চট্টগ্রাম বন্দর তার দক্ষতা, সক্ষমতা, ধারণক্ষমতা এবং যান্ত্রিক ও কারিগরি ক্ষমতা অর্থাৎ সব মিলিয়ে পণ্যভার সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে সামর্থ্যরে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। বে-টার্মিনালসহ বন্দরের অবকাঠামো সুবিধাদি সম্প্রসারণ এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ গুরুত্বের সামনে এসে গেছে অনেক আগেই। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন, উন্নয়ন মেগাপ্রকল্প ও প্রকল্পবহরের যন্ত্রপাতি, নির্মাণসামগ্রী আনয়ন, শিল্পের কাঁচামাল, আমদানি-রফতানি বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান চাপ ও চাহিদা পূরণ করা বাংলাদেশের এই হৃৎপিন্ডের জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ। বন্দরে পণ্যভারে বছরজুড়ে বহুমুখী কর্মচাঞ্চল্য। অনেক সময়ই বেহাল অবস্থা। এই পরিস্থিতির মধ্যেও দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে ব্যবহার করে ভারতের ট্রানজিট সুবিধা লাভের অভিলাষ অবশেষে পূরণ হলো। আর, একতরফা অভিনব এই ট্রানজিট ও করিডোরের পরিণামে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। উত্তর-পূর্ব ভারতের জনসাধারণের মাঝে উচ্চ চাহিদার বাংলাদেশের গুণগত মানসম্পন্ন হরেক ধরনের শিল্পপণ্যের উৎপাদন ও রফতানি বাজারে লালবাতি জ¦লার উপক্রম। সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব আদায়ের সুযোগ ভেস্তে যেতে বসেছে।
ভারতের কলকাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বন্দর থেকে ট্রানজিটের ট্রায়াল রান বা প্রাথমিক অপারেশনাল জাহাজ ‘এমভি সেঁজুতি’ গত ২১ জুলাই-২০২০ইং চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। পরবর্তী ট্রায়াল রানের এমনকি পুরোদমে ট্রানজিটের জাহাজে আরও পণ্যসামগ্রী পরিবহনের উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। ‘সেঁজুতি’ জাহাজে আনীত চারটি কন্টেইনার ভর্তি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সড়কপথে লরিযোগে সরাসরি করিডোর সুবিধা নিয়ে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় খালাস করে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছে যায়। এরমধ্যে দুই কন্টেইনারে আনীত ভারতের টাটা স্টিলের টিএমটি বার বা রড নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম ত্রিপুরার জিরানিয়ায়। অপর দু’টি কন্টেইনারে ভর্তি ডালের চালান পৌঁছায় আসামের করিমগঞ্জে। অবশ্য ‘এমভি সেঁজুতি’র আগেই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ‘কানেকটিভিটি’ বা ‘ট্রান্সশিপমেন্টে’র নামে ভারতমুখী ট্রানজিটে পরীক্ষামূলক সর্বপ্রথম পণ্য আনা-নেয়া শুরু হয় ২০১৫ সালের ২ জুন ‘এমভি ইরাবতী স্টার’ জাহাজে। যা ছিল ভারতের বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতের তিনটি বন্দর অভিমুখী।
এই ট্রানজিটের সারকথা হলো- ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহন। ভারতীয় পণ্যসামগ্রী পরিবাহিত হবে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধায়। আবার আখাউড়াসহ বিভিন্ন স্থল সীমান্তপথে, স্থলবন্দর দিয়ে এবং রেল ও নৌপথে থাকছে করিডোর সুবিধা। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’ চুক্তি এবং এই চুক্তির আওতায় তৈরি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুসরণ করা হচ্ছে। এর আলোকে গত ২১ জুলাই ভারতের ট্রানজিট পণ্যবাহী কন্টেইনারের প্রথম ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়।
বাংলাদেশে উৎপাদিত শতাধিক প্রকারের উৎকৃষ্টমানের নিত্যপণ্য, ভোগ্যপণ্য, শিল্প, আইটি ও সেবাখাতের সামগ্রীর উচ্চ চাহিদা ও ব্যাপক বাজার সম্ভাবনা রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত সাতটি রাজ্যে। যেমন- আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ছাড়াও সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার উত্তর প্রদেশ, এমনকি তামিলনাডু-উড়িষ্যাসহ দেশটির অনেক অঞ্চলে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর ট্রানজিটে ব্যবহার করে ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহনের কারলে উবে গেছে রফতানির সুযোগ-সম্ভাবনা। আখাউড়া-আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে করিডোর সুবিধায় উত্তর-পূর্ব ভারতে যাচ্ছে ভারতের মালামাল। আগে যেখানে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে ১৫শ’ থেকে ১৭শ’ কিলোমিটার দূর্গম পথ পাড়ি দিতে হতো, এখন দেশের সড়ক মহাসড়কে মাত্র ১৭০ কি.মি. দূরত্ব অতিক্রম করে পৌঁছানো হচ্ছে দেশটির মালামাল। আখাউড়ার মতোই একই আয়োজন চলছে নবনির্মিত ফেনী মৈত্রী সেতু হয়ে রামগড় স্থলবন্দরে।
একমুখী ট্রানজিটের কারণে বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের রফতানি ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বনাশের মুখোমুখি। আগে ট্যারিফ নন-ট্যারিফ (শুল্ক ও অশুল্ক) বাধার বেড়াজালে দেশের উন্নতমানের পণ্যও ভারতে প্রবেশে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। এবার আখাউড়া স্থলবন্দর করিডোর দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে আসা ভারতের পণ্য পরিবহনের কারণে এসব অঞ্চলের পণ্যসামগ্রী রফতানি সম্ভাবনা নিঃশেষ হতে চলেছে।
ট্রানজিট-করিডোর চালুর সাথেই আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি থমকে গেছে। রফতানিকারক-ব্যবসায়ীরা হতাশ। ট্রানজিটের কারণে দেশীয় পণ্য রফতানি মার খেয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা ভারতের ভোক্তারা এখন নিজদেশের পণ্য নিজেরাই কিনতে পারবেন। ৯০-এর দশকে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় পণ্যসামগ্রী রফতানি শুরু হয়। ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হওয়ার পর প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার সিমেন্ট, এমএস রড, পাথর, কয়লা, প্লাস্টিক, মাছ, ভোজ্যতেল ও নির্মাণ সামগ্রী ভারতে রফতানি হচ্ছিল। তিনশ’রও বেশি পণ্যবাহী ট্রাক যেত আগরতলা দিয়ে।
ইদানীং ভারতে রফতানিতে ধস নেমেছে। দিনে ২০ থেকে ২৫টি লরি পণ্য নিয়ে যায় আগরতলায়। এমএস রড, পাথর, মাছসহ অনেক পণ্য রফতানি বন্ধের মুখে। সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রী, খাদ্যপণ্য রফতানি হ্রাস পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আখাউড়া স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশন দিয়ে ২০১৭-১৮ সালে ভারতে দুই লাখ ১১ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন, ২০১৮-১৯ সালে দুই লাখ ৯ হাজার ৯৬২ টন এবং গত ২০১৯-২০ সালে এক লাখ ৪১ হাজার ৬৪৭ টন পণ্য রফতানি হয়েছে। ট্রানজিটের সুবিধায় ভারতের স্টিলসহ নির্মাণ সামগ্রী, ভোগ্য ও খাদ্যপণ্য পরিবহনের কারণে বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য রফতানি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমন শঙ্কা ব্যবসায়ী মহলের।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ ও পেটেন্ট সামগ্রী, ভেষজ দ্রব্য, শাড়ী, বস্ত্র্র ও তৈরিপোশাক, ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রট্রিক পণ্যসামগ্রী, সিরামিক পণ্য, প্লাস্টিকজাত দ্রব্যাদি, আসবাবপত্র, কৃত্রিম অলংকার-গহনা, তথ্য-প্রযুক্তি, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, কেবলস, লোহা ও স্টিল সামগ্রী, সিমেন্ট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও বেকার্স খাদ্যদ্রব্য, খেলনাসহ সেবা পণ্যের বড়সড় বাজার চাহিদা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পাপতি মীর্জা আবু মনসুর গতকাল বুধবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘ভারত থেকে ভারতের পণ্য ভারতে পরিবহণে’ আমাদের কোনো লাভ বা উপকার নেই। এই একতরফা ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধায় ভারতেরই স্বার্থ, তাদেরই লাভ। কারণ ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে ১৬শ’ থেকে ১৭শ’ কিলোমিটার দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মালামাল পরিবহণ তাদের জন্য অনেক কঠিন ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। ট্রানজিট সুবিধায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে লিংক ব্যবহার করে অতিদ্রুত তারা তাদের পণ্যই নিয়ে যাবে। এখানে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের পণ্যের প্রবেশাধিকার ভারতকে দিতে হবে। দাদাগিরি করলেই তো হবেনা, সরকারকে প্রেসার দিয়ে ভারতকে যুক্তি সহকারে তা বোঝাতে হবে। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির বিরাট বাজার সেখানে রয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ‘দ্য সেভেন সিস্টার্স’ হিসেবে পরিচিত সাতটি রাজ্যে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও বাংলাদেশে উৎপাদিত গুণগতমান সম্পন্ন অনেক পণ্যসামগ্রীর চাহিদা রয়েছে। যেমন- সিমেন্ট, স্টিল ও লোহাজাত পণ্যসহ নির্মাণ সামগ্রী থেকে শুরু করে গোল্লা সাবান পর্যন্ত অনেককিছুই ভারতীয় জনসাধারণ সুলভে কিনতে পারেন। ইতোপূর্বে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা-বিপত্তি দিয়ে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী প্রবেশাধিকার আটকে রাখা হয়। আর এখন ভারতের মালামাল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ব্যবস্থায় ভারতে পরিবহনের ফলে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা নিরূপায়। তদের মাথায় হাত।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ ইনকিলাবকে বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের ব্যাপক রফতানি বাজার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভারত সহযোগিতা না করলে বাজার আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে সরকারের জেনারেল এগ্রিমেন্ট করা উচিৎ হবে, যাতে আমাদের গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী সেখানে বাজারে যেতে পারে। প্রতিবেশী দেশটির ক্রেতা-জনগণ কম খরচে এসব পণ্য কিনে তাদের চাহিদা মেটাতে পারেন। একরতফা ট্রানজিটে দেশের স্বার্থ বা রফতানির নিশ্চয়তা রাখা হয়নি।