ইট ভাটা সংক্রান্ত বিষয়ে এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের জন্য যশোরের কেশবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশনা দিয়েছেন যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। এসময় তিনি ওসিকে নির্দেশনা দেন, যেকোনো ইট ভাটাতে বোমা মেরে ডাকাতির উদ্দেশ্যে হামলার অভিযোগ করে আইনজীবী সাইফুল্লাহকে যেন মামলার আসামি করা হয়।
কেবল বোমা মেরে মামলায় ফাঁসানোই নয়, ইট ভাটা সংক্রান্ত হাইকোর্টের নির্দেশনাকেও কোনো পাত্তা দিতে নারাজ শাহীন চাকলাদার। ওসির সঙ্গে কথপোকথনে নিজের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য পরিচয় উল্লেখ করে নিজেকেই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দাবি করেন তিনি।
সপ্তাহ দুয়েক আগে যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার ও যশোরের কেশবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম উদ্দিনের মধ্যে মোবাইলে এই কথপোকথনটি হয়। তবে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে এমপি শাহীন চাকলাদারের মোবাইল নম্বরে কল-এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। আর ওসি জসিম উদ্দিন বলছেন, এ ধরনের কথপোকথনের কথা স্মরণ করতে পারছেন না তিনি। মোবাইলে দু’জনের এই কথপোকথনের প্রমাণ সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত আছে।
শাহীন চাকলাদার ও ওসি মো. জসিম উদ্দিনের কথোপকথনটি এরকম—
ওসি: স্লামালাইকুম স্যার।
শাহীন চাকলাদার: ঘুম?
ওসি: না স্যার। ঘুমাইনি স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সাতবাড়িয়ার সাইফুল্লাহ কিডা?
ওসি: সাতবাড়িয়া… সাইফুল্লাহ আছে, স্যার ওই ইট ভাটার একটা বিষয় নিয়ে সাইফুল্লাহ, ‘বেলা’য় (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবি সমিতি) যেয়ে মামলা-টামলা করে আর কী। বাজে একটা ছেলে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সাইফুল্লাহ… আপনি এখন রাত্তিরে থানায় বোম মারেন একটা। মারায়ে ওর নামে মামলা করতে হইবে। পারবেন? আপনি থাকলে এগুলো করতে অইবে। না অইলে কোন জায়গায় করবেন? আমি যা বলছি, লাস্ট কথা ইডাই। যদি পারেন ওই এলাকা ঠান্ডা রাখতি, আমি বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। ওখানে কারও বাপের ক্ষমতা নেই। বারবার যেয়ে কেন করে, আপনি কী করেন?
ওসি: ও তো স্যার হাইকোর্টের কাগজ নিয়া আসে বারবার।
শাহীন চাকলাদার: আরেহ… কোথার হাইকোর্ট-ফাইকোর্ট। কোর্ট-ফোর্ট যা বলুক, বলুইগ্যা। অন্য… আমাদের খেলা নাই? খেলা নাই?
ওসি: হাইকোর্টে স্যার…
শাহীন চাকলাদার: ওসি হলি, ওসি কিন্তু ডায়নামিক হইতে অয়। আজকে বাগারপাড়া ওসি আসছিল আমার কাছে। ওরে আবার চৌগাছায় দিয়ে দিচ্ছি। ও ওসি..চেনেন? বাগাড়পাড়া ওসিকে চেনেন?
ওসি: চিনি না আবার স্যার? মামুন সাহেবরে?
শাহীন চাকলাদার: কথা বইলেন তার সাথে। তাকে নিয়ে আসতেছি চৌগাছায়। আপনে ওকে যেকোনোভাবে, যেকোনো লোক দিয়ে, কাইলকে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটায়ে কালকে কাজটা করেন, ওকে?
ওসি: স্যার, দেখি স্যার। কী হয়েছে স্যার? ওর কি ডিস্টার্ব করতেছে আবার?
শাহীন চাকলাদার: ও কী ডিস্টার্ব করবে? আচ্ছা, বন ও পরিবেশ অফিসে আমি আছি। কার বাপের ক্ষমতা আছে এখানে আসবে! আমি বলছি কী, একটা আপনি খেলা খেলে ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। কথা বুঝেন নাই?
ওসি: স্যার, স্যার। দেখবোনে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: কেমন অফিসার আপনি, আল্লাই জানে। কাজ দিলি কাজ পারেন না।
ওসি: হা হা হা হা স্যার। সব কাজই তো করি, স্যার।
শাহীন চাকলাদার: সব কাজ করেন, না? তালিপরে যেকোনো ভাটায় যেয়ে, দরকার হলি পুলিশের দিয়ে লোক দিয়ে সিভিলে বোম ফাটায় দিয়ে চলে আসুক। বলতে হবি যে হামলা করেছে ডাকাতি করার জন্য। এটা ছিল অমুক। একটা বানাই দিলে অয়া গেল।
ওসি: ও স্যার, ওই যে, ওই যে, বেলার যে কাগজটা আসছে, ওডা দেখছেন স্যার আপনে? হাইকোর্টের কাগজটা।
শাহীন চাকলাদার: বেলা-ফেলা আমি দেখবোনে, আমি তো স্থায়ী কমিটির সদস্য।
ওসি: হাইকোর্টের কাগজটা স্যার। হাইকোর্ট।
শাহীন চাকলাদার: হাইকোর্টের কাগজে কী বলেছে?
ওসি: রিসেন্টলি, গতকাল একটা কাগজ আসছে হাইকোর্টের থেকে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: কী আছে?
ওসি: আমি দেখাবনে স্যার কালকে। কালকে সকালে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেবোনে আপনারে, স্যার। হাইকোর্ট থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসছে ওই যে, সুপার ব্রিকস বন্ধ রাখার নির্দেশ দিসে স্যার।
শাহীন চাকলাদার: আমাদের এলাকায় স্কুল-কলেজ বাদে আমি আমার এলাকায় কোনো ব্রিকস বন্ধ করব না। যে যেই দিগ্যা। আমি করব না।
ওসি: কাগজটা তো দেখবেন, স্যার। কী লিখছে, স্যার।
শাহীন চাকলাদার: ঠিক আছে, ওকে।
ওসি: আচ্ছা।
এই কথপোকথনের সূত্রপাত প্রসঙ্গে অনুসন্ধানে জানা গেল, কেশবপুর উপজেলার উত্তর সাতবাড়িয়া গ্রামের সাতবাড়িয়া মৌজার ১৫০৪ নম্বর খতিয়ানের ৪১৫৭ নম্বর দাগে অবস্থিত ‘মেসার্স সুপার ব্রিকস’ নামের ইটভাটার অবৈধ কার্যক্রম বিষয়ে অভিযোগ করেন স্থানীয় আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুল্লাহ। ওই ইট ভাটা বন্ধ করতে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে নির্দেশনাও এনেছিলেন তিনি।
এদিকে, স্থানীয়রা বলছেন, নানাভাবে আলোচিত যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার জাতীয় সংসদের বন ও পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য। এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে যশোরের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ থাকলেও সেগুলো বন্ধ না করার পক্ষই নিয়ে থাকেন তিনি। সুপার ব্রিকসও বন্ধ না করার পক্ষে তিনি। বিষয়টি নিয়ে অ্যাডভোকেট সাইফুল্লাহ সক্রিয়ভাবে কাজ করেন বলেই এমপি শাহীন চাকলাদার তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মামলায় ‘ফাঁসানো’র পরিকল্পনা করে থাকতে পারেন বলে অভিমত স্থানীয়দের।
শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে কথপোকথনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, আমি এমপি সাহেবের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলি। কত কথাই তো হয়। সব কথা তো ওইভাবে স্মরণ থাকে না।
বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অ্যাডভোকেট সাইফুল্লাহকে ডাকাতির মামলার আসামি করতে শাহীন চাকলাদারের নির্দেশনা যেভাবে কথপোকথনে উঠে এসেছে, সেটি উল্লেখ করে জানতে চাইলে ওসি বলেন, এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। আমার আসলে স্মরণ নেই।
অ্যাডভোকেট সাইফুল্লাহ প্রসঙ্গে এমপি শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে কোনো কথা বলেছিলেন— এ প্রশ্নের উত্তরে ওসি বলেন, ‘আমি তো এমপি সাহেবের সঙ্গে প্রতিদিনই কথা বলি। এমপি সাহেব সবার সঙ্গে কথা বলেন। তাই এটা তো নতুন কিছু না।’ সাইফুল্লাহ বিষয়ে এমপি কী বলেছেন— জানতে চাইলে তিনি আবারও বলেন, ‘আমার আসলে এই বিষয়টা ঠিক স্মরণ নেই। তাই বলতে পারছি না।’
এদিকে এই কথপোকথনের বিষয়ে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে। তার মোবাইলে বারবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে তাকে এসএমএস করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এর আগে, ২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি সংসদ সদস্য ও সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুর পর ১৪ জুলাই যশোর-৬ আসনে উপনির্বাচন হয়। এই উপনির্বাচনে বিজয়ী হন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার। এর আগে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত যশোর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
সারাবাংলা