ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানো হয় গত ডিসেম্বরে, যদিও সেতুটির অনেক কাজ এখনও অনেকটা বাকি রয়েছে। এরই মধ্যে সেতুটির ব্যয়ের হিসাবে দেখা দিয়েছে অসংগতি। প্রকল্পটির প্রধান দুই প্যাকেজÑমূল সেতু ও নদীশাসনে বাস্তব অগ্রগতির চেয়ে বেশি প্রায় দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা বাড়তি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। যদিও এর সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ৩১ জানুয়ারি এ হিসাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে সেতু কর্তৃপক্ষ, পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এবং ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের হিসাবেও রয়েছে গরমিল।
পদ্মা সেতুর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর আর্থিক অগ্রগতি ৯ হাজার ১৪৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার। অথচ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঠিকাদারকে বিল প্রদান করা হয়েছে ১০ হাজার ৫৮৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ হিসাবে অগ্রগতির তুলনায় এক হাজার ৪৪১ কোটি ৯১ লাখ টাকা বেশি বিল দেয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজকে।
যদিও এ হিসাবের সঙ্গে পদ্মা সেতুর ব্যবস্থাপনা পরামর্শক ও সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবের কোনো মিল নেই। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসাবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত চায়না মেজর ব্রিজকে বিল প্রদান করা হয়েছে ১০ হাজার ৬৭৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা। আর সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে বিল দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৮৮১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ তিন হিসাবের মধ্যে কোনো মিল নেই।
একই চিত্র পদ্মা সেতু প্রকল্পের নদীশাসন প্যাকেজের। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ প্যাকেজের আর্থিক অগ্রগতি চার হাজার ৯৮৩ কোটি ১০ লাখ টাকার, আর ঠিকাদারকে বিল প্রদান করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৩৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ হিসাবে অগ্রগতির তুলনায় ৬৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বেশি বিল দেয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে।
যদিও পদ্মা সেতুর ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসাবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সিনোহাইড্রো করপোরেশনকে বিল প্রদান করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৭৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আর সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাবে বিল দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫২ কোটি ১০ লাখ টাকা। অর্থাৎ নদীশাসনেও ঠিকাদারের বিলের হিসাবে কোনো মিল নেই।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হিসাব ধরলেই দুই ঠিকাদারকে বাড়তি বিল দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৯৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর কারণে জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান দুই প্যাকেজের (মূল সেতু ও নদীশাসন) যতটুকু কাজ হয়েছে, ততটুকুর বিল দেয়া হয়েছে। তবে আর্থিক অগ্রগতি ও বিল প্রদানের হিসাবে ভিন্নতা কেন হয়েছেÑতা বলতে পারব না। এছাড়া তিন সংস্থার বিলের হিসাবের ভিন্নতার কারণ সম্পর্কেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
যদিও অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, প্রতিটি প্রকল্পে ঠিকাদারের বিল ছাড় করার জন্য প্রকল্প পরিচালকের অনুমোদন লাগে। তাই তিনি সঠিক তথ্য দিতে না পারলে অন্য কারও পক্ষে এর ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়।
পদ্মা সেতুর আর্থিক আরও কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে ব্যবস্থাপনা পরামর্শকের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে নদীশাসন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, সিনোহাইড্রো করপোরেশন নদীশাসনের কাজের যে সম্ভাব্য অগ্রগতির হিসাব জমা দিয়েছে, তা অবৈধ। কারণ তাতে নদীশাসনের ব্যয় চুক্তিমূল্যকে ছাড়িয়ে যাবে।
এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর আগে জামানত হিসাবে চায়না মেজর ব্রিজের জমা দেয়া অ্যাডভান্স পেমেন্ট গ্যারান্টির মেয়াদ গত বছর ৩০ মে শেষ হয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রেন্ডাল অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। এছাড়া ম্যাটারিয়ালস অ্যাডভান্স পেমেন্ট গ্যারান্টির মেয়াদও ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে। এগুলো নবায়ন না করায় সেতুটি নির্মাণকালে বা পরবর্তী সময়ে আর্থিক কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা সমন্বয় করতে গিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পের আওতায় মূল সেতু নির্মাণে চুক্তি সই করা হয় ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। এ চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর নদীশাসনের চুক্তি সই করা হয় ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এর মূল্য আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এছাড়া জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণসহ মোট প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ২৮৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
সর্বশেষ হিসাবে মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২২ সালের ২৩ এপ্রিল। চায়না মেজর ব্রিজ গত বছর সর্বশেষ এ তারিখ নির্ধারণ করলে তা মেনে নেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। আর নদীশাসন শেষ করার সম্ভাব্য সময়সীমা ধরা হয়েছে ২০২২ সালের ৩০ জুন। সিনোহাইড্রো করপোরেশনের প্রস্তাবিত এ তারিখও মেনে নিয়েছে সেতু বিভাগ।
এদিকে পুরো সেতুর নির্মাণকাজ শেষে আরও এক বছর ধরা হয়েছে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড। ওই সময় সেতুতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সমাধানের দায়িত্ব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তাই প্রকল্পটির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত চিঠি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।