রাজধানীর পল্লবীতে পুলিশি হেফাজতে গাড়িচালক ইশতিয়াক হোসেন জনি হত্যামামলায় সাজাপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও তার সোর্সকে গ্রেপ্তারেও গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে। খোদ থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে জনি হত্যামামলার রায় প্রকাশের পর ডিসেম্বরে পল্লবী থানায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার নথি পৌঁছায় বলে জানান থানাটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অথচ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলছেন, এখনো তারা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হাতে পাননি। আলোচিত এই হত্যামামলার রায়ের খবর গণমাধ্যমে দেখেছেন তিনি। এর আগে মামলাটির তদন্তও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ উঠেছিল।
মামলার বাদী নিহত জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি অভিযোগ করেন, পুলিশকে বারবার অনুরোধ করেও আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সাড়া পাচ্ছেন না তারা। পুলিশ তাদের বলছেÑ আসামি আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি আসামি দেখলে আমাদের খবর দিয়েন। পুলিশ যখন এমন কথা বলছে, তখন তাদের সোর্স রাসেল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই পল্লবী এলাকায় মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তার অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানানো হলেও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
পুলিশ হেফাজতে জনি নিহতের ঘটনায় পল্লবী থানায় দায়ের মামলার তদন্ত ভিন্ন দিকে নিয়ে যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এমন
অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট জনির ভাই রকি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে এই মামলা করেন। এ বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মারুফ হোসেন ২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন।
অনেক চড়াই-উতরাই শেষে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন ঢাকার একটি আদালত। এতে ৩ পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন সাজার রায় দেওয়া হয়। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর অধীনে দায়ের হওয়া কোনো মামলায় এটিই প্রথম রায়। এ রায়ের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত ৩ পুলিশ সদস্য হলো পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এএসআই রাশেদুল ইসলাম ও কামরুজ্জামান মিন্টু। এ ছাড়া রাসেল ও সুমন নামে পুলিশের দুই সোর্সকে ৭ বছরের কারাদ- দেন আদালত। এএসআই মিন্টু ও সোর্স রাসেলকে পলাতক বলছে পুলিশ। অন্যরা কারাগারে রয়েছে। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন।
গত বছরের ৩ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন শাখা থেকে পল্লবী থানার ওসির কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পরোয়ানা দুটি পল্লবী থানায় পৌঁছায়। জানতে চাইলে পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, রায়ের খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি। এখনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। পরোয়ানা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) ইয়ামিন কবির জানিয়েছেন ভিন্ন তথ্য। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি আমরা পেয়েছি। পরোয়ানা দুটি তামিলের কাজ করছেন এসআই শরীফ। পলাতক থাকায় আসামিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি। এসআই শরীফও এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের কাজ করছেন।
মামলার বাদী নিহত জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে পুলিশের সোর্স রাসেল পল্লবী এলাকায় মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। একবার সে কোন বাড়িতে রয়েছে এমন সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশকে জানাই। পুলিশের একটি দলও ঘটনাস্থলে আসে। কিন্তু বাসার দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। সেখানে উপস্থিত পুলিশ জানায়, দরজা ভেঙে আসামি ধরার কথা পরোয়ানায় উল্লেখ করা নেই। তাই আমরা সেটি করতে পারব না। তবে এমন অভিযোগের কথা অস্বীকার করেছে সংশ্লিষ্ট থানাপুলিশ।
রকি আরও বলেন, জনির ছোট দুটি সন্তান রয়েছে। বাবার অবর্তমানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাই।
মামলাটিতে এক সময় আইনি সহায়তা দিয়েছেন মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, আসামি পুলিশ হওয়ায় গ্রেপ্তার করতে পুলিশের আগ্রহ না থাকার বিষয়টি বোঝা যাচ্ছে। প্রথমত, অভিযুক্তরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হওয়ায় এই আইনে মামলাই নিতে চায় না পুলিশ। মামলা নেওয়া এবং পরে রায় বাস্তবায়নের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে তদারকি করা উচিত। জনির মামলায় আইনি সহায়তা দেওয়া বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী রেজাউল করিম বলেন, আমরা চাই দ্রুত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করা হোক।
২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে পল্লবী থানার ইরানি বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা বিল্লালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল। নিহত জনি ও তার ভাই রকিসহ অন্য সাক্ষীরা সে অনুষ্ঠানে ছিলেন। রাত ২টার দিকে পুলিশের সোর্স সুমন মদ খেয়ে স্টেজে উঠে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছিল। জনি তাকে প্রথমে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেন। দ্বিতীয়বার সুমন একই কাজ করলে সুমনের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে জনি সুমনকে থাপ্পড় দিলে আধা ঘণ্টা পর সে এসআই জাহিদসহ ২৫/২৬ জন পুলিশ সদস্যকে নিয়ে বিয়েবাড়িতে এসে ভাঙচুর করে এবং নিহত জনি, রকিসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর এসআই জাহিদসহ অন্য আসামিরা তাদের পল্লবী থানা হাজতে হকিস্টিক ও ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে বেদম প্রহার করে। এসআই জাহিদ একপর্যায়ে জনির বুকের ওপর ওঠে লাফালাফি করে। জনি এ সময় একটু পানি খেতে চাইলে জাহিদ তার মুখে থু থু ছুড়ে মারে। নির্যাতনে মামলার বাদী রকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। অন্যদিকে জনিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মিরপুরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দিতে ইরানি ক্যাম্প ও রহমত ক্যাম্পের মধ্যে মারামারির মিথ্যা কাহিনী সাজায় পুলিশ।
মামলার রায়ে বিচারক পর্যবেক্ষণে বলেন, ভিকটিম জনি পানি চাইলে তা দেওয়া হয়নি। জাহিদ তার মুখে থু থু মারেন। আসামিরা শুধু আইনের বরখেলাপই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন।
এসআই জাহিদের নামে নির্যাতনে হত্যার আরও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ঝুট ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান সুজনকে মিরপুর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় জনি হত্যা মামলার মূল আসামি এসআই জাহিদ। হাইকোর্টের আদেশে এ মামলার কার্যক্রম এখন স্থগিত রয়েছে।