পি কে হালদারের টাকায় ঘনিষ্ঠ বান্ধবীসহ ঋণ জালিয়াতির সহযোগীরা বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণ করতেন। এর মধ্যে দুজন বান্ধবীর প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিল—অবন্তিকা ও নাহিদা রুনাই। এ দুই বান্ধবীকে নিয়ে পৃথকভাবে পি কে হালদার অন্তত ২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেন। অবন্তিকা আর রুনাই এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন যে একজন চালাতেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, অন্যজন চালাতেন পিপলস লিজিং। এই দুজনের কথায় হতো লিজিং কম্পানি দুটির ঋণ বিতরণ। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় আদালতে দায় স্বীকার করে পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দীর ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। গত সোমবার ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
রিমান্ড শেষে এদিন আসামি উজ্জ্বল কুমারকে আদালতে হাজির করলে তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন। আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, ‘পি কে হালদার বিভিন্ন সময় আমাকে বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণে পাঠাতেন। তাঁর সঙ্গে তিনবার মালয়েশিয়ায় গিয়েছি। আমার সঙ্গে অমিতাভ অধিকারী, রাজীব সোমও মালয়েশিয়ায় যায়। একবার যাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। প্রতিবারই ভ্রমণের সব খরচ দিয়েছেন পি কে হালদার।’
জবানবন্দিতে উজ্জ্বল বলেন, ‘পি কে হালদারের টাকায় আমি সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে গিয়েছি তিনবার। এসব ভ্রমণে আমার সঙ্গী হতো রাজীব সোম, অমিতাভ অধিকারী এবং পি কে হালদারের বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল। পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবী অবন্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাই। এই দুজনের সঙ্গে তিনি পৃথকভাবে ২০ থেকে ২৫ বার সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। পি কে হালদারকে নিয়ে এই দুজনের ছিল ব্যাপক প্রতিযোগিতা। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাবে রুনাই ও অবন্তিকার সঙ্গে পি কে হালদার আলাদা আলাদা সময় কাটাতেন। আমরা রুনাইকে বড় আপা আর অবন্তিকাকে ছোট আপা ডাকতাম। কারণ রুনাই চালাত ইন্টারন্যাশনাল লিজিং আর অবন্তিকা চালাত পিপলস লিজিং।’
উজ্জ্বল কুমার জবানবন্দিতে বলেন, ‘সিমটেক্সের সিদ্দিকুর রহমান ও জেডএ অ্যাপারেলসের জাহাঙ্গীর আলম এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক শহীদ রেজা পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এদের বিভিন্নভাবে ব্যবহার করে উপকৃত হয়েছেন পি কে হালদার। দুই ডজন অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আত্মীয়-স্বজন এবং সহযোগীদের ব্যবহার করে পি কে হালদার পিপলস লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং এবং এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন।’
উজ্জ্বল কুমার আরো বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় পিপলস লিজিংয়ের ৬৬ কাঠা জমি বিক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। জমিটি পি অ্যান্ড হাল ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি করা হলেও পিপলস লিজিংয়ের জমি বিক্রির টাকা পরিশোধ হয়েছে কাগুজে প্রতিষ্ঠান লিপরো ইন্টারন্যাশনাল, হাল এন্টারপ্রাইজ, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল ও এফএএস লিজিং থেকে। এগুলো সবই পরোক্ষভাবে পি কে হালদারের কম্পানি। জমি বিক্রির ১২০ কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে স্থানান্তর হওয়ার পর এসব টাকা আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিংয়ে স্থানান্তর করা হয়। সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ওই জমি বিক্রি থেকে ছয় কোটি টাকা এবং চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার জন্য ১২ কোটিসহ ১৮ কোটি টাকা পি কে হালদারের কাছ থেকে ঘুষ নেন।’
রাজধানীর ৭৩ গ্রিন রোডে পিপলস লিজিংয়ের ৬৬ কাঠা জমি কিনতে অগ্রিম হিসেবে সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ২০১০ সালের দিকে পিপলস লিজিং থেকে ১২৩ কোটি টাকা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৯৮ কোটি টাকা দিয়ে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ও সামসুল আরেফিন আলামিন তাঁদের পিপলস লিজিংয়ের ঋণ অ্যাডজাস্ট করেন। মূলত জমি ক্রয়ে দালালি করে ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম ১২ কোটি টাকা আর সামসুল আরেফিন আলামিন ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট প্রতিবেদনও যার উল্লেখ রয়েছে।
উজ্জ্বল কুমার নন্দী বলেন, ‘পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার নাই। কিন্তু পি কে হালদার আমাকে ওই চেয়ারে বসিয়ে পরোক্ষভাবে তিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। আমার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম। তিনি পদ ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে পি কে হালদার ব্যাংক চেকের মাধ্যমে তাঁকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করেন।’
১৫৮টি ফাইল গায়েব হওয়ার বিষয়ে উজ্জ্বল কুমার বলেন, ‘আমি ২০১৫ সালের নভেম্বরে পিপলস লিজিংয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাই। পি কে হালদারের কথামতো ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক নওশেরুল ইসলাম, বাসুদেব ব্যানার্জীদের প্রতিষ্ঠান দিয়া শিপিং ও এমটিবি মেরিনকে ঋণ দিই। প্রকৃতপক্ষে দিয়া শিপিং নামের কোনো কম্পানি নেই। পরে জানতে পারি জমি আছে। ঋণের পুরো টাকাই এই দুই প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ হয়েছে। পরে জানতে পারি, ১৫৮টি ফাইল আমার সময়ে গায়েব হয়েছে। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
জবানবন্দিতে তিনি আরো বলেন, ‘পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য শুধু আমিসহ বর্তমান পর্ষদ দায়ী নয়। আগের পর্ষদও দায়ী। পিপলস লিজিং থেকে সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ সাবেক পরিচালকরা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ পর্যন্ত লিজ, ঋণ ও অ্যাডভান্স খাতে ফিন্যানশিয়াল স্টেটম্যান্টে ১১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার বেশি দেখানো হয়েছে। আর ভুয়া ও অস্তিত্বহীন লিজ ফাইন্যান্সের মাধ্যমে ১৯১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টার্ম লোন ২০৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা কম দেখানো হয়। এর মধ্যে ২৫ কোটি টাকার ট্রেজারি লোন আর্থিক বিবরণী থেকে মুছে ফেলা হয়। কল লোন ও ওভারড্রাফট ৭৪ কোটি টাকা কম দেখানো হয়। সামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটে পিপলস লিজিং থেকে আড়াই কোটি করে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে ট্রানজেকশন হলেও ওই ফাইল গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকার বেশি দেখিয়ে নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেমসহ পরিচালকরা। ফলে ওই সময় সম্পদ বেশি দেখানো হয় ৩০৯ কোটি টাকা আর দায় কম দেখানো হয় ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, জিএম শাহ আলমসহ সিন্ডিকেটকে ছয় কোটি ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়।’
উজ্জ্বল কুমার নন্দী জবানবন্দিতে আরো বলেন, ‘পি কে হালদার ২০১৪ সালের দিকে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম চৌধুরীর কাছে ১২৭ কোটি টাকা দিয়ে কক্সবাজার র্যাডিসন হোটেলটি ক্রয় করেন। হোটেলটির চেয়ারম্যান পি কে হালদার এবং এমডি জাহাঙ্গীর আলম। পি কে হালদার রিলায়েন্স লিজিং থেকে বিভিন্নভাবে ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্রায় হাজার কোটি টাকা বের করে নেন। পরে চাপে পড়লে একই কায়দায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ বের করে রিলায়েন্সের দেনা পরিশোধের চেষ্টা করেন। এই কাজে আমাকে, নাহিদা রুনাই, আল মামুন সোহাগ, রাফসান রিয়াদ চৌধুরী, সৈয়দ আবেদ হাসানসহ ৪০-৪২ জনকে ব্যবহার করেন তিনি।’উৎসঃ kalerkantho