ফারুক মঈনউদ্দীন: |
পাঠকের আনুগত্য ও আকর্ষণ কেবল লেখকের সৃষ্টিকর্মের মান ও উৎকর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তার জীবনাচার ও বিচিত্র বহুমুখী কর্মকাণ্ড ও পালন করতে পারে একটা বড় ভূমিকা। কারণ, লেখকসত্তা কেবল লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি লেখকের জীবন ও সৃষ্টির ওপর যেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তেমনই পারে পাঠকের অন্তর্গত কৌতূহল ও আকর্ষণকে আনুগত্যের নিগড়ে বাঁধতে। নন্দিত ও নিন্দিত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ছিলেন তেমনই একজন, যিনি জীবদ্দশায় দুটো বিশ্বযুদ্ধ, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ এবং চীন-জাপান যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। যুদ্ধ ছাড়াও তার আকর্ষণ ছিল শিকার, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা, মুষ্টিযুদ্ধ, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি। পঞ্চান্ন বছরের যাপিত জীবনে সফল প্রেমের পর একাদিক্রমে চার স্ত্রীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক ছাড়াও বহু নারীর সঙ্গে ছিল তার গোপন ও প্রকাশ্য প্রেমসুলভ সম্পর্ক। মূলত শৈশবে মায়ের কর্তৃত্বব্যঞ্জক অভিজ্ঞতার তিক্ত স্মৃতি তার পরবর্তী জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, যা তাকে করে তুলেছিল জেদি, আত্মম্ভরী ও স্বেচ্ছাচারী।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দারুণভাবে আসক্ত ছিলেন স্পেনের ঐতিহ্যবাহী বিপজ্জনক খেলা বুলফাইটিংয়ের প্রতি। প্রাণঘাতী এই খেলাটিকে তিনি শিল্পের মর্যাদা দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, এটি সম্পর্কে ভাবতে হলে বিষয়টিকে দেখতে হবে ‘বুলফাইটার কিংবা দর্শকদের অবস্থান থেকে। মৃত্যুর ব্যাপারটাই মূলত সব সংশয়ের সৃষ্টি করে। বুলফাইটিং হচ্ছে একমাত্র শিল্প, যেখানে শিল্পী থাকে মৃত্যু ঝুঁকিতে আর ক্রীড়াকৌশলের নৈপুণ্যের মাত্রাটা ছেড়ে দেওয়া হয় যোদ্ধার মর্যাদার ওপর।’ [ডেথ ইন দ্য আফটারনুন]। বিয়ের দুই বছর পর প্রথম স্ত্রী হ্যাডলিকে নিয়ে বিখ্যাত বুলফাইটিং উৎসবে যোগ দিতে স্পেনের প্যাম্পলোনা গিয়েছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য, এই বিষয়ের ওপর একটা বই লেখা। তার মতে বুলফাইটিং হচ্ছে একমাত্র বিষয়, যেখানে জীবন ও মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ততদিনে, তাই সহিংস মৃত্যু দেখার একমাত্র জায়গা হচ্ছে বুল রিং। এই সহজতম বিষয় দিয়ে শুরু করে লেখালেখি শেখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তার মতে, লেখার জন্য সবচেয়ে সহজ এবং মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সহিংস মৃত্যু। এটির মধ্যে রোগে ভুগে মৃত্যু কিংবা তথাকথিত স্বাভাবিক মৃত্যু, অথবা কোনো বন্ধু কিংবা ভালোবাসার বা ঘৃণার কারও মৃত্যুর মতো কোনো জটিলতা নেই, তবুও এটি মৃত্যুই, মানুষ যা নিয়ে লিখতে পারে এমন বিষয়গুলোর একটি। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, স্বাভাবিক মৃত্যুকে লেখার যোগ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেননি হেমিংওয়ে, তার উদ্দিষ্ট বিষয় সহিংস মৃত্যু, যা মূলত হত্যাকাণ্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যখন লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন, তিনি উপলব্ধি করেন যে যুদ্ধই হচ্ছে লেখার উৎকৃষ্ট বিষয়। কারণ, এটা সব ধরনের বিষয়কে একসঙ্গে জড়ো করে লেখার কাজটিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যায় এবং এমন সব জিনিস বের করে আনে, যা পাওয়ার জন্য একজন লেখককে সারাজীবন অপেক্ষা করতে হয়।
লিখতে শেখা কিংবা বুলফাইটিং নিয়ে লেখা- উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন প্যারিসপ্রবাসী একদল আমেরিকান ও ব্রিটিশ ইয়ারবন্ধুর সঙ্গে পরের বছর আবারও স্পেনের প্যাম্পলোনায় বুলফাইটিং উৎসবে গিয়েছিলেন আর্নেস্ট। সেখানে সপ্তাহখানেক ফুর্তিতে মেতে থাকার পর অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে এই বিষয় নিয়ে আস্ত একখানা উপন্যাসই লিখে ফেলা যায়। এভাবেই লেখা হয় দ্য সান অলসো রাইজেস উপন্যাসটি। উল্লেখ্য, শুরু করার সময় উপন্যাসটির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ফিয়েস্তা,’ শেষ করার পর সেটি বদলে করেন ‘দ্য লস্ট জেনারেশন’।
‘লস্ট জেনারেশন’ তথা অবক্ষয়িত প্রজন্ম অভিধাটি আর্নেস্ট পেয়েছিলেন প্যারিস প্রবাসী আমেরিকান ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার ও শিল্প-সংগ্রাহক গারট্রুড স্টাইনের কাছ থেকে, আর স্টাইন এটি প্রথম শোনেন প্যারিসে তার গাড়ি সারাইয়ের গ্যারাজ মালিকের কাছে। সেই গ্যারাজে সারাই করার অপেক্ষায় থাকা অন্য গাড়ির সারি ভেঙে স্টাইনের গাড়ি সারাই করতে রাজি না হওয়ার কারণে মালিক তার তরুণ মেকানিককে ভর্ৎসনা করেছিলেন জেনেরাসিঁও পেরদু বা লস্ট জেনারেশন বলে। লাখ লাখ অর্থহীন মৃত্যুর ভেতর দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে তখনকার তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একধরনের অবক্ষয় বাসা বেঁধেছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঔদ্ধত্যও। ফলে স্বাভাবিক জীবনের মূল্যবোধগুলোও তাদের কাছে অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর তরুণ প্রজন্মটির মধ্যে হতাশার পাশাপাশি ভর করে উদ্দেশ্যহীন লাগামছাড়া জীবনযাত্রার মোহ। যারা দ্য সান অলসো রাইজেস উপন্যাসটির মধ্যে এই অবক্ষয়িত প্রজন্মের উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলেন, হেমিংওয়ে আসলে বোধ হয় এই অপবাদটিকে নাকচ করতে চেয়েছেন।
তবে আপত্তিকর বিষয় ছিল, উপন্যাসটির বিভিন্ন চরিত্রের আড়ালে পরিচিত সফরসঙ্গীদের হেমিংওয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে, সেটিকে আর আড়াল বলার উপায় ছিল না, কারণ, চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের মানুষগুলোর মিল ছিল অবিশ্বাস্যরকম খোলামেলা। যেসব বাস্তব চরিত্রের ওপর উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে চাপানো হয়েছিল তাদের কেউ কেউ এটিকে উপন্যাস বলে চালানো হচ্ছে দেখে সবিশেষ অবাক হয়েছিলেন। অনেকেই এটিকে সংবাদপত্রের রিপোর্টের চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে চাননি। উপন্যাসের ব্রেট অ্যাশলি চরিত্রের পেছনের নারীটি এই উপন্যাস পড়ার পর হতভম্ব হয়ে এটাকে ‘নিষ্ঠুর,’ ‘সস্তা রিপোর্টিং’ ও হেমিংওয়ের ‘নোংরা কৌশল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
এই লেখকের ছাত্রাবস্থায় আবুল ফজলের অনুবাদে [তবুও সূর্য ওঠে] উপন্যাসটি যখন পড়ার সুযোগ হয়, তখনও হেমিংওয়ের পড়া প্রথম বই হিসেবে এটির নেপথ্য কথা কিংবা বিরূপ সমালোচনার বিষয়ে কোনো কিছু জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলো জানার পরও কেবল চরিত্রচিত্রণের দুর্বলতার কারণে উপন্যাসটিকে খারিজ করার সংগত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহু পরে জানা যায়, বইটির খসড়াতে ঘষামাজা করার কাজে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন বন্ধু লেখক স্কট ফিটজেরাল্ড। খসড়াটি পড়ে ফিটজেরাল্ড মন্তব্য করেছিলেন যে বইটির চব্বিশ জায়গায় বিদ্রুপ, টিটকারি, টেক্কা দেওয়া এবং তীব্র অবজ্ঞা রয়েছে, যা বাদ দেওয়া উচিত। কারণ, সেসব অপ্রাসঙ্গিক এবং উপন্যাসটির দুর্বলতম অংশ। হেমিংওয়ে তার পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন। অবশ্য তিনি যখন লেখক হিসেবে আরও সফলতা লাভ করেন, সে সময় এরকম কোনো পরামর্শ তিনি মেনে নিতেন কিনা সন্দেহ আছে।
পরবর্তী সময় হেমিংওয়ের যে বইটির অনুবাদ এই লেখকের হাতে আসে সেটি তার তৃতীয় উপন্যাস অ্যা ফেয়ারওয়েল টু আর্মস-এর অনুবাদ, ‘আর যুদ্ধ নয়।’ উপন্যাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত লেফটেন্যান্ট হেনরির সঙ্গে হাসপাতালের নার্স ক্যাথেরিনের মধ্যে তীব্র ভালোবাসা জন্মায় এবং একপর্যায়ে ক্যাথেরিন অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসব না হওয়ার কারণে সিজারিয়ান করলে দেখা যায় বাচ্চাটা গর্ভেই মারা গিয়েছিল। পরে অত্যধিক রক্তক্ষরণে ক্যাথেরিনও মারা যায়। এই লেখকের তখনও জানা ছিল না, যুদ্ধে আহত হয়ে ইতালির হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর নার্স অ্যাগনেস কুরোওস্কির সঙ্গে হেমিংওয়ে নিজের প্রেমকাহিনি তুলে এনেছেন এই উপন্যাসে। তখনও জানা ছিল না দ্বিতীয় স্ত্রী পলিনের প্রথম সন্তান প্যাট্রিকের জন্মের সময় প্রসবকালীন জটিলতায় প্রাণ সংশয়ের ঘটনাটাই উপন্যাসে তুলে এনেছিলেন হেমিংওয়ে।
এই দুটো উপন্যাস পড়ে হেমিংওয়ের প্রতি আকর্ষণ জন্মানোর বিশেষ কোনো কারণ নেই। পরবর্তী সময়ে তার মরণোত্তর প্রকাশিত স্মৃতিকথা অ্যা মুভেবল ফিস্ট পড়ার পর বৈচিত্র্যময় এই লেখকের জীবনের মধ্যে আরেকটি জীবনকে খুঁজে পাওয়া যায়। টুকরো টুকরো বিশটি পর্বে আর্নেস্ট তার যৌবনের দারিদ্র্যপীড়িত প্যারিসজীবনের যে চিত্র এঁকেছিলেন, সেটি যেকোনো পাঠককে গভীরভাবে নাড়া দিতে সক্ষম। লেখালেখির জগতে নতুন প্রবেশ করা এই নবীন লেখকের অনুশীলন ও সংগ্রাম, সমসাময়িক ও বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদের সম্পর্কে অনুকূল ও বিরূপ মূল্যায়ন ও স্মৃতি- সবকিছুই তার একটি নতুন পরিচিতি উন্মোচিত করে দেয় বলে আমাদের নবীন লেখকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য বর্তমান লেখক বইটি চলমান ভোজের শহর নামে বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তবে কারও মতে, বইটির মধ্যে বহু ভালো উপাদান থাকা সত্ত্বেও এটিতে প্রকাশ পেয়েছে লেখকের আত্মকেন্দ্রিকতা, দম্ভ, আত্মরতি, অতিশয়োক্তি ও লোকদেখানো পৌরুষ। কেবল এই বইটির প্রতিক্রিয়াই নয়, তাঁর জীবনীকারদের কারও মূল্যায়নেও লেখকজীবনের শুরু থেকেই হেমিংওয়ের জীবনের বহু নেতিবাচক দিক উঠে এসেছে। যেমন, ‘ভেতরে-ভেতরে যদিও প্যারিসজীবন ওক পার্কের যুবকটিকে বদলে দিয়েছিল; অহংতাড়িত হয়ে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক পরিম লের স্থূল প্রতিযোগিতায় এবং একই সঙ্গে নিজেকে আবিস্কার করেন একটা প্রলুব্ধকর ভালোবাসার সম্ভাবনায়। … সদা উদ্ধত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হেমিংওয়ে ১৯২০-এর মাঝামাঝি হয়ে পড়েন আত্মনিমগ্ন ও পেশা-অভিলাষী, তার দৃষ্টিতে কিছুটা মাতৃসুলভ হয়ে ওঠা এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে বিয়ের জোয়ালে আটকে পড়া অধৈর্য এক যুবককে। হ্যাডলিকে ভালোবাসতেন তিনি, কিন্তু উপভোগ করতেন যৌন আবেদনময়ী চটকদার নারীদের মনোযোগও। এসকোয়ার পত্রিকায় হেমিংওয়ে যখন ‘মিসট্রেসের’ কথা লেখেন, যার বয়স নিয়ে তার বিরক্তি ছিল, প্রচ্ছন্নভাবে প্রথম স্ত্রীর আনুগত্যহীনতার প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি।’ [জে জেরাল্ড কেনেডি, হেমিংওয়ে, হ্যাডলি অ্যান্ড প্যারিস :দ্য পারসিসটেন্স অভ ডিজায়ার]
হেমিংওয়ের প্রতি এই লেখকের আকর্ষণের পেছনের নানাবিধ কারণ স্বল্প পরিসরে ব্যাখ্যা করা কঠিন ও অসম্ভব। ব্যক্তিজীবনের বহু খামতি থাকলেও তার বইগুলো বিষয় ও শৈলীর কারণে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠকের কাছে ব্যাপক সমাদর পেয়েছিল। যেমন ফর হুম দ্য বেল টোলস উপন্যাসে গেরিলা যুদ্ধের কিছু কৌশল বর্ণিত হয়েছিল বলে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ভিয়েতনামি স্বেচ্ছাসেবকদের কেউ কেউ এটাকে হাতের কাছে রাখতেন। এমনকি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও তার সামরিক অভ্যুত্থানের প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা হিসেবে বইটি ব্যবহার করেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে প্যারিসে ঢোকার প্রাক্কালে একটা স্থানীয় প্রতিরোধ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া, অস্ত্র বহন করাসহ সমর সাংবাদিকদের জন্য প্রণীত জেনেভা কনভেনশনের নীতিমালা ভঙ্গ করার কারণে হেমিংওয়ের কোর্ট মার্শাল হতে যাচ্ছিল। অবশ্য শেষাবধি তার লেখকখ্যাতি বিবেচনা করে আমেরিকান সামরিক কর্তৃপক্ষ অভিযোগগুলো তুলে নেয়। পরবর্তী সময়ে [১৯৫১] নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিজের সে সময়কার ভূমিকার সমর্থনে তিনি লিখেছিলেন, ‘গেরিলাযুদ্ধ এবং প্রথাবিহীন যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আমার কিছু জ্ঞান ছিল, সঙ্গে প্রচলিত যুদ্ধের মৌলিক উপাদান সম্পর্কে পরিপূর্ণ শিক্ষাও। আমার ক্ষমতার মধ্যে যে কোনো কিছু করার জন্য কেউ আমাকে যদি কোনো দায়িত্ব দেয় কিংবা ব্যবহার করতে চায়, আমি স্বেচ্ছায় খুশিমনে করতে ইচ্ছুক।’ এরকম আত্মবিশ্বাস ও সাহসই হেমিংওয়েকে চালিত করেছে বিভিন্ন দুঃসাহসী কাজে, সেটি যুদ্ধ, শিকার কিংবা পরকীয়া প্রেম- যা-ই হোক না কেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে নিজে আহত হয়েও সহযোদ্ধার জীবনরক্ষা, আফ্রিকান সাফারিতে বন্যপ্রাণী শিকার, স্পেনে ষাঁড়ের লড়াই কিংবা গভীর সমুদ্রে নিজের মাছধরা বোট নিয়ে জার্মান সাবমেরিন খুঁজে বেড়ানো- সবখানেই তার এই স্পর্ধা ও দুঃসাহসের পরিচয় মেলে।
লেখক হেমিংওয়ে এবং মানুষ হেমিংওয়ের বিষয়ে একটা প্রচলিত ধারণা ছিল যে, তিনি মৃত্যুভয়কে জয় করা সত্যিকার পুরুষালি একজন। লেখকসত্তার বাইরে তার প্রমোদমগ্ন প্রাণবন্ত বৈশিষ্ট্যে আকৃষ্ট হতো সবাই। আমাদের স্মরণে আছে সাহিত্যজগতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বাসনায় তিনি যখন প্যারিসে আসেন, সেখানকার অভিবাসী লেখকমহলের প্রায় সবাই তার তারুণ্যের চ্ছটায় আকৃষ্ট হয়ে কাছে টেনে নিয়েছিলেন তাকে। নানানভাবে সহায়তা করেছেন এজরা পাউন্ড, গারট্রুড স্টাইন, শেরউড এন্ডারসন, জেমস জয়েস প্রমুখ বয়োজ্যেষ্ঠ লেখক। এমনকি ‘শেকসপিয়ার অ্যান্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাত্রী সিলভিয়া বিচও যথেষ্ট সহায়তা করেছেন তাকে। সিলভিয়ার আনুকূল্যে ও পরামর্শে তার রেন্টাল লাইব্রেরি থেকে ভাড়ায় বই এনে পড়ার সুযোগ না পেলে হেমিংওয়ের পঠনপ্রক্রিয়ার ভিত গড়ে ওঠা কঠিন হতো। লেখালেখি শুরু করার প্রথম দিকে বিভিন্ন কাগজে পাঠানো তার গল্পগুলো অমনোনীত হয়ে যখন ফেরত আসছিল, তিনি দমে যাননি, দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে কখনও ক্ষুধার্ত অবস্থায়ও লিখে গিয়েছেন, লেখকজীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টায় কখনই বিরাম দেননি। এই অধ্যবসায়ের ফল অচিরেই পেতে শুরু করেছিলেন তিনি। পরিণত বয়সেও হেমিংওয়ে তার পুরুষালি ব্যক্তিত্ব দিয়ে বহু নারীর হৃদয় হরণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ করা উচিত, প্যারিসে প্রবাসী আমেরিকান চিত্রকর জেরাল্ড মারফির স্ত্রী সারাহ প্রথম থেকেই হেমিংওয়েকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। তার শৈল্পিক সংবেদনশীলতা, পুরুষালি তেজ- এসবই সারাহকে প্রণয়াভিলাষী করে তুলেছিল। স্বেচ্ছামৃত্যুর আগে আর্নেস্ট অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সারাহ এক চিঠিতে তাকে লিখেছিলেন, ‘অসুস্থ হওয়াটা আপনার সঙ্গে যায় না-সব সময়ের মতো-বন্দুক হাতে অথবা বোটের ওপর-দাড়িওয়ালা মজবুত এক যুবক হিসেবে-আপনার ছবি তুলতে চাই আমি…।’ [আমান্দা ভেইল]
তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ইন আওয়ার টাইম প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, পরের বছরেই বইটার একটা পরিবর্ধিত সংস্করণ বের হয়। বইটি খুব দীনহীনভাবে হাতে চালানো প্রেসে ছাপা হয়েছিল মাত্র তিনশ কপি, তার অর্ধেকেরও বেশি বই উপহার হিসেবে বিভিন্নজনকে মুফতে বিলাতে হয়েছিল। সমালোচক মহলে বইটি অনুকূল সাড়া লাভ করতে সক্ষম হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস ও টাইম উভয় কাগজের আলোচনায় মন্তব্য করা হয় যে গল্পগুলোর মধ্যে নতুনত্বের সন্ধান পাওয়া গেছে, জীবনের এক নতুন সাহিত্যিক অনুলিপিকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন হেমিংওয়ে। ফিটজেরাল্ডও তার আলোচনায় হেমিংওয়েকে প্রতিশ্রুতিশীল এবং আমেরিকান কথাসাহিত্যে নতুন কিছু যোগ করেছেন বলে প্রশংসা করেন। অন্যদিকে হেমিংওয়ের বাবা-মা ছেলের বইটি পড়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলেন। প্রকাশকের তরফ থেকে তাদের কাছে পাঠানো বইগুলো ফিরিয়ে দিয়ে হেমিংওয়ের বাবা ডা. ক্ল্যারেন্স জানান, এ ধরনের নোংরা কিছু তার ঘরে রাখা যাবে না। অ্যা ভেরি শর্ট স্টোরি নামের গল্পটিতে ট্যাক্সিক্যাবের মধ্যে এক সেলসগার্লের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মিলনে এক সৈনিকের গনোরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অংশটির প্রতি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল তার অভিযোগের ভেতর। তার পরিবারের বাইরে কোনো কোনো পাঠকের কাছেও বইটির অমার্জিত ভাষা ও বিষয়, রাখঢাকহীন বর্ণনাভঙ্গি আপত্তিকর মনে হয়েছে। আবার কিছু পাঠকের কাছে গল্পগুলোর নতুনত্ব, বিষয় ও গদ্যশৈলীই ছিল বেশি আকর্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের বইগুলো আরও পাঠকপ্রিয় এবং বাণিজ্যসফল হয়েছিল বলে এ বইটি আড়ালে চলে যায়। এভাবে প্রথম বই থেকেই হেমিংওয়ের একটা মিশ্র ভাবমূর্তি তৈরি হয়, যা আমৃত্যু বজায় ছিল।
লেখালেখির জগতে প্রবেশের সময় থেকে শুরু করে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত হেমিংওয়ে কাটিয়ে গেছেন একটা উদ্দাম জীবন। একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত জীবনে তার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি উভয়ই ছিল। প্রেম ছিল, পরিণতি ছিল না। প্রাপ্তি ছিল, স্থিরতা ছিল না। বন্ধুভাগ্য ছিল, সংহতি ছিল না। খ্যাতি যেমন তার কাছে ধরা দিয়েছে, অখ্যাতিও তাড়া করেছে শেষ বয়স পর্যন্ত। এক সময়ের সুহৃদ ও কাছের মানুষেরা পরবর্তী সময়ে তার আত্মম্ভরী ও অসহিষ্ণু আচরণে দুঃখ পেয়ে দূরে সরে গেছেন, কিন্তু তিনি টলেননি। লেখক হওয়ার যে ব্রত নিয়ে প্যারিসে বসবাস করা শুরু করেছিলেন, সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে শেষাবধি চূড়ান্ত উদ্দিষ্টে পৌঁছাতে পেরেছিলেন হেমিংওয়ে। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবনকালে চারটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করে লেখকখ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন যে লেখার উপজীব্য হিসেবে যুদ্ধ সম্পর্কিত তার ধারণাটাই সঠিক। যদিও যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তার মাথায় ঢুকিয়েছিলেন তৃতীয় স্ত্রী মার্থা গেলহর্ন।
তার জীবনের অন্তিম পরিণতিটা করুণ বলে মনে হলেও আর্নেস্ট হয়তো আত্মঘাতী হয়ে তার নিজস্ব জীবনদর্শন অনুযায়ী সঠিক কাজটিই করেছিলেন। দীর্ঘ দশ বছরের নিষ্ফম্ফলা সময়ের পর লেখা শেষ উপন্যাসটি তাকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল, তার পর তিনি আদৌ আর কিছু করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে হয়তো তার সংশয় ছিল। তাই তিনি পরাজিত হতে চাননি, শেষ উপন্যাসেও কথাটা বলে গেছেন তিনি, ‘মানুষ পরাজিত হওয়ার জন্য জন্মায়নি। মানুষকে ধ্বংস করা যায়, কিন্তু পরাজিত করা যায় না।’