আরিফুজ্জামান তুহিন:দেশে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে যে খাতে ভারতে গড় ব্যয় ৯৩ লাখ টাকা, সেখানে একই ধরনের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে বাংলাদেশে খরচ হয় ৮ থেকে ২৯ কোটি টাকা পর্যন্ত। দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ ও তা দেখভালের দায়িত্বে থাকা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) থেকে ব্যয়ের এ হিসাব পাওয়া গেছে। পিজিসিবির সঞ্চালন লাইন নির্মাণে অস্বাভাবিক এ খরচের জন্য দুর্নীতি দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আর শুধু বিদ্যুৎ খাতই নয়, দেশের অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পেরও বাস্তবায়ন ব্যয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চেয়ে তুলনামূলক অনেক বেশি। এর পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো দেশে জমির মূল্য বেশি হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। তবে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য যে টাওয়ার স্থাপন করা হয় তার জন্য জমির মালিককে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয় না সরকার।
ভারতের সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে হাইভোল্টেজ ডিরেক্ট কারেন্ট (এইচভিডিসি), ৪০০ কেভি ডাবল ও সিঙ্গেল সার্কিট, ২২০ কেভি ডাবল ও সিঙ্গেল সার্কিট এবং ১৩২ কেভি ডাবল ও সিঙ্গেল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের গড় নির্মাণ ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে ৯৪ লাখ টাকা। সেখানে দেশের ১০টি প্রকল্পের গড় ব্যয় বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কিলোমিটারপ্রতি সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ পড়েছে ১২ কোটি টাকা।
ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে সরকার। এর মধ্যে দেশটির পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসছে ১ হাজার মেগাওয়াট। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার দূরত্ব ১০১ কিলোমিটার। ৪০০ কেভির এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণসহ ভেড়ামারাতে একটি এইচভিডিসি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণে খরচ পড়েছে ১১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ কেন্দ্র দিয়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা যাবে। এটির ঠিক বছর চারেক আগেই সরকার আরেকটি এইচভিডিসি উপকেন্দ্র করে একই জায়গাতে, তখনো একইরকম খরচ হয়েছিল। সে কেন্দ্র দিয়ে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছিল বাংলাদেশ। প্রথম যখন ৫০০ মেগাওয়াটের এইচভিডিসি উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয় ভেড়ামারাতে, তখনই পরিকল্পনা ছিল ভারত থেকে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনা হবে। অথচ ওই সময় যদি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হতো তাহলে দ্বিতীয়বার উপকেন্দ্র নির্মাণের দরকার হতো না। বাংলাদেশে দুটি এইচভিডিসি উপকেন্দ্রই জার্মানির সিমেন্স স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশে ৫০০ মেগাওয়াট করে দুটি এইচভিডিসি উপকেন্দ্র এবং ১০১ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প নিয়ে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এতে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আনতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়েছে ২৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর এ কেন্দ্র দিয়ে যদি আগামীতে আরও বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করতে হয় তাহলে ফের ১ হাজার ৫০০ কোটি খরচ করে একটি এইচভিডিসি উপকেন্দ্র করতে হবে, তাতে খরচ আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়ার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে তার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ : পাবনার রূপপুর থেকে গোপালগঞ্জে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১০ হাজার ৯৮২ কোটি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ দেশের ১৩টি স্থানে সঞ্চালন করা হবে। এতে ৬০৯ কিলোমিটার ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন স্থাপন করা হবে। প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৩ লাখ টাকা। ভারতের এক্সিম ব্যাংকের ঋণে এটি বাস্তবায়িত হবে। ঋণের শর্ত হিসেবে এ কাজটি ভারতের এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠান পাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গোপালগঞ্জ থেকে মোংলা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার ৪০০ কিলো ভোল্ট (কেভি) সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৬৬০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়েছে ৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারতের কল্পতরু পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিমিটেডের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে পিজিসিবি। কাজটির চুক্তিমূল্য ৬৬০ কোটি টাকা।
রাজধানীর উপকণ্ঠে আমিনবাজার হতে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর চীনের সেপকো এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড যৌথভাবে ৫৬২ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়।
নির্মাণাধীন মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে ১৭ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হচ্ছে ৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা। লাইনটি নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কল্পতরু পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিমিটেডকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে মেঘনাঘাট-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি ২১৪ কিলোমিটার বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে চুক্তি সই হয়। এ কাজটি পেয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি। ওই দরপত্রে আর কেউ অংশ নেয়নি। কিলোমিটারপ্রতি ৮ কোটি টাকা ব্যয় পড়ছে। মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট ৪০০ কেভি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে চুক্তি সই হয়েছে। ৯২ কিলোমিটারের এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে ব্যয় হবে ৭৯৫ কোটি টাকা। লাইনটি নির্মাণ করবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান কেইসি ইন্টারন্যাশনাল। প্রতি কিলোমিটার লাইন নির্মাণে ব্যয় হবে ৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
ভারতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ : ভারতের সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ৫০০ কেভির এইচভিডিসি প্রতি কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণে খরচ হয় ১ কোটি ৫৮ লাখ রুপি। আর ৮০০ কেভির এইচভিডিসি প্রতি কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন খরচ পড়ে ৩ কোটি ৪৬ লাখ রুপি। ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটার খরচ ১ কোটি ৩৫ লাখ রুপি, একই ভোল্টের সিঙ্গেল সার্কিটের প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৮৮ লাখ রুপি। ২২০ কেভি ডাবল সার্কিটে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৫৬ লাখ আর একই কেভির সিঙ্গেল সার্কিটের নির্মাণ ব্যয় ৩৫ লাখ রুপি। এছাড়া ১৩২ কেভির ডাবল সার্কিটের লাইন নির্মাণ ব্যয় ৪৪ লাখ আর একই কেভির সিঙ্গেল সার্কিটের ব্যয় ২৮ লাখ রুপি।
পিজিসিবির সঞ্চালন লাইন নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের অন্য প্রকল্পে ব্যয় বেশির কারণ হিসেবে দেশে জমির দাম বেশিকে দায়ী করা হয়। কিন্তু পিজিসিবির টাওয়ার নির্মাণের জন্য মানুষকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। দুর্নীতি ছাড়া আমরা এ ব্যয় বেশির অন্য কোনো কারণ দেখছি না।’উৎস:দেশ রুপান্তর