মিজান মালিক
দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ জালিয়াত পিকে হালদারের (প্রশান্ত কুমার হালদার) ১৫ বান্ধবী ও ঘনিষ্ঠ নারীদের ব্যাংক হিসাবে অন্তত ৮৬৭ কোটি টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। উপহার, গাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনে দেয়া, দেশে-বিদেশে ভ্রমণসহ বিভিন্ন অজুহাতে ঋণের নামে তাদের এ অর্থ দেয়া হয়। পিপলস লিজিংসহ চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে মোটা অঙ্কের এ অর্থ নারীদের নামে-বেনামের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে- কখনো ঋণের নামে, কখনো বিনোদন ভাতার নামে আবার কখনো অবৈধ টাকা আড়াল করতে পিকে হালদার অবৈধ উপারে এসব কাজ করেন। কোনো কোনো বান্ধবীর নামে ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর ছাড়াও ফ্ল্যাট ও দামি গাড়ি কিনে দিয়েছেন। আবার কাউকে দেশে-বিদেশে পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে আনন্দ-ফূর্তিও করেছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে পিকে হালদারের এক বান্ধবী দেশ ছেড়ে কানাডায় পালিয়ে যান। তিনি এখন পিকে হালদারের নিয়ন্ত্রণেই ওই দেশে আছেন। বান্ধবীদের নামে অর্থকড়ি খরচের পাশাপাশি নিজেকে আড়ালে রাখতে আর্থিক জালিয়াতিতে পিকে হালদারের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও সহকর্মীদেরও ব্যবহার করেন।
দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান ড. ইকবাল মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, যারা দেশের আর্র্থিক খাত লোপাট করে নিঃশেষ করে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দুদকের জোরদার কাজ চলছে। অনুসন্ধানে যাদের নাম আসবে কাউকেই ছাড়া হবে না।
বিএফআইইউ, দুদক ও অন্যান্য সূত্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অবন্তিকা বড়ালের নামে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ৪ কোটি ৩৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকার একটি ফ্ল্যাট (বাড়ি নং-৩৯, রোড নং-১০/এ) কিনে দেন। অবন্তিকা তার আয়কর নথিতে ওই মূল্য প্রদর্শন না করে গোপন করেন। তার ব্যাংক হিসাবেও ১০ কোটি টাকার বেশি স্থানান্তর করা হয়। যা চারটি আর্থিক খাত থেকে হাতিয়ে নেন পিকে হালদার। পিকে হালদারের দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে সহযোগিতা, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ গুরুতর অভিযোগে অবন্তিকা বড়ালকে গ্রেফতার করেছে দুদক।
শিমু রয় নামে তার আরেক ঘনিষ্ঠ নারীর নামে ৬৫ কোটি টাকা সরানো হয়। অবশ্য এ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য রেপটাইলস ফার্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এ টাকা নেয়া হয়। নাহিদা রুনাই ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ফাইন্যান্সের হেড অব বিজনেস। তার কথায় চলত ওই প্রতিষ্ঠান। তার কথায় অনেক কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণের নামে কোটি কোটি টাকা বের করে দেয়া হয় বলে বিএফআইইউর কাছে তথ্য রয়েছে। তার নিজের হিসাবেও
কয়েক কোটি টাকার সন্ধান পেয়েছে দুদক।
পূর্ণিমা রানী নামের একজনকে এমটিবি মেরিন লিমিটেড নামক কাগুজে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলে দেন পিকে হালদার। হলি নামে একজনকে ৭০ কোটি টাকা তুলে দেয়া হয়। আরেক নারী অবনিতার নামে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণ দেখিয়ে ৮৪ কোটি টাকা তুলে দেন পিকে হালদার।
তার বান্ধবী সুপ্তি চৌধুরীর নামেও বিপুল অর্থ সরানো হয়। তিনি কিছুদিন আগে গোপনে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে পিকে হালদারের আশ্রয়ে আছেন তিনি। ঋণের নাম করে শাহনাজ নামে এক নারীকে ৬০ কোটি টাকা, সুস্মিতাকে ৬২ কোটি টাকা, সামিয়া বেগমকেও প্রায় একই পরিমাণ অর্থ দেন পিকে হালদার। অনিন্দিতা মৃধা নামে এক নারীকে উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল নামক ঠিকানাবিহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ৭০ কোটি টাকা কৌশলে তুলে দেন। তার ঘনিষ্ঠ অতশীকে দেন ৮০ কোটি টাকা।
পাপিয়া নামক এক নারীকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংরে পরিচালক দেখিয়ে আরেকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএস থেকে ১২০ কোটি টাকা তুলে দেন। শুভ্রা রানী নামে এক নারীকে ৮০ কোটি টাকা দেন। সুস্মিতা নামে এক নারীকে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার দেখিয়ে ৭০ কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে দেন পিকে হালদার। লামিয়া নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এক নারী সহকর্মীকে তিনি ঘুরতে নিয়ে যেতেন। পাঁচ তারকা হোটেলে তাকে নিয়ে আনন্দ-ফূর্তি করতেন পিকে হালদার। সুন্দরী ওই তরুণী দুদকের কাছে জবানবন্দিতে তা স্বীকারও করেছেন। একই ভাবে সজিয়া রহমান নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের আরেক সুন্দরী তরুণী সহকর্মীকে বিভিন্ন মদের পার্টিতে নিয়ে যেতেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়। পিকে হালদার তার অবৈধ অর্জিত অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে বান্ধবীসহ ঘনিষ্ঠদের নামে সরিয়ে নেন। পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। এ বছরের ৮ জানুয়ারি ঢাকার একটি আদালত এ নোটিশ জারির নির্দেশ দেন। এর আগে ৫ জানুয়ারি পিকে হালদারের মা লীলাবতি হালদারসহ ২৫ ব্যক্তির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া দুদক থেকে ৮৩ জনের বিরুদ্ধে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা ও তাদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে রেখেছে দুদক।
পিকে হালদার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আইএলএফএসএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। গ্রাহকদের অভিযোগের মুখে বছরের শুরুতেই পিকে হালদার বিদেশ পালিয়ে যান। গত বছরের ৮ জানুয়ারি ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ২৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। এ মামলায় দুই দফায় পিকে হালদারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করা হয়। তবে আর্থিক খাত থেকে আÍীয়স্বজন চক্রের মাধ্যমে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় দুটি প্রতিষ্ঠান তদন্ত করছে। তার বিরুদ্ধে ৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। দুদকের ক্যাসিনো দুর্নীতির মামলায় চার্জশিট তালিকায় লিজিং কোম্পানি এবং আর্থিক খাত থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচারে জড়িত পিকে হালদারের নামও রয়েছে।
এদিকে পিকে হালদার এবং তার সহযোগী ও ৩৯ প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ফ্রিজ (স্থগিত) করেছে দুদক। এসব টাকা পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের ব্যাংক হিসাবে গচ্ছিত ছিল। বিএফআইইউর সহযোগিতায় দুদক এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ফ্রিজ করেছে। বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে দুদক। এ ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হতে পারে। বান্ধবী ও ঘনিষ্ঠ নারী ছাড়াও পিকে হালদারের মা লীলাবতি হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারী, মামাতো ভাই শঙ্খ ব্যাপারিসহ আত্মীয়স্বজন, অবন্তিকা বড়াল, বন্ধু একেএম শহীদ রেজাসহ ৮২ জনের নামে নামসর্বস্ব কোম্পানি গঠন কিংবা তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা পাচার করা হয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে। বিএফআইইউর অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিকে হালদারের ব্যক্তিগত কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় ২৪০ কোটি টাকা। আর তার নিজের মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৮২৩ কোটি টাকা। তার মা লীলাবতি হালদার একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হলেও তার তিনটি ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের পরিমাণ ১৬০ কোটি টাকা। তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকার সময় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া ৩ গ্রাহকের ঋণের ৬৩ কোটি টাকাও লীলাবতি হালদারের হিসাবে জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। পিকে হালদারের ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার। দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে একটি কোম্পানি খোলেন ২০১৮ সালে। আর কানাডায় ২০১৪ সালে পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে একটি কোম্পানি খোলা হয়, যার পরিচালক পিকে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও প্রিতিশের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। প্রিতিশ কুমার হালদারের ব্যাংক হিসাবে ৫০ লাখ টাকা জমা থাকলেও তার নামে রয়েছে হাল টেকনোলজি, হাল ট্রিপ টেকনোলজি, পিঅ্যান্ডএল হোল্ডিং, মাইক্রো টেকনোলজিস, নর্দান জুটসহ আরও নানা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ৫০০ কোটি টাকার বেশি জমা হয়।
পিকে হালদারের মামাতো ভাই শঙ্খ ব্যাপারির প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজের নামে ৮৩.৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হলেও তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠজন নওশের-উল ইসলামের প্রতিষ্ঠান মার্কো ট্রেডের নামে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের দুটি হিসাবে যথাক্রমে ২১ কোটি ও ১৫ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। এ ঋণ থেকে ব্র্যাক ব্যাংকে সিগমা ক্যাপিটাল মানেজমেন্ট লিমিটেডের হিসাবে ৬ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়ায় হাল ইন্টারন্যাশনালের হিসাব এবং অন্যান্য কয়েকটি অ্যাকাউন্টসহ পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবে ৩ কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া হয়। শঙ্খ ব্যাপারিকে ৪ জানুয়ারি দুদক গ্রেফতার করেছে।