্থিতিতে একটি অকার্যকর মন্ত্রণালয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত বছরে আমরা বিপর্যস্ত হয়েছিলাম, সেটি প্রথম বছর হিসেবে আমরা হতে পারি। কিন্তু এ বছর আমরা কেন হচ্ছি? এসবের কৈফিয়ত তো দিতে হবে। তা না করলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো অকার্যকর মন্ত্রণালয় হিসেবেই থাকবে। দেশের একটি উচ্চ সংক্রমণ জেলায় আইসিইউ নেই। বাধ্য হয়ে রোগীকে ঢাকায় পাঠাতে হচ্ছে। আর ঢাকার অবস্থা তো গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানাই আছে। জেলারটা হয়তো অতটা পাওয়া যায় না। এতে করে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নইলে মৃত্যু কমানো যাবে না। আমি বলব যে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে যারা আছেন অনিচ্ছুক শ্রমিক। ‘আন উইলিং ওয়ার্কার’ দিয়ে কি কোনো কাজ হয়!
দেশ রূপান্তর : করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। এছাড়া ব্যাংকারদেরও সেই ক্যাটাগরিতে রাখা হয়েছিল। সেগুলোর বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে?
নজরুল ইসলাম : কীসের বাস্তবায়ন! আমি শুনেছি কেবল একজনের ক্ষেত্রে তা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানেও একটি অকার্যকর ব্যবস্থা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর : এই করোনা পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি? আমাদের করণীয় কী?
নজরুল ইসলাম : এখন জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। জনসাধারণের কাছ থেকে যদি সহযোগিতা পাওয়া না যায়, তবে সরকারকে কঠোর থেকে কঠোর হতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করতে হবে। আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : করোনা মোকাবিলায় সরকারের লকডাউন নিয়ে আপনার অভিমত কী?
নজরুল ইসলাম : লকডাউন মানে হচ্ছে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া। যার বাসায় বাজার নেই, তার বাসায় কি আমরা খাবার পৌঁছে দিতে পারব? পারব না। বিদেশের মতো লকডাউন আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা কঠিন। লকডাউন বাস্তবায়নের মতো আর্থিক সক্ষমতা আমাদের নেই। যদি কিছুটা মোডিফায়েড লকডাউন করা যায়, সেটি বাস্তবায়ন করলে হয়তো সুফল পাওয়া যেতে পারে। একজন আক্রান্ত হলে, তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারের বাকি সদস্যদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে আইসোলেশনে রাখতে হবে। এভাবে দরকার হলে একটি বাড়িকে বা মহল্লাকে লকডাউন করা যেতে পারে। কিন্তু পুরো দেশকে একসঙ্গে লকডাউন করার সক্ষমতা আমাদের নেই।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ। এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য।
নজরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সৌজন্যে : দেশ রূপান্তর