এবারের বাজেটে কালোটাকায় কেনা জমি-ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ এবং ব্যাংক বা অন্য কোথাও লুকানো (আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত) নগদ অর্থ সাদা করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়। সেই সুযোগ নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৩৩ জন টাকা সাদা করেছেন। ব্যাংকে লুকানো টাকা সবচেয়ে বেশি সাদা করা হয়েছে। নগদ টাকা যারা লুকিয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকার মানুষ। আর অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট ছিল কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ বাসিন্দাদের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মোটা দাগে, এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) সমাজের বিত্তশালীরা রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গার্মেন্ট ব্যবসায়ীসহ নানা ব্যবসায় ও পেশায় জড়িতরাই এলটিইউ-এর করদাতা। এখানকার করদাতাই সবচেয়ে কম কালোটাকা সাদা করেছেন। মাত্র একজন শেয়ারবাজারে কালো অর্থ বিনিয়োগ দেখিয়ে বৈধ করেছেন। আর ২ জন জমি, ১ জন ফ্ল্যাট ও ২২ জন নগদ অর্থ ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এলটিইউ ছাড়াও ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীরা অন্য কর অঞ্চলে রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন। তবে সেই সংখ্যা তুলনামূলক কম।
এবারের বাজেটে অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশ সংশোধন করে নতুন দুটি ধারা যুক্ত করা হয়। ১৯এএএএ ধারায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ রিটার্নে দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অনুমোদিত ও তালিকাভুক্ত কোম্পানির স্টক, শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড, ডিবেঞ্চার ও অন্য সিকিউরিটিজ এবং শেয়ারবাজারে ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য সব সরকারি সিকিউরিটিজ ও বন্ডে এ সুযোগ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়, ঘোষণা দেওয়ার পর এক বছর বিনিয়োগকৃত অর্থ শেয়ারবাজার থেকে ওঠানো যাবে না। একইভাবে একই হারে কর দিয়ে ১৯এএএএএ ধারায় জমি-ফ্ল্যাট ও নগদ অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে ১৯ই ধারার মাধ্যমে নির্ধারিত করের অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার বৈধতা দিয়ে রেখেছে এনবিআর। এবার শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় একে ‘বিশেষ সুবিধা’ বলা হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোট ২৫২ জন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা কালোটাকা বৈধ করেছেন। তারা ২৬২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। এ থেকে সরকার আয়কর পেয়েছে ২৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এছাড়া কালোটাকায় কেনা জমি রিটার্নে প্রদর্শন করেছেন ১ হাজার ১৩৭ জন। তারা ৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৭৭ বর্গমিটার (১৪৭ একর) জমি বৈধ করেছেন। সরকার আয়কর পেয়েছে ৭০ কোটি ২১ লাখ টাকা। একইভাবে ১ হাজার ৯৯৯ জন করদাতা ফ্ল্যাট বৈধ করেছেন। এ থেকে আয়কর আদায় হয়েছে ৯৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি নগদ অর্থ বৈধ করা হয়েছে। এককথায় বলা যায়, ব্যাংকে লুকানো অর্থ রিটার্নে প্রদর্শনের হিড়িক পড়ে। মোট ৪ হাজার ৯৪৫ করদাতা ৭ হাজার ২১৩ কোটি টাকা রিটার্নে দেখিয়েছেন। এ থেকে আয়কর আদায় হয়েছে ৮৩৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিশেষ সুবিধা দিয়ে এনবিআর কালোটাকা থেকে ১ হজার ২৪ কোটি টাকার আয়কর পেয়েছে।
এনবিআরের অধীন ৩১টি কর অঞ্চলের মধ্যে শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ বৈধ করেছেন ঢাকার কর অঞ্চল-১ ও ৪-এর করদাতারা। এর পরের অবস্থানে আছেন যথাক্রমে সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও বগুড়া অঞ্চলের করদাতা। আর সবচেয়ে বেশি জমি বৈধ করেছেন কুমিল্লা অঞ্চলের মানুষজন। এ সুবিধা নিয়েছেন ১৪১ জন। এর পরের অবস্থানে আছেন খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও রাজশাহীর মানুষ। ফ্ল্যাটও বৈধ করার ক্ষেত্রে কুমিল্লার মানুষজন এগিয়ে। এর পরের অবস্থানে আছেন গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার মানুষ। তবে ব্যাংকে টাকা লুকানের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে ঢাকার মানুষজন। এ অঞ্চলের করদাতারাই সবচেয়ে বেশি অর্থ রিটার্নে দেখিয়েছেন। এ তালিকায় এগিয়ে আছেন কর অঞ্চল-১০, ৫ ও ২-এর করদাতারা।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, স্বাভাবিকভাবে কর দিলে যেখানে ৩০ শতাংশ হারে কর দেওয়া লাগত, সেখানে বিশেষ সুযোগ দেওয়ায় ১০ শতাংশ হারে কালোটাকা সাদা হয়েছে। এ হিসাবে সরকার ২০ শতাংশ কর কম পেয়েছে। অর্থাৎ সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকে লুকানো টাকা বেশি সাদা হয়েছে। তার মানে, এ টাকা অর্থনীতিতেই ঘোরাঘুরি করছিল। সরকার চাইলে অন্য কোনো ফরমেটে এ অর্থ থেকে ট্যাক্স আদায় করতে পারত। তা না করে বিশেষ সুযোগ দেওয়ায় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, দুর্বল কর সংস্কৃতি ও এনফোর্সমেন্টের কারণে অর্থনীতিতে কালোটাকা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আদতে সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করছে। কারণ যারা নিয়মিত কর দেয়, তাকে বেশি হারে কর দিতে হচ্ছে। আর কালোটাকা বৈধ করলে কম হারে কর দিতে হয়। এক্ষেত্রে এনবিআর এই সুযোগ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে কালোটাকা তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গেল কয়েক বছরের কালোটাকা সাদা করার তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এর খুব বেশি সুফল পাওয়া যায়নি। তাই কর সংস্কৃতি গড়ে তোলা ও শক্তিশালী এনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে কালোটাকার উৎস বন্ধ করা উচিত বলে মনে করি।
কালোটাকার ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের একাংশ এর বিরোধিতা করে আসছে। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছে। তৎকালীন এ থেকে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরবর্তী সময়ে এ সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয়, সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। ১৯৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ১৯৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা।
এরপর ধারাবাহিকভাবে কালোটাকার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ১৯৯৭-২০০০ পর্যন্ত এক লাফে ৯৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, আয়কর আদায় হয় ১৪১ কোটি টাকা। পরের ৭ বছর অর্থাৎ ২০০১-০৭ পর্যন্ত ৮২৭ কোটি টাকা, ২০০৭-০৯ পর্যন্ত এক হাজার ৬৮২ কোটি টাকা, ২০০৯-১৩ পর্যন্ত এক হাজার ৮০৫ কোটি টাকা ও ২০১৩-২০ পর্যন্ত ১১ হাজার ১০৭ কোটি টাকা মূলধারার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এ থেকে সরকার রাজস্ব পায় যথাক্রমে ১০২ কোটি, ৯১১ কোটি, ২৩০ কোটি ও এক হাজার ৭৩ কোটি টাকা।